দ্য কাশ্মীর ফাইলস: সিনেমা যখন বিজেপির রাজনীতির হাতিয়ার
বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাস প্রায় ১০০ বছরের। ভারতে সবাক চলচ্চিত্রের শুরু ১৯৩১ সালে। তারও আগে প্যারিসে ছবিতে প্রথম শব্দ সংযোজন করা হয়। কিন্তু সিনেমাটি তৈরিতে সময় লাগে আরো প্রায় দুই দশক। প্রকৃত অর্থে ১৯২৮ সালে প্রথম নিউইয়র্কে একটি ছবি তৈরি করা হয়, যে ছবিটি সবাক ছবি হিসেবে প্রথম স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ছবি। এরপরে ভারতের বিখ্যাত পৃথ্বীরাজ কাপুর, যাকে ভারতের থিয়েটার ও হিন্দি সিনেমা শিল্পের অগ্রদূত ভাবা হয়, একটি ফারসি গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। ছবিটি মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের কাহিনি নিয়ে। সেই সিনেমা দিয়ে যাত্রা করে ভারতের সিনেমা জগতের ইতিহাস।
এই ৮৯ বছরে কয়েক লক্ষ সিনেমা তৈরি হয়েছে ভারতে। সম্ভবত ভারতের চলচ্চিত্র জগত একত্রে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় চলচ্চিত্র শিল্প ও বাজার হিসেবে পরিচিত। বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য দীর্ঘকাল যাবত ভারতীয় চলচ্চিত্র জগৎ একের পর এক চলচ্চিত্র নির্মাণ করে চলছে। ভারতের ইতিহাসের ভিত্তিতে বহু চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে আবার মানুষের দ্বন্দ্ব, সংঘাত, দৈনন্দিন জীবন সংগ্রাম, মনস্তত্ব, দর্শন, ধর্মচিন্তা সকল ক্ষেত্র নিয়েই এই চলচ্চিত্র জগত গড়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক আলোচনায় 'দ্য কাশ্মীর ফাইলস' চলচ্চিত্র। ছবিটি দারুণ ব্যবসাসফল। ইতোমধ্যে ২৫০ কোটির ঘর অতিক্রম করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙ্গে নতুন রেকর্ড গড়বে।
রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার দিক দিয়েও ছবিটি ইতিহাস গড়তে চলেছে। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের সরকার ছবিটির উপর থেকে স্থানীয় শুল্ক মওকুফ করে দিয়েছে যাতে ব্যাপক মানুষ স্বল্প খরচে ছবিটি দেখতে পারে। তার মানে, ছবিটির ভীষণ রাজনৈতিক 'গুরুত্ব' রয়েছে। যে 'গুরুত্ব' ক্ষমতাসীন হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির পক্ষে যায়। ছবিটির পটভূমি ১৯৯০ সালে কাশ্মীরে ঘটে যাওয়া ঘটনা। তখন ভারতীয় রাষ্ট্রক্ষমতায় বিজেপি সমর্থিত সরকার। ছবিটির মূল উপজীব্য কাশ্মীরে মুসলিমদের আধিপত্যের কারণে সেখানকার হিন্দু পণ্ডিতদের উচ্ছেদ।
১৯৯০ সালে জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্যপাল জগমোহন মালদোত্রা। এই সময়েই এই উপত্যকায় হিন্দু মুসলিম বিরোধ চরমে পৌঁছে। ধারণা করা হয়, এর পিছনে কারসাজি ছিল। এই বিরোধকে কেন্দ্র করে পরের দুই দশক ভারতীয় রাজনীতির প্রধান উপজীব্য হয়ে দাঁড়ায় ধর্ম। হিন্দু- মুসলিমদের কথিত বিরোধ ভারতীয় রাজনীতির শক্ত ভিত হয়ে উঠে। ভারতীয় রাজনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার সকল উপাদান ক্রমান্বয়ে বিদায় নিতে থাকে। হিন্দু-মুসলিম সামাজিক বিভেদ চরম আকার ধারণ করে।
২০১৯ সালের ৫ আগস্ট ভারতীয় সংবিধান থেকে ৩৭০ ধারা বিলোপ করার মাধ্যমে কাশ্মীরকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করা হয়। সংবিধানে কাশ্মীরের জন্য যে 'বিশেষ মর্যাদা' ছিল তা তুলে নেওয়া হয়। রাতের আঁধারে মুসলিম যুবা-তরুণদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তুলে নিয়ে যায় যাদের অনেকের আর হদিস মেলেনি। বহু মানুষ পালিয়ে জীবন রক্ষা করে।
অন্যদিকে চলতে থাকে হিন্দুত্ববাদী দক্ষিণপন্থী দলে উল্লাস। তার রেশ যেতে না যেতেই ২০২২ সালে মুক্তি পেল 'দ্য কাশ্মীর ফাইলস'। নতুন করে আবারও আলোচনার কেন্দ্রে কাশ্মীর। ইতিহাস বিকৃত করে একতরফাভাবে খুঁচিয়ে তোলা, ১৯৯০ সালের কাহিনি, কাশ্মীরি পণ্ডিতদের 'ঘরছাড়া' হওয়ার কাহিনি।
বিবেক অগ্নিহোত্রীর ছবিটি ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী টুইট করে জানিয়েছেন, প্রত্যেক ভারতীয়র এই ছবি দেখা উচিত। গত দুই দশকের অধিক সময় ধরে চলা মুসলিম নিধন ও বিতাড়নের যে রাষ্ট্রীয় আয়োজন তা বৈধতা দেয় চলচ্চিত্রটি। সামাজিক বন্ধনের বিপরীতে বিভাজন বহুগুণ উসকে দিয়েছে বিবেক অগ্নিহোত্রীর ছবিটি- মত দেন অনেকে।
