সর্দার নেই, নেই হুক্কা-তামাকও, তবে ঢাকায় এখনো আছে পঞ্চায়েত
হাজী আব্দুল মজিদ সরদার আর নাসিরুদ্দিন সরদার ছিলেন বেয়াই। ১১০ বছর বয়সী একটি ছবি আছে কলতাবাজার পঞ্চায়েতের কোষাধ্যক্ষ মো. শাহ আলমের কাছে। মজিদ সরদারের ওই ছবিটি ১৯১১ সালে তোলা হয়েছিল। মজিদ সরদারের ছেলে মন্নাফ সরদার ছিলেন ভাওয়াল রাজা যিনি 'ভাওয়াল সন্ন্যাসী' বলে খ্যাত তার বন্ধু। ভাওয়াল সন্ন্যাসী দীর্ঘদিন রাজ্যপাট ছেড়ে হিল্লিদিল্লী ঘুরে বেড়িয়েছেন, পরে যখন ফিরে আসেন তখন তাকে চেনা দায়। ইয়াবর দাঁড়িগোঁফের জঙ্গল মুখজুড়ে, ধরেছেন গেরুয়া বেশ। আসলে তিনি শ্যালক ও স্ত্রীর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে স্মৃতিভ্রষ্ট হন দার্জিলিং গিয়ে। তারপর নাগা সন্ন্যাসীদের সঙ্গে মিলে নিয়েছেন সন্ন্যাসীব্রত। পরে স্মৃতি ফিরে পেলে সদরঘাটে বাকল্যান্ড বাধে এসে ডেরা বাঁধেন। ততদিনে যুগ পার হয়ে গেছে। আর সরকারও তার রাজ্যপাট রাষ্ট্রের কোষাগারে জমা করতে বসেছিল, তাই সন্ন্যাসীকে কোর্টে প্রমাণ করতে হচ্ছিল তিনিই ভাওয়ালের রাজা আর ওই সব প্রাসাদপুরী তার নিজেরই।
মন্নাফ সরদার তখন সন্ন্যাসীর পক্ষে কোর্টে সাক্ষী দিয়েছিলেন। বুঝি বলেছিলেন, হ্যা ওই তো তার টিকোলো নাক, তার বাংলায় হিন্দুস্তানি টান আছে এখনো দেখছি, রঙটাও মিলে যাচ্ছে ইত্যাদি। মন্নাফ সরদারের সাক্ষ্যের বিবরণ বেড়িয়েছিল তখনকার ১ পয়সা দামের 'বাংলার রূপ' পত্রিকায় (১৯৩৫)।
বাংলার রূপ পত্রিকার কপিও সযত্নে রেখেছেন শাহ আলম। আসলে শাহ আলম পঞ্চায়েতের ব্যাপারে খুব আন্তরিক। কাগজপত্র, ছবি যেমন রেখেছেন, জানেন অনেক পুরোনো কথাও।
'মজিদ সরদার ছিলেন কলতাবাজার পঞ্চায়েতের প্রথম সরদার। মন্নাফ সরদার ওরফে আব্দুল মান্নান বেপারী তার ছেলে, বিয়ে করেছিলেন নাসিরুদ্দিন সরদারের মেয়েকে। মন্নাফ সরদার নিজে কলকাতা গিয়ে বাবা আর শ্বশুরের নামে কলতাবাজার-রোকনপুর এলাকার দুটি রাস্তার নাম লিখিয়ে আনেন। কলতাবাজার পঞ্চায়েতের আরেক সরদার ছিদ্দীক সরদার মারা গিয়েছিলেন মদীনায়। গিয়েছিলেন হজ্ব করতে। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি বা শেষে। ছিদ্দীক সরদারের ছেলে নূরুদ্দিন সরদার অবশ্য পাগড়ি পরা সরদার ছিলেন না। কিন্তু এলাকার লোক তাকে সরদার বলেই মানত। তিনি মারা যান ২০০১ সালে।' বলছিলেন শাহ আলম।
পাগড়ি পরা সরদার
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পর নওয়াব খাজা সলিমুল্লাহ চাইলেন ঢাকার মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করতে। নওয়াব পরিবার তাদের আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন পঞ্চায়েতকে। বাংলাপিডিয়ায় মুনতাসীর মামুন লিখেছেন, ঢাকার আদিবাসীদের কুট্টি বলা হতো। কুট্টিদের অধিকাংশ ছিলেন অশিক্ষিত ও দরিদ্র। কিন্তু