তদারকির অভাবে এগোতে পারছে না সম্ভাবনাময় পিভিসি পাইপ ক্লাস্টার
মাত্র দুই দশকেই শ্রমিক থেকে পিভিসি পাইপ কারখানার মালিক হলেন চাঁদপুরের নাসির উদ্দিন (৫০)। ২০০২ সালে সামান্য কিছু টাকা ও মাত্র একজন শ্রমিক নিয়ে কারখানা শুরু করা নাসির উদ্দিনের কারখানায় বর্তমানে বাষির্ক টার্নওভার চার-পাঁচ কোটি টাকা, ইতোমধ্যে নারায়ণগঞ্জে এক কোটি টাকার জমি কিনেছেন, কারখানায়ও প্রায় এক কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। বর্তমানে নাসির উদ্দিনের কারখানায় ২০-২৫ হাজার টাকা বেতনে ২০ জন শ্রমিক কাজ করেন।
তবে নাসির উদ্দিনের এই সাফল্যের যাত্রাটা এতো মসৃণ ছিল না। নাসির উদ্দিন দাখিল (এসএসসি সমমান) পাস করে ১৯৯৬ সালে ঢাকা আলিয়া মাদরাসায় একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হন। কিন্ত দারিদ্রতার কারণে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেলে বাধ্য হয়ে পরিবারের হাল ধরতে পুরান ঢাকার বংশালের একটি পিভিসি পাইপ কারখানায় সামান্য বেতনে শ্রমিক হিসেবে কাজ নেন।
'নুসরাত পলিমার' কারখানার মালিক নাসির উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমি নন-ব্র্যান্ড পিভিসি পাইপ তৈরি করি। বহু পরিশ্রম-চেষ্টার বিনিময়ে শ্রমিক থেকে কারিগর, কারিগর থেকে আজকে কারখানার মালিক হয়েছি। পাইপ তৈরির কোন প্রশিক্ষণ, প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা পাইনি, সবকিছু চলছে আমার অভিজ্ঞতা থেকেই। যার ফলে তুলনামূলকভাবে আমাদের পণ্যগুলোও একটু কম কোয়ালিটি সম্পন্ন হয়, দামও ব্র্যান্ডের পণ্য থেকে কম। আর আমাদের ক্রেতারাও সাধারণত নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ।"
নাসির উদ্দিনের মতো আরেক সফল উদ্যোক্তা সিদ্দিক বাজারের পিভিসি পাইপ ব্যবসায়ী মুজিবুর রহমান (৫৫)। তিনিও মাত্র ৩ জন শ্রমিক আর কয়েক লাখ টাকা নিয়ে এই প্লাস্টিকের পাইপ বানানোর ব্যবসা শুরু করেন। মাত্র ১৫ বছরে মুজিবুর রহমানের এখন বার্ষিক টার্নওভার ৪-৬ কোটি টাকা; কারখানায় বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ইত্যাদির সম্পদ আছে প্রায় দেড় কোটি টাকার।
তিনিও কারখানার আয় দিয়ে নারায়ণগঞ্জে ১ কোটি টাকার জমি কিনেছে, গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরে ৫০ লাখ টাকা খরচ করে ভবন নির্মাণ করেছেন।
ফাতেমা পাইপ এজেন্সির মালিক মুজিবুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "আমরা নন-ব্র্যান্ড প্লাস্টিক পাইপ কোম্পানিগুলো মূলত বড় বড় ব্র্যান্ড কোম্পানির ওয়েস্টেজ পাইপ রিসাইকেল করে পাইপ বানাই। সারাদেশের হাজার হাজার টন পরিবেশ দূষণকারী প্লাস্টিক গুলিয়ে আমরা আবার নতুন পাইপ বানাই।"
তিনি আরও বলেন, "এখন পর্যন্ত এখানকার নন-ব্র্যান্ড কোম্পানিগুলো সরকারের কোন ধরণের সহযোগিতা ছাড়াই স্বতঃফূর্তভাবে গড়ে উঠেছে, এমনি করোনাকালেও কোন আর্থিক সহযোগিতা পাইনি।"
এই গল্প শুধু নাসির উদ্দিন ও মুজিবুর রহমানেরই নয়, এখানকার বেশিরভাগ কারখানার মালিকই শ্রমিক থেকে কারিগর, কারিগর থেকে মালিকে পরিণত হয়েছেন বিগত ২০-২৫ বছরের মধ্যে।
জানা যায়, সেচ এবং পয়োঃনিষ্কাশনের কাজে জিআই পাইপের পরিবর্তে পিভিসি পাইপের ব্যবহার বেড়েই চলছে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন জায়গায় পিভিসি পাইপের ব্যবসাটি প্রসারিত হলেও মূলত ৮০'র দশকের শেষের দিকে পুরান ঢাকার বংশালের কিছু উদ্যোক্তা এ ব্যবসাটি শুরু করেন।
বাংলাদেশ পিভিসি পাইপ প্রস্ততকারক সমিতির তথ্যমতে, ঢাকার ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, চিটাগাং রোড, রায়েরবাগ, কামরাঙ্গীরচর, বংশাল, ইংলিশ রোড, নাজিরাবাজার, সিদ্দিকবাজার এলাকায় বর্তমানে প্রায় ৭০-৮০টি নন-ব্র্যান্ড পিভিসি পাইপ কারখানা গড়ে উঠেছে। যেসব কোম্পানির আর্থিক অবস্থা ভালো সেগুলোর মূল কারখানা নারায়ণগঞ্জে শিফট করে পাইপের গোডাউন রেখেছে পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়। তাদের অনুসরণ করেই যেন সারাদেশে কম করে হলেও ২০০ এর অধিক কারখানা গড়ে উঠেছে। ক্লাস্টারটিতে ১৫-২০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে যাদের প্রায় সবাই পুরুষ। ক্লাস্টারটির মোট বার্ষিক টার্নওভার ১৫০ কোটি টাকার অধিক।
