কর্মস্থলে হঠাৎ প্যানিক অ্যাটাক হলে কীভাবে সামলাবেন?
কাজ করার সময় কখনো কি হুট করে আতঙ্ক বোধ করেছেন? কখনো কি হঠাৎই আপনার বুক ধড়ফড় শুরু হয়েছে? আতঙ্কে হাত কাঁপছে, মাথা ঘুরাচ্ছে এমনকি শরীরও হয়তো ঘামে ভিজে গেছে। সেইসঙ্গে জেঁকে বসেছে মৃত্যুভয়। লক্ষণ থেকে মনে হবে যেন হার্ট অ্যাটাক। কিন্তু অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে যাবেন তখনই দেখলেন ধীরে ধীরে কিছুটা ভালো লাগছে। সময়ের সঙ্গে সামলেও উঠলেন। কিন্তু হার্ট অ্যাটাক না হলে এমনটা কেন ঘটল? এর কারণ খুব সম্ভবত আপনি ভয়-চিন্তা ও উদ্বেগের কারণে প্যানিক অ্যাটাকের মুখোমুখি হয়েছিলেন।
প্যানিক অ্যাটাক কী?
আমেরিকান সাইকোলজিকাল অ্যাসোসিয়েশনের (এপিএ) মতে প্যানিক অ্যাটাক হলো "হঠাৎ করে কোনো নির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই ভয় এসে গ্রাস করা"। প্যানিক অ্যাটাকের সময় বেশ কিছু উপসর্গ দেখা দেয়। এসময় দম আটকে আসা বা বুকে চাপ সৃষ্টি হওয়ার মতো বিষয়গুলো সত্যিই আতঙ্কিত হওয়ার মতো। এটা ঠিক যে প্যানিক অ্যাটাকে আপনি মারা যাবেন না। তবে ঘনঘন যদি আতঙ্কগ্রস্ত হন তাহলে সেটা দুশ্চিন্তারই বিষয়।
এপিএ'র মতে প্যানিক অ্যাটাকের ফলে যেসব উপসর্গ দেখা যায়:
- হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া
- ঘনঘন শ্বাস নেওয়া
- ভয়ে শরীর প্রায় অবশ হয়ে যাওয়া
- মাথা ঘোড়ানো
- ঘামতে থাকা, শরীর কাঁপা
- বুকে চাপ সৃষ্টি ও বুক ব্যথা
- হঠাৎ করে প্রচণ্ড গরম বা ঠাণ্ডা লাগা
- হাত ও পায়ে ঝিনঝিন বোধ করা
- মৃত্যুভীতি
এখন প্রশ্ন হলো কর্মক্ষেত্রে কখন প্যানিক অ্যাটাক হয়? সাধারণত জনসম্মুখে কথা বলতে যাওয়া বা পাবলিক স্পিকিং, কোনো ঝগড়া বা দ্বন্দ্বের সময়, কোনো জরুরি মিটিং কিংবা বড় কোনো প্রজেক্ট এমনকি প্রমোশনের মতো বিষয় উত্থাপিত হলেও মানুষ প্যানিকে পড়েন।
অনেক মানুষই সারা জীবনে হয়তো মাত্র দু-একবার প্যানিক অ্যাটাকের সম্মুখীন হন। কিন্তু আপনি যদি এর চেয়েও বেশিবার প্যানিক অ্যাটাকের শিকার হন তাহলে এপিএ আপনাকে কোনো মানসিক বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দিবে। এর জন্য পেশাদার ডায়াগনোসিস ও চিকিৎসার প্রয়োজন হবে, কেননা খুব সম্ভবত আপনি প্যানিক ডিজঅর্ডারে ভুগছেন।
কিন্তু এর বাইরেও যে কেউ হঠাৎ করেই প্যানিক অ্যাটাকের শিকার হতে পারেন। সেক্ষেত্রে কী করবেন? যদি প্রথম বা দ্বিতীয়বারের মতো প্যানিকগ্রস্ত হন তারপরও এটা কেটে যাওয়া মাত্রই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। কারণ হার্ট অ্যাটাকের মতো গুরুতর বিষয়েও একই ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়। আর তাই নিশ্চিত হয়ে নেওয়াই ভালো।
কর্মক্ষেত্রে যেভাবে প্যানিক অ্যাটাক সামলে উঠবেন
কাজের কারণে চাপ সৃষ্টি হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আর তাই কর্মক্ষেত্রে অসংখ্য মানুষ প্যানিক অ্যাটাকের সম্মুখীন হন। আর সেক্ষেত্রে বিষয়টি আরও জটিল হয়ে পড়ে। বাসায় এমন কিছু ঘটলে আপনি হয়তো বিছানায় শুয়ে পড়বেন বা বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ পাবেন। কিন্তু অফিসে কী করবেন?
