ইমরান খান: পাকিস্তানী ক্যাপ্টেনের আখেরি বাজি
গত ৮ মার্চ থেকে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে জড়ো হওয়া রাজনৈতিক ধোঁয়াশা যেন অনেকটাই কাটতে শুরু করেছে। আজ সোমবার (২৮ মার্চ) পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান অনাস্থা ভোটের সম্মুখীন হবেন, তবে গতকাল তিনি এ মাসে প্রথমবারের মতো বিশাল জনসমাবেশে এনিয়ে মুখ খুলেছেন। আগামী দিনগুলোতে, এই ভাগ্য নির্ধারণী ভোটের ফয়সালায় তার পরিণতি যাই হোক, ইমরান একজন আত্মবিশ্বাসী ব্যক্তিত্বের মতো তা বরণ করবেন- এমন ইঙ্গিতই ছিল ওই সুদীর্ঘ বক্তৃতায়। অনাস্থা ভোটের পরিপ্রেক্ষিতে তার আগামীর রাজনৈতিক কৌশল সম্পর্কেও বার্তা দিয়েছেন সমর্থকদের উদ্দেশ্যে।
ইমরান খুব বেশি নতুন কথা বলেননি, যা বলেছেন- তার সাথে সমবেত বিপুল সমর্থকরা আগে থেকেই অনেকটা অবহিত। তবুও রাজধানীর প্রচণ্ড ট্রাফিক জ্যামের ভিড় ঠেলে তারা সমবেত হন ইমরানের বক্তব্য শুনতেই। সত্যিকার অর্থেই, অপেক্ষমান জনতার ধৈর্য্যের পরীক্ষা নেন ইমরান, যারা তার প্রতিশ্রুত রাজনৈতিক ট্রাম্প কার্ডটি কী- সকলেই শুনতে অধীর ছিলেন। কিন্তু, সরাসরি সে আলাপে না গিয়ে আগে দলের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক আখ্যানকে পুনঃব্যক্ত করেন, যার ভিত্তি হবে তার সরকারের অর্জন বলে স্বীকৃত বিষয়াদি যেমন কোভিড-১৯ মহামারি সফলভাবে মোকাবিলা, এহসাস কর্মসূচি (দরিদ্রদের সহায়তা), জ্বালানিতে ভর্তুকি ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রায় এক ঘণ্টার বেশি সময় এসব সাফল্য গাঁথার বর্ণনা দিয়ে তিনি নিজ ভাষণের সবচেয়ে চমকপ্রদ অংশ শুরু করেন।
এসময় জনতার উদ্দেশ্যে একটি ভাঁজ করা নথি দেখিয়ে, একে তার সরকারের বিরুদ্ধে একটি চলমান আন্তর্জাতিক চক্রান্তের 'লিখিত প্রমাণ' বলে দাবি করেন পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রী। তবে এনিয়ে আবেগের স্রোতে ভেসে এখনই সে বিষয়ে বাড়তি কোনো কথা বলতে চান না বলে উল্লেখ করেন ইমরান। দাবি করেন, এমনটা করলে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে ইমরান স্পষ্ট করেই বলেছেন, সামরিক স্বৈরশাসক জিয়াউল হকের অভ্যুত্থানে উৎখাতের আগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো যে পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন; তিনিও একই রকম প্রতিকূলতার মুখে পড়েছেন।
একথার মাধ্যমে ইমরান পরোক্ষভাবে বলে দিলেন, স্বাধীন ও বিদেশি শক্তির প্রভাবমুক্ত পররাষ্ট্রনীতি আঁকড়ে ধরে থাকতে গিয়ে ভুট্টো যেভাবে আন্তর্জাতিক চক্রান্তের শিকার হন, যাতে তার দেশের নিরাপত্তা বাহিনীই প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল, এরপর তাকে হত্যা করা হয়েছিল- ইমরানের ভাগ্যেও সেই অন্ত তারা লিখে দিতে চাইছে।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক বাস্তবতায়, ভূরাজনীতির প্রেক্ষাপটে ইমরানের কথাগুলো যথার্থই হতে পারে। কারণ, বরাবরই বিদেশি শক্তিগুলো পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছে। সরকার ভাঙ্গাগড়ার খেলায় সামরিক বাহিনীকে সামনে রেখে হাসিল করেছে নিজেদের স্বার্থ। বর্তমান সরকারও সেই বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছে। কিন্তু, প্রধানমন্ত্রী ইমরান যদি তার হাতে থাকা প্রমাণ জনসম্মুখে প্রকাশ না করেন তাহলে পাকিস্তানের জনতা এবারও প্রকৃত সত্য থেকে অন্ধকারে রয়ে যাবে।
আপামর পাকিস্তানীরা আরো জানতে চায়, ইউরোপে যখন যুদ্ধ চলছে, বিশ্ব অর্থনীতি যখন রেকর্ড মূল্যস্ফীতির প্রবল চাপের মুখোমুখি- তখন ইমরান বিশ্বশক্তিগুলোকে কী কারণে এতোটা সংক্ষুদ্ধ করেছেন যে, তারা এখন তাকে ক্ষমতা থেকেই অপসারণ করতে চাইছে।
তবে সব মিলিয়ে ইমরানের ভাষণ ছিল ভবিষ্যতে দৃষ্টিনিবদ্ধ এক নেতার—যিনি তার সময় ফুরিয়ে এসেছে এনিয়ে নিশ্চিত জানেন, কিন্তু বিনা লড়াইয়ে নয় বরং তিনি রাজনৈতিক শহীদের মর্যাদা চান। তাই ইমরানের অধিকাংশ বক্তব্য জুড়ে যা বলেছেন, তা সমর্থক শ্রেণিকে উজ্জীবিত রাখতেই বলেছেন। ক্ষমতায় না থাকলে এই ভাষণই হবে তার শক্তিশালী বিরোধীদলীয় নেতা হয়ে ওঠার ভিত্তি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ইমরান এক বিপজ্জনক খেলায় (সর্বময় ক্ষমতার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে) নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।