বিক্ষুব্ধ শ্রীলঙ্কানরা প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ চান
শ্রীলঙ্কায় খাদ্য ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে জনসাধারণের ক্ষোভর মুখে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর এবং মন্ত্রীপরিষদের সব সদস্য পদত্যাগ করেছেন। এমন পরিস্থিতিতে নতুন সরকারের অংশ হতে সব দলকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে । কিন্তু ক্রবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকটের প্রতিবাদে যারা রাস্তায় নেমেছেন, তারা কেবল প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ চাইছেন। গোতাবায়ে রাজাপাকসে পদত্যাগ না করা পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন বলে জানিয়েছেন।
দক্ষিণ এশিয়ার এই দ্বীপরাষ্ট্র জুড়ে প্রতিনিয়ত বাড়ছে ক্ষোভ এবং হতাশা। প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের দাবিতে হাজারও শ্রীলঙ্কান প্ল্যাকার্ড হাতে স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে এমনটিই জানানো হয়েছে।
বিক্ষুব্ধ জনতা একটি স্লোগানই দিচ্ছেন, "চলে যাও গোতা, চলে যাও।"
গোতা হলেন শ্রীলঙ্কার বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ে রাজাপাকসে। বর্তমানে দেশটি যেই চরম অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তার জন্য তিনি অনেকাংশেই দায়ী।
প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারী শ্রীলঙ্কান নাগরিক নাধিয়ে ওয়ানদুর্গালা বিবিসিকে বলেন, "তাকে (প্রেসিডেন্ট) যেতে হবে, সে আমাদের কাছ থেকে সবকিছু কেড়ে নিয়েছে।" দেশব্যাপী জারিকৃত কারফিউ অমান্য করে রোববার স্বামী ও দুই মেয়েকে নিয়ে বিক্ষোভে অংশ নেন নাধিয়ে।
প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের দাবিতে হাতে তৈরি একটি পোস্টার নিয়ে বিক্ষোভে যোগ দেন তিনি। এ সময় নিজের দুর্দশা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি ব্যাখ্যা করেন, কীভাবে তার পরিবার একটি সচ্ছল জীবনযাপন থেকে দিনে দিনে এক অস্বস্তিকর জীবনযাপনের দিকে চলে যেতে লাগলেন। দিনে ১৭ ঘন্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎবিভ্রাট, রান্নার সময় চুলায় গ্যাস নেই, গাড়ির পেট্রোল নিতে দীর্ঘ লাইন... এ সবকিছুর জন্য দেশটির পরিবারতান্ত্রিক সরকারকেই দায়ী করছেন শ্রীলঙ্কার সাধারণ নাগরিক।
নাদিয়ে বলেন, "এমনকি হাসপাতালের ওষুধ ফুরিয়ে গেছে, স্কুলে পরীক্ষার কাগজ ফুরিয়ে গেছে, কিন্তু রাজনীতিবিদরা প্রতিদিনই বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছেন।"
"গ্যাস বা কেরোসিনের জন্য তাদেরকে কখনোই দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে", যোগ করেন তিনি।
নাধিয়ে কোনো বিক্ষোভকর্মী নন কিংবা কোনো অধিকার আদায়কারী সংগঠনের সঙ্গেও জড়িত নন। তিনি শহরের ধর্মযাজকদের জন্য কাজ করেন এবং রাজনীতি থেকে দূরে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কিন্তু সরকারবিরোধী বর্তমান এই পরিস্থিতি তার মতো হাজারও ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণি, পেশা, বিশ্বাস ও বয়সের মানুষকে এক করেছে। তাদের চাওয়া একটাই, প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ।
শ্রীলঙ্কায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ায়, সরকার জ্বালানি ও এর মতো প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের আমদানির জন্য অর্থ প্রদান করতে পারেনি। এর পাশাপাশি মহামারিজনিত বিধিনিষেধের কারণে দেশের পর্যটন শিল্পেরও ব্যপক ক্ষতি হয়েছে। তবে অনেকেই এ সবকিছুর সঙ্গে প্রেসিডেন্টের অব্যবস্থাপনাকেই চলমান সংকটের জন্য দায়ী করছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে নির্বাচিত হওয়ার পর তার প্রবর্তিত নীতিগুলোর কারণেই সংকট আরও বেড়েছে। ট্যাক্স কমানো, আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে সাহায্য নিতে অনিহা ইত্যাদি নীতির সমালোচনা করছেন তারা।
যদিও বর্তমান পরিস্থিতির জন্য পূর্ববর্তী সরকার ও প্রশাসনকে দায়ী করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট, তবে নাধিয়ের মেয়ে অঞ্জলির মতো অনেকেই বলেছেন, অবিলম্বে প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ করার এবং বর্তমান পরিস্থিতির সম্পূর্ণ দায় স্বীকার করার সময় এসেছে।