ঢাকায় তারাই ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ। পঞ্চায়েত দিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণ করার কথা ভেবে থাকবেন নওয়াব পরিবার। পঞ্চায়েতকে তারা অর্থসাহায্যও দিতেন। নওয়াব পরিবারের প্রধান বিভিন্ন মহল্লার পঞ্চায়েত সর্দারকে পাগড়ি পরাতেন। সব পঞ্চায়েতকে একত্র করে সৃষ্টি করা হয়েছিল তত্ত্বাবধায়কের পদ আর সে পদে নিযুক্তি পেয়েছিলেন খাজা আজম। পঞ্চায়েতকে নওয়াবরা অর্থ সাহায্যও করতেন। ঢাকা শহরের সব মহল্লাতেই ছিল একটি করে পঞ্চায়েত। মহল্লার সব মুসলমান বাসিন্দা এর সদস্য হতেন। মহল্লার সব সামাজিক অনুষ্ঠান পঞ্চায়েতের মাধ্যমেই পরিচালিত হতো। ঝগড়া বিবাদেরও মীমাংসা হতো এর মাধ্যমে। পঞ্চায়েত গঠিত হতো পাঁচজন প্রতিনিধির সমন্বয়ে। তারা পরিচিত ছিলেন 'পঞ্চ লায়েক বিরাদার' নামে। এর মধ্যে একজন ছিলেন সর্দার বা মীর ই মহল্লা। তার নেতৃত্বেই পরিচালিত হতো পঞ্চায়েত। সর্দারি গ্রহণ করার দিন মহল্লার সবাই মিলে সর্দারকে একটি পাগড়ি উপহার দিতেন। এটি পরিচিত ছিল সর্দারি পাগড়ি নামে। মহল্লার সবাই চাঁদা দিয়ে তৈরি করে দিতেন এটি। নওয়াব সলিমুল্লাহ বিভিন্ন মহল্লায় গিয়ে সর্দারদের পাগড়ি পরিয়ে দিতেন। সর্দারি গ্রহণের পর মহল্লার সবাইকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতেন সর্দার। মহল্লার সব সামাজিক অনুষ্ঠানে বিশেষ করে বিয়েতে সর্দারকে উপস্থিত থাকতে হতো। মহল্লায় কারো মৃত্যু হলে মহল্লাবাসীদের খবর দেওয়া, কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করার দায়িত্বও ছিল সর্দারের।
সাধারণত প্রভাবশালী বা বিত্তবান ব্যক্তিই সর্দার হতেন। সর্দারের পরে ছিল নায়েব সর্দারের অবস্থান। সর্দারের অনুপস্থিতিতে তিনিই দায়িত্ব পালন করতেন। মহল্লার দুজন বয়োজ্যেষ্ঠও পঞ্চায়েতের সদস্য নির্বাচিত হতেন। তাদের বলা হতো লায়েক বিরাদার। পঞ্চায়েতের পঞ্চম সদস্য পরিচিত ছিলেন গুরিদ নামে। কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলে বা কারো মৃত্যু হলে গুরিদের মারফত পাঠানো হতো মহল্লার সবাইকে। ঝগড়া বিবাদ মেটানোর যে কোনো পক্ষ পঞ্চায়েতের বৈঠকের অনুরোধ জানাতে পারত। তবে এর খরচ (পান, তামাকবাবদ) বহন করতে হতো আহবানকারীকেই। সাধারণত বৃহস্পতিবার রাতে এ বৈঠক ডাকা হতো। লায়েক বিরাদার এবং সর্দার প্রশ্ন করতেন বাদী-বিবাদীকে। তারপর দেওয়া হতো রায়। দুপক্ষকেই তা মেনে নিতে হতো। রায়ের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ করা যেত না। পঞ্চায়েতকে সহজে কেউ ঘাটাতে চাইতো না। কারণ রায় না মানলে একঘরে করা হতো। সামাজিকভাবে এ বর্জন পরিচিত ছিল বুন্দ নামে। অমান্যকারী ব্যক্তি যদি নিজের মহল্লা ছেড়ে অন্য মহল্লায় গিয়েও ডেরা বাঁধত তবু বুন্দ বহাল থাকত। তাই তার পক্ষে ঢাকায় বসবাস অসম্ভব হয়ে পড়ত।
আইনভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে আরেক ধরনের শাস্তি ছিল– পেটে কাঁঠাল বেঁধে বেত মারা। পঞ্চায়েতের আরেকটি কাজ ছিল মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসবে সাহায্য সহযোগিতা করা। বিশেষ করে মুহররম ও ফাতেহা-ই-ইয়াজদাহম আয়োজনে পঞ্চায়েতকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হতো। পঞ্চায়েতের আয়ের নির্দিষ্ট উৎস ছিল কিছু। এছাড়া নতুন কেউ সদস্য হতে চাইলে চাঁদা দিতে হতো। বিয়েতেও যেমন কনের মহল্লার পঞ্চায়েত বরের কাছ থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা নজরানা নিতো। পঞ্চায়েতের ঘর 'বাংলা' নামে পরিচিত ছিল। বাংলায় সকালে মক্তব বসতো আর রাতের বেলা তা হয়ে উঠত মহল্লা ক্লাব। সাধারণত পঞ্চায়েত ফান্ডের কোষাধ্যক্ষ হতেন পঞ্চায়েত সর্দার। পানদান, আতরদান, হুক্কা ইত্যাদিও পঞ্চায়েতের স্থাবর সম্পত্তি গণ্য হতো। ধারণা করা হয় ঢাকার পঞ্চায়েত ব্যবস্থা লোপ পাচ্ছিল চল্লিশ দশক থেকেই।
আগের দিনের কলতাবাজার পঞ্চায়েত
১৫০ বছরের ইতিহাস আছে কলতাবাজার পঞ্চায়েতের। হাজী আব্দুল মজিদ লেন, নাসির উদ্দিন সরদার লেন, কাজী আব্দুর রউফ রোড, কুঞ্জবাবু লেন, রোকনপুর প্রথম ও তৃতীয় লেন নিয়ে পঞ্চায়েত এলাকা। হাজী আব্দুল মজিদ পরিচিত ছিলেন মজিদ ওস্তাগার নামে। তিনি ঠিকাদারি ব্যবসা করতেন, কার্জন হলসহ ঢাকার অনেক প্রাচীন ভবন তার ঠিকাদারিতে নির্মিত হয়। পঞ্চায়েতবাসীদের দাফন করার জন্য তিনি ও গোলাম রহমান সরদার টিকাটুলি কবরস্থানের জায়গাটি দান করেন। তিনি মৃত্যুবরণ করেন ১৯৩৮ সালে। তার ছিল দুই ছেলে ও এক মেয়ে। মন্নাফ সরদার ছিলেন তার বড় ছেলে। তিনি ছিলেন তখনকার সময়ের একজন প্রথম শ্রেণীর ঠিকাদার। বর্তমান বঙ্গভবনের ঠিকাদারও তিনি। তিনি চারবার ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনার নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার সাক্ষী ও জবানবন্দির ভিত্তিতেই মূলত প্রমাণ হয়েছিল যে ভাওয়াল রাজা সন্ন্যাসী কুমার জীবিত আছেন। মন্নাফ সরদারের শ্বশুর নাসিরউদ্দিন সরদার ছিলেন উনিশ শতকের সরদার। তিনি মারা গিয়েছিলেন ১৯০৮ সালে। কলতাবাজার এলাকার পঞ্চায়েতবাসীদের দাফনের জন্য পাঁচ ভাই ঘাট লেনের কবরস্থানের জায়গাটি তিনিই দান করেছিলেন, তাকে মৃত্যুর পর সেখানেই দাফন করা হয়।
সিদ্দিক সরদারের জন্ম ১৮৮০ সালে। তিনি হজ্ব পালনকালে মদিনায় মারা যান ১৯৫৮ সালে। কলতাবাজারের প্রথম এন্ট্রান্স পাশ লোক তিনি, ১৮৯৭ সালে। ইংরেজী ভালো জানতেন বলে লর্ড কার্জন তাকে মাঝেমধ্যেই ডেকে পাঠাতেন।
ঢাকাই পঞ্চায়েতের আরো ইতিহাস
স্থানীয় সরকারের একটি ধরন বা ব্যবস্থা এই পঞ্চায়েত। ঢাকায় মুসলমান ও হিন্দু পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ছিল ভিন্ন। ঢাকা পঞ্চায়েতগুলোর তত্ত্বাবধায়ক খাজা আজম ১৯০৭ সালে 'দি পঞ্চায়েত সিস্টেম অব ঢাকা' নামে একটি বই লিখেছিলেন। ধারণা করা হয়, উনিশ শতকের মধ্যভাগে ঢাকায় এ ব্যবস্থা থাকলেও তা বুঝি সুসংহত ও শক্তিশালী ছিল না। নওয়াব পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকায় পঞ্চায়েত প্রথা সংহত হয়েছিল। খাজা আজমের মতে, ঢাকায় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু করেছিলেন আদি ধর্মান্তরিত ও বহিরাগত মুসলমানরা। সামাজিকভাবে নিজেদের রক্ষার জন্য এ ধরনের সংগঠনের তাদের দরকার ছিল। মুঘলরা যে এ ব্যবস্থা চালু করেনি তা খাজা আজমও লিখেছেন। ভারতের বাংলা, পাঞ্জাব, মহারাষ্ট্র বা দক্ষিণ ভারতে অবশ্য প্রাচীনকাল থেকেই পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু ছিল। পেশাভিত্তিক কিছু পঞ্চায়েত ঢাকার মুসলমানদের মধ্যেও আগে থেকেই চালু ছিল বিশেষ করে ভিস্তিদের। মুহররম মিছিলে ভিস্তিদের বিশেষ ভূমিকা ছিল, তাদের পঞ্চায়েত প্রধানকে বলা হতো নওয়াব ভিস্তি।
যাহোক প্রায় সব গবেষক একমত যে, ঢাকায় পঞ্চায়েত প্রথা শক্তিশালী হয়েছিল নওয়াবদের পৃষ্ঠপোষকতাতেই। খাজা আজমের তথ্য মতে, ১৯০৭ সালের দিকে ঢাকায় পঞ্চায়েতের সংখ্যা ছিল একশত তেত্রিশটি। পঞ্চায়েতের সর্দার গদি পেতেন বংশানুক্রমে। ঢাকার কয়েকজন উল্লেখযোগ্য পঞ্চায়েত সর্দার হলেন- আফিরুদ্দিন সরদার (কমলাপুর), ইলিয়াছ সরদার (রায়সাহেব বাজার), আহসানুল্লাহ সরদার (লোহারপুল) জুম্মন সরদার (রহমতগঞ্জ), মির্জা আব্দুল কাদের সরদার (ইসলামপুর), আব্দুল গনি সরদার (লালবাগ), খলিল সরদার (হাজারীবাগ), মাজেদ সরদার (নাজিরা বাজার) ও মাওলা বখশ সরদার (সূত্রাপুর-ফরাশগঞ্জ)। এদের মধ্যে মির্জা কাদের সরদার ছিলেন ঢাকার লায়ন সিনেমা হলের মালিক। লায়ন সিনেমা হলে ১৯৪১ সালে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা ফজলুল হককে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল।
পঞ্চায়েত এখন
পঞ্চাশের দশকেও কোথাও কোথাও পঞ্চায়েত প্রথা টিকে ছিল। তবে দেশ স্বাধীনের পরে এর অস্তিত্ব ছিল না বললে বুঝি বাড়িয়ে বলা হয় না। খাজে দেওয়ান প্রথম লেন পঞ্চায়েতের সদস্য কায়সার আহমেদ সোহাগ (জন্ম: ১৯৭৮ সাল) যেমন বলছিলেন, আগে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো ছিল না, দৌড় দিলেই পাওয়া যেত না আদালত, অনেক জায়গায় পুলিশ পৌঁছাতেও দেরী হতো তাই পঞ্চায়েত ছিল একটি কার্যকর ব্যবস্থা। দেশভাগের পরে পাকিস্তানে মুসলমানরাই সব, আগের নিরাপত্তা ব্যুহ গড়ে তোলার আর দরকার পড়ে নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে তো সময়টাই আলাদা হয়ে গেল। সবকিছুই হতে থাকল রাজনৈতিক। সামাজিক সংগঠন সেভাবে আর কার্যকর থাকার সুযোগ থাকল না। তারপর যোগাযোগ আর প্রযুক্তির উন্নতি আগের মূল্যবোধ টিকে থাকতে দিল না।