ইতিহাস অনুসন্ধান সবসময় কঠিন। মানুষ সহজে এই কঠিন কাজটি করতে চায় না। তারচেয়ে অনেক সহজ, ইতিহাস মিশ্রিত চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ইতিহাস জেনে নেওয়ার চেষ্টা। কিন্তু অনেক সময় এক ধরনের দুরভিসন্ধি থেকে ইতিহাসনির্ভর চলচ্চিত্র তৈরি হয়। দর্শক প্রতারিত হয়। অনেকের ধারণা, সাধারণ নির্বাচনের আগে ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির পালে হাওয়া যোগাবে চলচ্চিত্রটি।
কেবলমাত্র রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কারণে পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের যে কোন মানুষের বাস্তচ্যুতি কোন মানুষ সমর্থন করতে পারে না। '৯০ এর দশকে কাশ্মীরের পণ্ডিতদের উপর উচ্ছেদ বা গণহত্যা চালানো হলে তার তদন্ত ও বিচার হোক। খুঁজে এনে বাস্তচ্যুতদের পুনর্বাসন করা হোক। তা না করে কেবল ধর্মীয় বিভাজন তৈরি করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার চেষ্টা স্পষ্ট।
সামাজিক বিভক্তির বিপরীতে সামাজিক ঐক্য ও ধর্মীয় সম্প্রীতি উপজীব্য করে ভারতে বহু চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। তার অনেকগুলো কালজয়ী। হাল আমলেও ছবিগুলোতে মানবপ্রেমকে প্রাধান্য দেওয়া হলেও প্রেমের কাছে ধর্ম, বর্ণ গৌণ করে দেখানো হয়েছে। প্রেমের কাছে দুই দেশের বিভেদ, প্রাচীর কোন কিছুই বাধা হতে পারেনি। ইতিপূর্বে হারিয়ে যাওয়া এক বাকপ্রতিবন্ধী শিশুকে অনেক ধরনের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিরোধপূর্ণ প্রতিবেশী দেশের বাবা-মায়ের কাছে শিশুটিকে পৌঁছে দেওয়ার কাহিনি নিয়ে রচিত 'বজরঙ্গি ভাইজান' চলচ্চিত্র ভীষণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এ ধরনের চলচ্চিত্রের মাধ্যমে দুই ধর্ম, দুই দেশ ইত্যাদির মধ্যেও এক ধরনের শ্রদ্ধা ও সম্প্রীতি তৈরি হয় যা সমাজের জন্য অতি প্রয়োজন। ধর্মীয় বিভাজন খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রতিবেশি দেশগুলোকে প্রভাবিত করে।
১৯৯৯ সালে পাকিস্তানের সাথে কার্গিল যুদ্ধের পর প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশারফের সাথে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার চেষ্টার অংশ হিসেবে ২০০১ সালের মধ্য জুলাইয়ে আগ্রায় একটি শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানান হয়। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মুশারফ ভারত সফরের সময় মুশারফের স্ত্রী অভিনেত্রী রানী মুখার্জির সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে চেয়েছিলেন। রানী মুখার্জি তখন 'বীর-জারা' চলচ্চিত্রে অভিনয়ের কারণে বেশ বিখ্যাত হয়েছেন। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মুশারফের স্ত্রী ছবিটি দেখেছেন এবং তার মনে ধরেছে ছবিটি। তিনি এটা ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীকে জানালে তিনি ঐ সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেন। চলচ্চিত্রের ভূমিকা এখানেই।
ভারত একটি বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। ভারত আগামীতে বিশ্ব রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান পাবে, নিরাপত্তা পরিষদে স্থান করে নিবে। ভারতের আয়তন, লোকসংখ্যা, অর্থনীতির পরিমাণ সবকিছু বিবেচনায় জাতিসংঘে 'ভেটো' প্রদানের অংশীদার হওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে সমাজকে বিভক্ত করার রাজনীতি তাকে পিছনে ঠেলে দিবে।
ধর্মের ভিত্তিতে আমাদের এই অঞ্চল সৃষ্টি হলেও আমরা দীর্ঘ সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলাম। ধর্মনিরপেক্ষতা আমাদের চেতনার অন্যতম স্তম্ভ। পরিবর্তন হতে সময় লাগেনি। রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম করা থেকে শুরু করে আমরা এখন অনেক গিয়েছি। যার দূরত্ব চেতনার জায়গা থেকে অনেক দূরে। ভারতে হিন্দুত্ববাদ যতখানি এগোবে আমাদের দেশের ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ ততখানি এগোবে- সমাজবিজ্ঞানের এই সাধারণ সূত্র আমাদের মানতে হবে।
সমাজকে বিভক্ত করার যে রাজনীতি তার বিপক্ষশক্তির অভিন্ন সংগ্রাম গড়ে নিয়ে ভাবতে হবে। ভারতের যে কোন ধরনের ধর্মীয় উস্কানির বিরুদ্ধে সেখানকার মানুষ এবং আমাদের এখানে মন্দির পোড়ানো বা সংখ্যালঘু নিগ্রহের ঘটনার বিরুদ্ধে একইভাবে সোচ্চার হওয়া গেলেই রক্ষা পাবে এই উপমহাদেশের মানুষ।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক