দাপুটে জয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় ঐতিহাসিক সিরিজ জয় বাংলাদেশের
২০ বছর ধরে যেখানে একটা জয়ই সোনার হরিণ, সেখানে লড়াই করাই কম কীসে! কিন্তু এবারের গল্পটা ভিন্ন। দক্ষিণ আফ্রিকার উদ্দেশে দেশ ছাড়ার আগে বাংলাদেশ অধিনায়ক তামিম ইকবাল জানিয়েছিলেন, রেকর্ড বদলাতে যাচ্ছেন তারা। লক্ষ্যে অবশ্যই জয়। তাসকিন আহমেদ বলেছিলেন, 'জয় অবশ্যই সম্ভব।' প্রথম ওয়ানডেতেই মেলে তার প্রমাণ। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে বিবর্ণ পারফরম্যান্স হলেও সিরিজ নির্ধারণী স্বদর্পে বাংলাদেশ। ব্যাটে-বলে শাসন করে দাপুটে জয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে ইতিহাস গড়লো তামিম ইকবালের দল।
সেঞ্চুরিয়নের সুপারস্পোর্ট পার্কে তিন ম্যাচ সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডেতে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৯ উইকেটে হারিয়েছে বাংলাদেশ। এই জয়ে প্রথমবারের মতো দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে সিরিজ জিতলো বাংলাদেশ, ব্যবধান ২-১। বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের এটা সপ্তম সিরিজ জয়। স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকা ২০২১ সালের পর ঘরের মাঠে সিরিজ হারলো।
তাসকিন আহমেদের রেকর্ড বোলিংয়ের পর তামিম ইকবাল ও লিটন কুমার দাসের চোখ জুড়ানো ব্যাটিংয়ে পাওয়া ৯ উইকেটের জয়ে রেকর্ডও গড়া হয়ে গেছে বাংলাদেশের। বিদেশের মাটিতে প্রথমবারের মতো ৯ উইকেটে জয়ের হাসি হাসলো বাংলাদেশ, যা সবচেয়ে বড় জয়। স্বভাবতই দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতেও এটা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জয়। যৌথভাবে এটা প্রোটিয়াদের বিপক্ষে বড় জয়ও, এরআগেও তাদেরকে ৯ উইকেটে হারিয়েছে বাংলাদেশ।
টস জিতে আগে ব্যাটিং করে দক্ষিণ আফ্রিকা। তাসকিনের রেকর্ডগড়া বোলিং ও সাকিব আল হাসান, মুস্তাফিজুর রহমানদের অসাধারণ বোলিংয়ে ৩৭ ওভারে ১৫৪ রানেই অলআউট হয় স্বাগতিকরা। ওয়ানডেতে বাংলাদেশের বিপক্ষে এটাই তাদের সর্বনিম্ন রানের ইনিংস। জবাবে হেসেখেলেই এই রান পাড়ি দেয় বাংলাদেশ। তামিম ও লিটনের দারুণ ব্যাটিংয়ে ২৬.৩ ওভারে ১ উইকেটে হারিয়েই জয় তুলে নেয় সফরকারীরা।
দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংস একাই ধসিয়ে দেন ম্যাচসেরা ও সিরিজ সেরার পুরস্কার জেতা তাসকিন, ৯ ওভারে ৩৫ রান খরচায় নেন ৫ উইকেট। যা তার ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় সেরা বোলিং। এ ছাড়া বাংলাদেশের প্রথম বোলার হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকায় ওয়ানডেতে ৫ উইকেট নেওয়ার কীর্তি গড়লেন তাসকিন। বাংলাদেশের তৃতীয় পেসার হিসেবে ৫ উইকেট ঝুলিতে উঠলো তার। তাসকিনের আগে মাশরাফি বিন মুর্তজা ও জিয়াউর রহমানের এই কীর্তি ছিল।
দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে শেষ ১০ বছরে বিদেশিদের মধ্যে প্রথম বোলার হিসেবে ওয়ানডেতে ৫ উইকেট নিলেন তাসকিন। তার আগে ২০১২ সালে সর্বশেষ ৫ উইকেট নিয়েছিলেন শ্রীলঙ্কার কিংবদন্তি পেসার লাসিথ মালিঙ্গা। এরপর অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলেও ৫ উইকেটের স্বাদ নেওয়া হচ্ছিল না প্রোটিয়াদের কোনো পতিপক্ষ বোলারের। তাসকিন সেই অপেক্ষাতে ইতি টেনে গাঁথলেন উইকেটের মালা।
জয়ের লক্ষ্যে ব্যাটিং করতে নেমে দলকে উড়ন্ত সূচনা এনে দেন তামিম ও লিটন। উদ্বোধনী জুটিতে রেকর্ড ১২৭ রান যোগ করেন তারা। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে এটা বাংলাদেশের সেরা উদ্বোধনী জুটি। লিটনের বিদায়ে ভাঙে এই জুটি। ফেরার আগে ৫৭ বলে ৮টি চারে ৪৮ রান করেন ডানহাতি এই ওপেনার।
অধিনায়ক তামিম ছিলেন অবিচল। লিটনকে একপাশে রেখে দারুণ ব্যাটিং করা অভিজ্ঞ এই ওপেনার দলকে জিতিয়েও অপরাজিত থাকেন। ৮২ বলে ১৪টি চারে ৮৭ রান করেন তিনি। শেষ দিকে নামা সাকিব আল হাসান ১৮ রান তুলতেই বাংলাদেশের জয় নিশ্চিত হয়ে যায়। বাংলাদেশের যাওয়া একমাত্র উইকেটটি নেন প্রোটিয়া স্পিনার কেশব মহারাজ।
এর আগে ব্যাটিং করা প্রোটিয়াদের ইনিংসের সপ্তম ওভারে প্রথম আঘাতটি হানেন মেহেদী হাসান মিরাজ। প্রথম ওয়ানডে জয়ে দারুণ ভূমিকা রাখা ডানহাতি এই স্পিনার ১২ রান করা কুইন্টন ডি কককে ফিরিয়ে দেন। শুরুটা মন্দ না হলেও প্রথম উইকেট হারানোর পর দিক হারাতে হয় দক্ষিণ আফ্রিকাকে।
১৩তম ওভারে আঘাত হানেন তাসকিন আহমেদ। দারুণ ছন্দে থাকা বাংলাদেশের ডানহাতি এই পেসার বোল্ড করেন ৯ রান করা কাইল ভেরেইনাকে। দুই ওভার পর আবারও তোপ তাগেন আগুনে বোলিং করা তাসকিন। এবার তার শিকার ওপেনার ইয়ানেমান মালান। ডানহাতি এই ওপেনার ৫৬ বলে ৭টি চারে ৩৯ রান করে আউট হন।
দ্রুত ৩ উইকেট হারিয়ে স্বাগতিকরা যখন বিপাকে, তখন স্পিন জাদুতে অধিনায়ক টেম্বা বাভুমাকে সাজঘর দেখিয়ে দেন সাকিব আল হাসান। ২৫ রানের ব্যবধানে ৪ উইকেট হারিয়ে দিশেহারা হয়ে ওঠা দলকে আরও বিপদে ফেলেন শরিফুল ইসলাম। বাঁহাতি তরুণ এই পেসার প্রোটিয়াদের অন্যতম ব্যাটিং অস্ত্র রাসি ফন ডার ডুসেনের উইকেট তুলে নেন।
৮৩ রানে ৫ উইকেট হারানো দলকে পথ দেখাতে শুরু করেন ডেভিড মিলার ও ডোয়াইন প্রিটোরিয়াস। যদিও এই জুটি ভাঙতে বেশি সময় নেননি সিরিজের সেরা ক্রিকেটার তাসকিন। ২০ রান করা প্রিটোরিয়াসকে নিজের তৃতীয় শিকারে পরিণত করেন। এরপর কেবল তারই দাপট। ১৬ রান করা ডেভিড মিলার ও কাগিসো রাবাদাকে ফিরিয়ে প্রথমবারের মতো বিদেশের মাটিতে ৫ উইকেট নেওয়ার কীর্তি গড়েন বাংলাদেশের পেস আক্রমণের সেরা শক্তি হয়ে ওঠা এই পেসার।
এরপর লুঙ্গি এনগিডিকে রানের খাতা খোলার আগেই বিদায় করেন সাকিব। তাবরাইজ শামসিকে সঙ্গে নিয়ে আরও কিছুটা পথ পাড়ি দেন কেশব মহারাজ। ৩৯ বলে ৪টি চারে ২৮ রান করেন তিনি। তাসকিন ছাড়াও আগুন ঝরানো বোলিং করেন সাকিব, মুস্তাফিজরা। ৯ ওভারে ২৪ রানে ২ উইকেট নেন সাকিব। ৭ ওভারে ২৩ রানে কোনো উইকেট পাননি মুস্তাফিজ। এক উইকেট নেওয়া শরিফুল ইসলাম ৭ ওভারে ৩৭ রান খরচা করেন।