মূল্যস্ফীতির সময় কীভাবে সঞ্চয় করবেন: ৪ উপায়
বাড়িওয়ালার তাগাদা প্রতিনিয়ত—বাড়তি ভাড়া না দিলে খুঁজতে হবে অন্য ঠিকানা? রান্নার গ্যাসের দাম নিয়েও রাতের ঘুম হারাম। নিত্য এ ভোগান্তি আপামর জনতার। সীমিত আয়ের মধ্যে জীবিকানির্বাহ এখন দিনে দিনে আরও কঠিন হয়ে উঠছে।
পণ্যের দাম যে হারে বাড়ে, এদেশে তা কমে আসে না সেভাবে কোনোকালেই। ফলে বাংলাদেশিদের এ ভোগান্তি নতুন নয়। কিন্তু, মহামারিকালে সরবরাহ চক্রে ব্যাঘাত এবং সবশেষ ইউক্রেন যুদ্ধের মতো আন্তর্জাতিক ঘটনাবলীর মারপ্যাঁচে আরও একবার বৈশ্বিক রেকর্ড মূল্যস্ফীতি পেয়েছে নতুন মাত্রা। বাংলাদেশও তার শিকার।
সর্বত্র এখন মূল্যস্ফীতির হাতুরি ভোক্তার ঘাড় ভাঙ্গতে উদ্যত। খরচ কমানোর চেষ্টায় মানুষ মান ছেড়ে, সস্তার পণ্যই খুঁজছে।
আয়ের সাথে সামঞ্জস্য রাখতে মধ্য ও নিম্নবিত্তের সংসারে শুরু হয়েছে কৃচ্ছতা সাধন। পরিমাণে কম খেয়ে কিংবা তেল-মসলার কম ব্যবহারে আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সমতা রক্ষার চেষ্টা করছেন সবাই।
সরকারি তথ্যেও কিছুটা উঠে এসেছে পরিস্থিতির করুণ হাল।
বাংলাদেশের অর্থনীতি গত ফেব্রুয়ারিতে ৬.১৭ শতাংশ মূল্যস্ফীতির মুখে পড়ে, যা ছিল ১৭ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ।
মূল্যস্ফীতির এ হার ছিল জানুয়ারির চেয়ে ৩১ বেসিস পয়েন্ট বেশি।
গত সোমবার (২১ মার্চ) বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়।
শুধু বাংলাদেশ নয়, মূল্যস্ফীতির দৈত্য ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা- কোনো মহাদেশেই হানা দিতে বাদ দেয়নি। রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির রেকর্ড দর—পণ্য উৎপাদন, পরিবহন থেকে শুরু করে ভোক্তাপর্যায়েও দামের চাপ সৃষ্টি করছে।
বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতি আমেরিকায় (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) গেল ফেব্রুয়ারিতে ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়, যা ছিল ৭.৯ শতাংশ।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানিখাত তৈরি পোশাক শিল্প। সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা। ইউরোপিয় ইউনিয়নের দেশগুলোও দেখছে রেকর্ড মূল্যস্ফীতি। এসব ঘটনা আমাদের রপ্তানিকেও প্রভাবিত করতে পারে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞ মহলের। রপ্তানি কমলে খাতটির সাথে যুক্ত কর্মসংস্থানে দেখা দেবে সংকট—যার আবার প্রভাব পড়বে মানুষের আয় সক্ষমতায়।
সব মিলিয়ে বর্তমান বাস্তবতায় খরচ কমানো ছাড়া আয়-ব্যয় সমন্বয়ের কোনো সহজ উপায় নেই। আর মানুষও তাই করছে। তবে এক্ষেত্রে চারটি সহজ অথচ প্রচলিত সমাধান- আপনার বাড়তি দুটি পয়সা বাঁচানোর উপায় বাৎলে দিতে পারে।
১. কেমন বাড়িতে থাকতে চান তা আরেকবার ভাবুন
বেশিরভাগ পরিবার বাসাভাড়া দিতেই আয়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অংশ খরচ করে। বাড়ি ভাড়ার পর বাকী টাকায় চলে মাসের অন্যান্য বরাদ্দের হিসাব-নিকাশ। তাই বাসাবাড়াতেই যদি কিছু টাকা বাঁচাতে পারেন, তাহলে এই দুর্মূল্যের বাজারে অন্য প্রয়োজনগুলি মেটানোর বাড়তি টাকা হাতে থাকবে।
কম টাকার বাসা হয়তো আপনার রুচি ও জীবনযাত্রার সমান হবে না। পরিবারের অন্যরাও আপত্তি তুলতে পারেন। তাই সবাইকে সুবিধা-অসুবিধা বুঝিয়ে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
ফ্ল্যাট বা স্থায়ী আবাসিক সম্পত্তি কেনার ক্ষেত্রেও ন্যূনতম একটি সাশ্রয়ী চিন্তা করুন। আপনি ও আপনার পরিবারের জন্য যতটুকু উন্নত আবাসিক পরিবেশ দরকার- প্রয়োজন না হলে তার বেশি সুবিধা সম্বলিত সম্পত্তি কিনতে বাড়তি টাকা খরচ করবেন না।
বাড়ি কেনার আগে নানান রকম কর ও বিমার খরচের দিকটিও মাথায় রাখবেন।
আমেরিকার দ্য ফিন্যান্সিয়াল জিম সংস্থার বিশেষজ্ঞ জয় লিউ- এর একটি পরামর্শ সবার জন্য উপকারী হতে পারে। তিনি বলেছেন, "বাড়ি কেনার বাড়তি খরচ নিয়ে খুব মানুষই সচেতন। নতুন বাড়িতে অন্দরসজ্জা, আসবাব অনেক রকম খরচের দরকার হয়। মনমতো বাড়ি অবশ্যই সাজান, তবে সাধ্যের দিকটি মাথায় রেখে কিছুটা ত্যাগ স্বীকার করার চিন্তাও মাথায় রাখতে হয়।"
২. ফর্দ ধরে কেনাকাটা, তাতে নতুন কী?