একটা ব্যাপার খেয়াল করবেন, পঞ্চায়েত কিন্তু স্থানীয়দের সংগঠন মানে আদি ঢাকাইয়াদের সংগঠন। বহিরাগত লোক পঞ্চায়েত সদস্য হতে পারত না। এখন তো সব মহল্লাতেই বাইরের (ঢাকার) লোক বেশি। আমাদের খাজে দেওয়ান মহল্লা পঞ্চায়েতের গোড়ার দিকের সর্দার ছিলেন গনি সর্দার। তার নামে রাস্তা আছে, কমিউনিটি সেন্টারও আছে। আমাদের স্থায়ী পঞ্চায়েত ভবনও আছে। জায়গাটি তারা বিবি নামের একজন দান করেছিলেন। এ জায়গায় একসময় কুঁড়ে ঘর ছিল, তারপর বেড়ার ঘর হয়, ১৯৬০ সালে পাকা ভবন হয়। এখন তো টাইলস বসানো এর গায়ে। কিন্তু পঞ্চায়েত তো আগের ভূমিকায় নেই। আমাদের পঞ্চায়েতে এখন টিকাদান কর্মসূচী হয়, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের জন্মদিন বা মৃত্যুদিবস পালিত হয়। বিচার হয় কিছু তবে তা খুব সীমিত। আমাদের পঞ্চায়েতের কবরস্থানও নেই। তবে আমাদের নতুন প্রজন্মের মধ্যে বয়স্কদের মানার চল এখনো আছে। আমরা পঞ্চায়েতে মুরুব্বিদের রাখতেই পছন্দ করি।'
খাজে দেওয়ান পঞ্চায়েত ভবনের রোয়াকে (বাইরে বাঁধানো সিমেন্টের বেঞ্চি) ছয়-সাতজন বসেছিলেন। উল্টোদিকের বাড়ির বাড়িওয়ালাও আরেকটি রোয়াক গড়ে দিয়েছেন। তাতেও বসেছিলেন দুইজন। মাঝখানে রাস্তা ৭-৮ ফুটের। বসন্তের বিকালে কথা হচ্ছিল এদিক থেকে ওদিক। আড্ডাবাজদের বয়স পঞ্চাশের বেশি সকলেরই। তারা উর্দু-বাংলা মেশানো ঢাকাইয়া ভাষায় কথা বলছিলেন রাশিয়া আর ইউক্রেনের যুদ্ধ নিয়ে। কিছু পরে আড্ডায় একটু বিরতি এলে একজনকে শুধাই, কেমন কাজ করে আপনাদের পঞ্চায়েত?
উত্তর: বলতে পারেন এটা আমাদের আরামঘর। মহল্লার বয়স্ক লোকদের মিলনকেন্দ্র। এখানে গল্প করি, ক্যারম বা দাবা খেলি ইত্যাদি।
ঐতিহ্য ধরে রেখেছে কলতাবাজার
আল মঈন মাদ্রাসার নীচে ছোট্ট একটা ঘর কলতাবাজার পঞ্চায়েতের। ১৯৯০ সাল থেকে ভবন গড়ার কাজ শুরু হয়েছিল। তবে নতুন করে পঞ্চায়েতের কাজ শুরু হতে ২০০১ সাল লেগে গিয়েছিল। এই ভবনে কমিউনিটি সেন্টারও আছে। বছরখানেক আগেও সাড়ে তিন হাজার টাকা ভাড়ায় পঞ্চায়েতবাসী বিয়েশাদী নাহয় সুন্নতে খাৎনার অনুষ্ঠান আয়োজন করত। এখন বিদ্যুতের দাম, পানির দাম এবং নানান কিছুর খরচ বেড়ে যাওয়ায় ভাড়া গুনতে হচ্ছে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। শাহ আলম বলছিলেন, 'আগে তো অনুষ্ঠানাদি রাত ১২টার মধ্যেই শেষ হতো, এখন তো সারা রাতই অনুষ্ঠান চলে। বাবুর্চি, পাহারাদার, ইলেকট্রিশিয়ানদেরও জেগে থাকতে হয়। তাই ভাড়া বেড়েছে কিছু তবে তুলনা করে দেখেন অন্যসব সেন্টারের তুলনায় ৭ ভাগের ১ ভাগ। পঞ্চায়েত সবসময় জনকল্যাণমূলক। যে কোনো কিছু করার আগে গরীব বা দুঃস্থদের কথাই আগে ভাবে।'