উপসর্গ দেখা দিলে প্রথমেই একটি নিরিবিলি জায়গা খুঁজে নিন। সেখানে বসে ভালো বোধ হওয়া অবধি একটু সময় নিন। যদি কোনো মিটিং বা চাপের মুহূর্তে থাকেন, সেক্ষেত্রে পানি খাওয়ার জন্য বা ওয়াশরুমে যাওয়ার কথা বলে বেরিয়ে আসুন। যদি মনে করেন আপনার অনুপস্থিতিতে কোনো সমস্যা হতে পারে, সেক্ষেত্রে কোনো সহকর্মীকে টেক্সট করে জানিয়ে দিন যে আপনার শরীর ভালো না। এবার নিরিবিলি জায়গা খুঁজে নিয়ে এই কৌশলগুলো অবলম্বন করুন।
১। ধীরে ধীরে গভীর শ্বাস নিন
চোখ বন্ধ করে মনোযোগের সঙ্গে মুখ দিয়ে ধীরে ধীরে গভীর শ্বাস নিন। এক থেকে চার পর্যন্ত গুনে শ্বাস নিয়ে এক সেকেন্ডের জন্য ধরে রাখুন। এরপর পুনরায় চার পর্যন্ত গুনে ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ফেলুন। এরফলে আপনার হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক হবে আর মাথাঘোরানো ভাবও অনেকটাই কমবে। একবার আপনি নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিলে ভয়ও কমে যাবে। কিন্তু এরপরও যদি শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণে না আসে তাহলে বসে পড়ুন। এবার দুই পায়ের মাঝে মাথা রেখে একটি পেপারব্যাগ নিয়ে সেখানে শ্বাস নিন।
২। মনোযোগ নিবন্ধ করুন
আবেগের আতিশয্যে থাকাকালে নিজের নিঃশ্বাসের দিকে মনোযোগ দিন। এতে আপনি যে বিষয় নিয়ে উদ্বেগে ছিলেন সেই চিন্তায় ছেদ হবে। নিজেকে বলুন, "আমি মারা যাচ্ছি না। এটা কেটে যাবে।" সব মনোযোগ আপনার বর্তমান অবস্থার দিকে নিয়ে আসুন। কেমন বোধ হচ্ছে সেদিকে খেয়াল। এমন তিনটি জিনিসের নাম বলুন যা আপনি দেখতে পাচ্ছেন; তিনটি জিনিস যা আপনি শুনতে পাচ্ছে এবং তিনটি জিনিস যা আপনি বোধ করছেন। যদি আপনি ইয়োগা করে থাকেন সেক্ষেত্রে সুখাসনের মতো সহজ কোনো আসন নিয়ে নিন। এতে করেও আপনার মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হবে।
৩। একটি শান্তিপূর্ণ আনন্দঘন জায়গার কথা ভাবুন
এমন কোনো জায়গার কথা ভাবুন যে জায়গার কথা মনে পড়লে আপনি প্রশান্তি অনুভব করেন। সেটা হতে পারে কোনো নদী, পাহাড় কিংবা সমুদ্র। এবার নিজেকে সেই জায়গায় কল্পনা করুন। জায়গাটির ছোটখাটো জিনিসগুলো মনে করার চেষ্টা করুন। এভাবেই সাধারণত মনোযোগ নিবন্ধ করা হয়ে থাকে। যেমন, ভেবে দেখুন আপনার প্রিয় পাহাড়ে কী কী গাছ আছে। সেসব গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে কি রোদ এসে পড়ছে? কোনো বিশেষ রঙের ফুল কি দেখতে পাচ্ছেন? সেই ফুলের গন্ধ কেমন? সূক্ষ্মভাবে সবকিছু ভাবতে থাকুন।
৪। জীবনের মন্ত্র আওড়ে যান
আপনার জীবনে কোনো নীতিবাক্য আছে? বা কোনো প্রিয় লাইন? এরকম প্রিয় বা পছন্দের কোনো বাক্য, কোট বা কবিতা থাকলে চোখ বন্ধ করে সেগুলো একমনে আওড়ে যান।
৫। বিরতি নিন
সুযোগ পেলে অফিস থেকে বিরতি নিন। বসকে জানান যে আপনার শরীর ভালো নয়, তাই আজ আগেই উঠতে চান। তা না হলে অন্তত নিজের ডেস্ক থেকে ১৫ মিনিটের বিরতি নিন। এক কাপ হারবাল বা রঙ চা খেতে পারেন। বাইরে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করুন। কিন্তু যদি বিরতি নেওয়ার সুযোগ না থাকে তাহলে ১৫ মিনিট নিজের জায়গায় ধীরস্থির হয়ে বসে থাকুন। আর অফিস শেষে হলেও অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে ভুলবেন না।
অফিসে কারও প্যানিক অ্যাটাক হলে কীভাবে সাহায্য করবেন
প্রথমেই মাথায় রাখুন নিজে থেকেই অন্য কেউ প্যানিক অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়েছে এমনটা ঘোষণা করে বসবেন না। এর উপসর্গফুলো গুরুতর। তাছাড়া কেউ কাজের চাপে বিহ্বল হয়ে পড়ার অর্থও এই নয় যে তিনি প্যানিক আক্রান্ত হয়েছেন। তবে কাউকে অস্বস্তি বোধ করতে দেখলে শান্তভাবে কথা বলুন। এক্ষেত্রে যা করবেন:
১। জিজ্ঞেস করুন তিনি কেমন বোধ করছেন
আক্রান্ত ব্যক্তিকে শান্তভাবে জিজ্ঞেস করুন যে তিনি ঠিক আছেন কি না। আপনার সঙ্গে বাইরে একটু খোলা হাওয়ায় ঘুরে আসতে চায় কি না প্রশ্ন করুন। যদি তারা ঠিকমতো উত্তর দিতে না পারে সেক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনাও থাকছে। এমন পরিস্থিতিতে দেরি না করে দ্রুত অ্যাম্বুলেন্স ডাকুন ও চিকিৎসকের সাহায্য নিন।
২। নিরিবিলি ও একান্ত কোনো জায়গা খুঁজে দিন
প্যানিকের ক্ষেত্রে চারপাশের পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখে। আর তাই এমন পরিবেশ থেকে আপনার সহকর্মীকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করুন। পরিবেশ বদলে গেলে প্যানিকও কমে যাবে। জিজ্ঞেস করুন যদি তিনি অন্য কোথাও যেতে যান। সম্মতি জানালে নিরিবিলি জায়গা খুঁজে দিতে সাহায্য করুন। তবে, যদি তিনি প্রয়োজন নেই বলে মনে করেন সেক্ষেত্রে জিজ্ঞেস করুন অন্য কোনো সাহায্য লাগবে কি না। যদি সাহায্য নিতে আগ্রহী না হন, তাহলে বলুন যে আপনি পাশে আছেন। যেকোনো প্রয়োজনে যেন আপনাকে জানায়।
৩। যা বলছে শুনুন
যদি আক্রান্ত ব্যক্তি আপনার সাহায্য চায়, সেক্ষেত্রে তিনি যা চায় তাই করুন। মনে রাখবেন এরকম পরিস্থিতিতে তার ব্যবহারও রুক্ষ হতে পারে। তিনি যে প্যানিক অ্যাটাকে পড়েছেন সেটা খোলাখুলি বলতে নাও চাইতে পারেন। সেক্ষেত্রে তিনি যদি আপনাকে চলে যাইতে বলে তাহলে জানান যে, আপনি কাছেই আছেন। এ অবস্থায় তাকে ছেড়ে যাবেন না বলেও জানান। প্রয়োজনে আবার ডাকতে পারে বলে জানিয়ে দিন।
৪। আশ্বস্ত করুন
যদি সেই ব্যক্তি আপনাকে থাকতে বলে তাহলেও বলুন যে তাকে সাহায্য করতে আপনি পাশে আছে। তাকে এমন কোনো বাক্য পুনরাবৃত্তি করতে বলুন যেন তিনি সাহস পান। 'সব ঠিক আছে' এমন কিছু ধীরে ধীরে বলতে বলুন। চোখ বন্ধ করে ধীরে ধীরে শ্বাস নিতে বলুন। এছাড়া ওপরে যেসব কৌশলের কথা বলা আছে সেসব কৌশলও প্রয়োগ করুন। যতক্ষণ না তারা কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে, এই পদ্ধতি অবলম্বন করুন।
প্যানিক অ্যাটাক কেটে গেলে তাদের আশ্বাস দিন যে এই ঘটনা আপনি অন্যদের জানাবেন না। এমনকি এই ঘটনার জন্য তার সম্পর্কে আপনার অভিমত বদলাবে না, এমনটাও জানান। তাকে কাজ থেকে বিরতি নেওয়ার উৎসাহ দিন।
প্যানিক অ্যাটাকের বিষয়টি কি বসকে বা এইচআরে জানাবেন?
প্যানিক অ্যাটাকের মতো বিষয় আপনার বস বা এইচআরে জানানোর দরকার নেই। তবে আপনি যদি বিষয়টি জানাতেই চান, তবে ঠিক কতটুকু জানাবেন তাও ঠিক করে নিন।
প্যানিক অ্যাটাক গুরুতর বিষয় হলেও এই বিষয় সামনে আসলে মানুষ আপনার সম্পর্কে কী ধারণা পোষণ করবে, সেটিও আপনার চাপ আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। তবে বেশি চিন্তাভাবনা না করে ওপরে বর্ণিত পদ্ধতিগুলো অবলম্বন করুন। আর দিনশেষে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।
- সূত্র: হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ থেকে অনূদিত