সুপারমার্কেটের পণ্যের বাহার মধ্যবিত্ত অনেককেই বাড়তি কেনাকাটায় উৎসাহ দেয়। আসলে ভোক্তাকে মানসিকভাবে প্রভাবিত করতেই বাহারি পণ্যে সাজানো হয় তাকগুলি। দেখা যায়, দরকারি পণ্যের সাথে তেমন প্রয়োজন নেই, এমন অনেক পণ্যও আমরা কিনে ফেলছি। তাই বাঙালির চিরায়ত ফর্দ ধরে বাজার করা এক্ষেত্রে মোক্ষম সমাধান। কর্তা বা গিন্নি সবাই এ ঐতিহ্যকে অনুসরণ করুন। অদরকারি কেনাকাটা কমে আসাটা হাতেনাতে টের পাবেন।
অদরকারি কেনাকাটায় আমেরিকানদের জুড়ি মেলা ভার। খোদ তাদের ক্ষেত্রেও মিলেছে 'লিস্ট' ধরে বাজার করার সুবিধার প্রমাণ।
ব্রাঞ্চ অ্যান্ড বাজেট সংস্থার আর্থিক পরিকল্পনাবিদ ব্রিটানি ডেভিস মনে করেন, এভাবে মনের আবেগে না ভেসে, সুচিন্তিত সিদ্ধান্তে পণ্য কিনতে পারেন একজন ভোক্তা। তাই যে দোকানেই যান, ডেভিসের পরামর্শ ফর্দ নিতে ভুলবেন না। বেড়াতে যাওয়ার আগেও দরকারি পোশাকআশাক বা খাদ্যের তালিকা করে মিলিয়ে কিনুন। যেগুলো খুব বেশি দরকার নেই, বাদ দিন।
ব্রিটানি বলেন, "যেটি ব্যবহার করবেন তাই আপাতত কিনুন, আগামীতে ব্যবহারের কথা ভেবে ঊর্ধ্বগতির বাজারে অদরকারি কিছু কেনার মানেই হয় না।"
৩. সুযোগ থাকলে মুদিবাজার অনলাইনে সেরে ফেলার অভ্যাস করুন:
বাসস্থান ও পরিবহনের পাশাপাশি গৃহস্থালি খরচের আরেকটি বড় খাত খাদ্য। তাই বলে পুষ্টিকর ও মানসম্মত খাবার যোগাড়ের চেষ্টা করবেন না- এমন পরামর্শ মোটেই দেননি বিশেষজ্ঞরা। বরং তারা বলছেন, বাড়িতে প্রক্রিয়াজাত বিভিন্ন খাবারের উৎপাত কমান।
এক্ষেত্রে বাড়তি সহায়তা পাবেন অনলাইনে মুদিবাজার সারলে। কারণ সুপারশপে সন্তানদের নিয়ে যাওয়া অভিভাবক মাত্রই জানেন- বিভিন্ন প্রকার প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, চকোলেট, পানীয়ে ছোটদের আকর্ষণ থাকায় কেনাকাটা শেষে দেখা যায় ঝুড়িভর্তি বাড়তি অনেক পণ্য।
জয় লিউ বলছেন, অনলাইনে অর্ডার করলে সে ঝামেলা অনেকটা কমবে। তাছাড়া, নানান রকম বাট্টা ও ছাড়ের সুবিধা তো রয়েছেই।
৪. খাদ্যগ্রহণের পরিকল্পনা করুন:
মুদিবাজারের লাগাম ধরে রাখতে চাইলে করতে পারে প্রতিবেলা খাদ্যগ্রহণের সাপ্তাহিক সূচি। ফলে প্রতি সপ্তাহে আপনার কতটুকু চাল, ডাল, তেল গড়ে দরকার হয় তার একটি সুষ্ঠু হিসাবও বেড়িয়ে আসবে। অন্যান্য যেসব উপকরণ কম ব্যবহার হচ্ছে, সেগুলো বুঝেশুনে হাতে থাকা টাকার ওপর নির্ভর করে কিনতে পারবেন।
লিউ বলেন, এই অভ্যাস আপনার মুদি বিলকে অনেক কমাবে। মাংস খাওয়া কমালে খরচ আরও কমাতে পারবেন।
- সূত্র: ফাদারলি ডটকম