আর এই ক্ষোভ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই আশঙ্কা করছেন, রাজাপকসে সরকার সরকারবিরোধী যেকোনো সমালোচনা ও প্রতিরোধ শক্ত হাতে দমনের চেষ্টা করছে। লোক জমায়েত বন্ধ করতে রোববারের কারফিউ ছিল সরকারের দমননীতির একটি পদক্ষেপ মাত্র। এ সময় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সেইসঙ্গে প্রেসিডেন্টের বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, কর্তৃপক্ষের লিখিত অনুমতি ছাড়া 'জনসাধারণের কেউ রাস্তায়, পার্কে, ট্রেনে বা সমুদ্রের তীরে' জমায়েত হতে পারবে না।
নাধিয়ে এবং অঞ্জলি এমন কয়েকশ সাধারণ মানুষদের মধ্যে ছিলেন যারা প্রেসিডেন্টের আদেশ অমান্য করে বিক্ষোভে অংশ নিতে রাস্তায় নেমে আসেন।
অঞ্জলির ভাষায়, "আমি আজ বেরিয়ে এসেছি, কারণ আমার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এই মুহূর্তে আমাদের হারানোর কিছু নেই। কেনো তারা এই কারফিউ জারি করেছে? এটি কি আমাদের রক্ষা করার জন্য? এর কোনো মানে হয় না।"
রোববারের বিক্ষোভে অংশ নেওয়া বিরোধী দলীয় নেতা সজিথ প্রেমাদাস বিবিসিকে বলেন, "আমি এই সব পদক্ষেপকে স্বৈরাচারী, কঠোর এবং বর্বর বলবো।"
প্রেমাদাস এবং তার দলের অন্যান্য সদস্যরা কলম্বোর স্বাধীনতা চত্বরে প্রবেশের সময় পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে তাদের থামিয়ে দেয়। সংবিধানে মানুষের বিক্ষোভের অধিকারের কথা স্পষ্ট উল্লেখ আছে জানিয়ে সজিথ প্রেমাদাস বলেন, "দেশের সর্বোচ্চ আইনে জনগণের তাদের মতামত প্রকাশ এবং শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের অধিকার দেওয়া হয়েছে। এই অধিকার কোনোভাবেই লঙ্ঘন করা যাবে না।"
প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ে রাজাপাকসে এবং তার ভাই বড় ভাই প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের বিরুদ্ধে মত প্রকাশের স্বাধীনতা রোধ করার অভিযোগ এই প্রথম নয়। ২০১৯ সালের নির্বাচনে জয়লাভের আগে থেকেই দুই ভাইদের বিরুদ্ধে এ ধরনের আরও অভিযোগ রয়েছে।
মাহিন্দা রাজাপাকসে এর আগে দুইবার শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। আর গোতাবায়ে রাজাপাকসে তখন ছিলেন দেশের প্রতিরক্ষা সচিব। এ সময় তার বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে, যার পরিপ্রেক্ষিতে শ্রীলঙ্কায় প্রায় গৃহযুদ্ধ লাগতে বসেছিল।
এছাড়াও, দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে কঠোর পন্থায় ভিন্নমত দমনের অভিযোগও রয়েছে।
বৃহস্পতিবারের বিক্ষোভের পরপরই শ্রীলঙ্কায় জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। নিরাপত্তা বাহিনীকে দেওয়া হয় গ্রেপ্তার ও আটকের ব্যাপক ক্ষমতা। প্রদেশের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কারফিউ লঙ্ঘনের জন্য শনিবার থেকে রোববার পর্যন্ত রাতারাতি ৬০০ জনেরও বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষের দাবি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতেই এই পদক্ষেপ নিতে হয়েছে সরকারকে।
এদিকে লন্ডনভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো বলছে, গ্রেপ্তারকৃতদের অনেককেই হেফাজতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
এরইমধ্যে সোমবার শ্রীলঙ্কার ক্ষমতাসীন দলের ২৬ মন্ত্রীর পদত্যাগের খবর আসে। অর্থনৈতিক সংকট ও জনরোষের মুখে পড়ে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায় রাজাপাকসে সরকার। এমন পরিস্থিতিতে অবশেষে মঙ্গলবার (৫ এপ্রিল) রাতে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ে রাজাপাকসে। একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে দেশের সব বিরোধী দলের প্রতি আহ্বানও জানান তিনি। তবে তার এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন বিরোধীরা। চরম সংকটের মুখে ক্ষমতাসীন দলের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করেছেন অনেক সদস্য। জোটের শরিক দল অনেক আগেই হাত ছেড়েছে সরকারের। সবকিছু মিলিয়ে ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি।
- সূত্র: বিবিসি