কলতাবাজার পঞ্চায়েতের দুটি কবরস্থান আছে, একটি পঞ্চায়েত বাড়ি আছে। তিনটি মসজিদ আর আল মঈন মাদ্রাসাও পরিচালনা করে পঞ্চায়েত। পঞ্চায়েত অফিসের তিনজন স্টাফ আছে, তাদের মধ্যে একজন গুরিদ মানে বার্তাবাহক। আগে ঢোল পিটিয়ে পঞ্চায়েতের খবর জানানো হতো, এখন উচু গলায় সে অনুষ্ঠানের দিনক্ষণ জানায়। কবরস্থানে পঞ্চায়েতের পাহারাদার আছে। পঞ্চায়েত বাড়িতে পাহারাদার, কেয়ারটেকার আছে। পঞ্চায়েতের নিজস্ব আয় আসে দোকানভাড়া, সদস্য চাঁদা আর অনুদান থেকে। পঞ্চায়েতের নিয়মিত স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রম আছে।
শাহ আলম বলছিলেন, 'আমরা দরিদ্র সদস্যদের বিয়েশাদীর ব্যবস্থাও করে দিই। প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৫০ জনের ওষুধ সরবরাহ করি। ২০০১ সালে প্রথম আমরা ২৬০টি পরিবারকে পুরো রমজান মাসের খোরাকি যোগান দিয়েছিলাম। তারপর থেকে প্রতি বছরই দেওয়া হচ্ছে। সংখ্যাটাও বছর বছর বাড়ছে। এবার ৩০ মার্চ দেওয়া হবে ১২০০ জনকে। এবছরে এ বাবদ খরচ হবে ষাট লাখ টাকার মতো। স্থায়ী সম্পদ থেকে আমাদের বার্ষিক আয় ২ লক্ষ টাকা। তবে আমাদের কিছু ডোনারও সহযোগিতা দেন।'
আপনারা দুঃস্থ পরিবার নির্বাচন করেন কিভাবে?
শাহ আলম: আমাদের অনেক ইয়ং ভলান্টিয়ার আছে। তারা তালিকা নিয়মিত আপডেট করে। তাছাড়া ডোনারদেরও অনুরোধ থাকে।
আপনাদের পঞ্চায়েতে রাজনৈতিক প্রভাব আছে?
আমরা পঞ্চায়েতকে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক রাখতে চাই। আমরা চাই, এটা এমন একটা জায়গা হোক যেটাকে সকলেই আপন মনে করবে। ২০০১ সাল থেকে আমরা এমনভাবেই চলছি। আমরা আমাদের আয়-ব্যয় হিসাব সবার সামনে তুলে ধরি। ২০০৮ সালে যেমন একটা পুস্তিকা প্রকাশ করে বিগত সব বছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব দিয়েছি। এবারও ৩০ মার্চ তেমনটাই করার ইচ্ছা।
আপনাদের এখানে বিচার-আচার হয়?
হা হয়। অনেকেই মামলা মোকদ্দমা করতে চায় না। চায় মুরুব্বিদের দিয়েই একটা ফায়সালা করিয়ে নিতে। সাধারণত জমি জমা বিষয়ক বিচার আচারই হয় এখানে। কিছু তালাকের বিচার হয়েছে। সাধারণ ঝগড়া ফ্যাসাদও মেটানো হয়।
কেউ যদি আপনাদের ফায়সালা অমান্য করে তবে কি ব্যবস্থা?
বড় কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ এখন আর নেই। তবে একটা ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আমাদের হাতে আছে তা হলো কবরস্থানে তার অধিকার আমরা বাতিল বা স্থগিত করতে পারি। তবে সাধারণত ফায়সালা কেউ অমান্য করে না। প্রায় ৭ হাজার মানুষ আমাদের এই পঞ্চায়েতের আওতায় আছে। সাধারণত স্থানীয়রাই পঞ্চায়েতের সদস্য হতে পারে।
আপনাদের সাংগঠনিক কাঠামো কেমন?
সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, কোষাধ্যক্ষ এবং সদস্য– সবমিলিয়ে ১১ জনের কমিটি।
ঢাকায় এখন কি পঞ্চায়েত আছে?