পণ্য উৎপাদনের জন্য কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে পিভিসি রেজিন, ক্যালসিয়াম, রং ইত্যাদি। এসব কাঁচামাল বংশাল এবং পুরাতন ঢাকার আশেপাশের এলাকা থেকে সংগ্রহ করা হয়। এগুলো মূলত মূলত চীন এবং কোরিয়া থেকে আমদানিকৃত। দোকান আশেপাশের এলাকায় হওয়ায় সহজেই কাঁচামাল ক্রয় এবং পরিবহন করা যায়।
কাঁচামালের সহজলভ্যতা, পাইকারি বাজারের নৈকট্য, শ্রমিকের সহজলভ্যতার কারণে ক্লাস্টারটির রপ্তানিমুখী বিকাশের সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু দক্ষ প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব, অর্থায়নের অভাব, কারখানার জন্য নির্দিষ্ট জমি না থাকা, অনুন্নত প্রযুক্তি এবং অনুন্নত মেশিনের কারণে এবং শীর্ষ করপোরেটদের প্রযুক্তিনির্ভর বিনিয়োগ ও আগ্রাসী বিপণনের কারণে প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজারে আগাতে পারছে না বলে মনে করছেন এখানকার প্রস্তুতকারকরা।
এ ব্যাপারে বাংলাাদেশ পিভিসি পাইপ প্রস্তুতকারক সমিতির সভাপতি আবুল খায়ের বলেন, "আমরা দীর্ঘদিন থেকে সরকারের কাছে আমাদের জন্য বিসিকের জমিতে প্লটের দাবি জানিয়ে এসেছি, কিন্তু এখনো তেমন সাড়া পাইনি। এছাড়াও আমরা আমাদের ভ্যাট ১৫% থেকে কমিয়ে ৩% করার দাবি করে আসছি।"
এছাড়াও উন্নত বিশ্ব থেকে কিছু অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি এবং মালিক-শ্রমিক-কারিগরদের জন্য সরকার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলে এই ক্লাস্টারটি অনেক বেশি মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত ও কোয়ালিটি পণ্য তৈরি করে বিদেশেও রপ্তানি করতে পারবে বলে জানান আবুল খায়ের।
ক্লাস্টারটির প্রায় সকল কারখানার মালিকানার ধরণ প্রধানত এক মালিকানাধীন। ক্লাস্টারটির যেসকল উদ্যোক্তার নিজস্ব দোকান/শো-রুম আছে, তারা নিজেদের দোকানে পিভিসি পাইপ বিক্রয় করেন। অন্য উদ্যোক্তারা আশেপাশের বাজারের বিভিন্ন দোকানে পাইপ বিক্রয় করেন।
কারখানার মালিকদের থেকে পাইপ কিনে সিদ্দিক বাজারে বিক্রি করেন জাহিদুর রহমান। তিনি টিবিএসকে বলেন, "কম টাকার মধ্যে এখানকার উৎপাদিত পণ্যের গুনগত মান অনেক ভাল। স্থানীয় বাজারে চাহিদা রয়েছে। কিন্তু বড় বড় ব্র্যান্ডের পাইপ কোম্পানিগুলোর প্রযুক্তিনির্ভর বিনিয়োগ,বিজ্ঞাপন ও আগ্রাসী বিপণনের কারণে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে থাকছে ছোট কারখানার মালিকরা।"
তিনি আরও বলেন, "আগে দেশে পাইপ তৈরি হতো ম্যানুয়েল পদ্ধতিতে, বর্তমানে শীর্ষ কোম্পানিগুলোয় তা স্বয়ংক্রিয় মেশিনে তৈরি হচ্ছে। এ মেশিন স্থাপন অধিক ব্যয়বহুল। বড় কোম্পানিগুলো কারখানায় গ্যাস ব্যবহার করে, যা সাধারণ বিদ্যুৎ খরচ থেকে অনেক কম। অন্যদিকে ছোট কোম্পানিগুলো দেশের বাজার থেকে আমদানি করা পাইপের মূল কাঁচামাল ও বিভিন্ন কেমিক্যাল ক্রয় করত। এর খরচ সরাসরি আমদানি করা কোম্পানি থেকে অনেক বেশি। এছাড়া বড় কোম্পানিগুলো বিজ্ঞাপনসহ বিপণন খাতেও প্রচুর ব্যয় করছে। যার ফলে বাজারে অসম প্রতিযোগিতায় পড়ছে ছোট কারখানাগুলো।"
এ ব্যাপারে এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মোঃ মুফিজুর রহমান বলেন, "আমরা ২০১৭ সালের দিকে ক্লাস্টারটির একটি এসেসমেন্ট স্টাডি করেছি। সামনে কারিগর শ্রমিকদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
তিনি আরও জানান, উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়ার জন্য তারা ব্যাংকগুলোকে সুপারিশ করেছেন।