আমাদের দেখে আরো কিছু মহল্লায় পঞ্চায়েত সক্রিয় হয়েছে। সম্ভবত মালিটোলা, বংশাল, খাজে দেওয়ান আর নদীর ওই পাড়েও কয়েকটি পঞ্চায়েত আছে।
আগামী দিন কেমন যাবে মনে করেন?
সময় দ্রুত দৌড়াচ্ছে এখন। আগের মতো ছোট বড়-র হিসাব নেই আর। এখন সবেতেই অনেক অপশন পাবেন। আপনার এখানে থাকতে ভালো লাগছে না তো ওখানে যেতে পারবেন, এই কাজ ভালো লাগছে না তো আরেকটি কাজ করতে পারবেন। এতে একটাই বড় ঘটনা ঘটছে- সমাজের বাঁধুনি আলগা হচ্ছে। যদি তা দিয়েও মানুষ ভালো থাকে তো আমরা বেধে রাখব কেন?
এখনকার একটি দাওয়াতপত্র
কলতাবাজার পঞ্চায়েতের ২২ তম রমজানের নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী বিতরণ ২০২২ এর দাওয়াতপত্র নিম্নরূপ:
সুধী
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।
পবিত্র মাহে রমজান আমাদের মাঝে আগত। প্রতিবারের মতো কলতাবাজার পঞ্চায়েত কমিটি আগামী ৩০ মার্চ, ২০২২ বুধবার, বাদ এশা বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে এলাকার দুঃস্থ ও অসহায় পরিবারের মাঝে পবিত্র রমজান মাসের নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী বিতরণ করবে।
উক্ত অনুষ্ঠানে আপনার উপস্থিতি আমাদেরকে আরো অনুপ্রাণিত করবে।
তখনকার দস্তারবন্দি অনুষ্ঠান
শ্যামবাজার থেকে হাতের বাঁ দিকে একটা রাস্তা গেছে নাম মোহিনী মোহন দাস লেন। এর ২৪ নম্বর বাড়িটি মওলা বখ্শ সরদার মেমোরিয়াল ট্রাস্ট। ঢাকার নামী সরদারদের একজন ছিলেন মওলা বখ্শ। সূত্রাপুরের ওয়াল্টার রোডে ১৯০৯ সালে তার জন্ম। ১৯৪৪ সালে ঢাকার নবাব মওলা বখ্শকে সরদার নিযুক্ত করেন। তার স্মরণেই ছেলে আজিম বখ্শ গড়ে তুলেছেন মেমোরিয়াল ট্রাস্ট। আজিম বখশ 'ঢাকার বাইশ পঞ্চায়েত' নামে একটি বইও সম্পাদনা করেছেন। ট্রাস্টে আছে ঢাকা কেন্দ্র ও একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার। ঢাকা বিষয়ক অধ্যয়নের এক অনন্য জায়গা এটি। গ্রন্থাগারের সাড়ে ছয় হাজার গ্রন্থের অর্ধেকই ঢাকা বিষয়ক। এখানে আছে ঢাকা সংগ্রহশালাও। পঞ্চায়েত সর্দারদের আলাদা গ্যালারি আছে। সেখানে আসবাব, জামা-কাপড়, রেকর্ড প্লেয়ার, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার বেতারযন্ত্র, পুরোনো মানচিত্র ইত্যাদি আছে। গ্যালারির কাচের দেয়ালে ১৯৪৮ সালের একটি দস্তারবন্দি অনুষ্ঠানের দাওয়াতপত্র দেখলাম। পড়তে থাকলাম:
আসসালামু আলাইকুম
আগামী ২রা মে ১৯৪৮ ইং রোজ রবিবার বিকাল ৫ ঘটিকায় হোসেনী দালান নহবতখানার সামনের ময়দানে উক্ত মহল্লার নিবাসী জনাব মান্নু বেপারীর পুত্র পেয়ারু মিয়ার সর্দারির ও জনাব মৃত কানু সর্দারের পুত্র মো. নাজির মিয়ার নায়েব সর্দারির দস্তারবন্দি হইবে। অনুরোধ মেহেরবানী করিয়া উক্ত মজলিসে তাশরিফ আনিয়া সরফরাজ করিবেন।
ইতি
ইং ২৬.০৪.৪৮
প্রেসিডেন্ট খাজা নবাব হাবিবুল্লাহ নবাব বাহাদুর