টিপ পরার সাংস্কৃতিক উৎকর্ষ মূল্যায়ন, নাকি অন্যায়ের প্রতিকার: কোনটি বেশি প্রয়োজনীয়?
সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকার তেজগাঁও কলেজের এক শিক্ষক, তাঁর কপালে টিপ পরা নিয়ে একজন পুলিশ কনস্টেবলের দ্বারা লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। সংবাদ মাধ্যমে জানতে পারি, হেনস্তাকারীকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশে চলমান বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে সাময়িকভাবে বরখাস্ত হওয়াকে খুব বেশি গুরুতর কোনো শাস্তি হিসেবে গণ্য করা হয় না, বরং প্রতিবাদকে সাময়িকভাবে স্তিমিত করার জন্য এটাকে একটা 'স্ট্র্যাটেজি' হিসাবে দেখা হয়।
যাই হোক, সমস্যা সেখানে নয়। সমস্যা অন্য জায়গায়। এই ঘটনার জন্য আমরা প্রথমত কাকে দায়ী করব? স্বাভাবিকভাবেই সেই পুলিশ কনস্টেবলকে। কী কারণে বিচার চাইব ? সম্ভাব্য উত্তর- একজন নারী তথা একজন নাগরিককে হেনস্তা করার জন্য এবং সঙ্গতভাবে তাই। হেনস্থা হওয়া যেন একটি সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে এদেশে। প্রতিনিয়ত এহেন পরিস্থিতির শিকার- শত শত নারী, পুরুষ, তৃতীয় লিঙ্গ নির্বিশেষে বাংলাদেশের আপামর নাগরিকেরা। যেহেতু আমাদের সমাজ একটি শ্রেণি-বিভক্ত সমাজ, সেহেতু প্রতিবাদ, সহমর্মিতা এবং ঐক্যেরও এক ধরনের শ্রেণি চরিত্র আছে। আমার সামাজিক অবস্থান যেমন আমার ওপর করা কোনো অন্যায়কে ভীষণভাবে একটি জাতীয় চরিত্র দিতে পারে; ঠিক একইভাবে আমার সামাজিক অবস্থানের কারণেই হয়তো আমার সাথে হয়ে যাওয়া কোনো অন্যায় সাধারণ চিত্তে একটি স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে পরিগণিত হতে পারে।
ফিরে আসি আগের আলাপে। লতা সমাদ্দারের সাথে যে অন্যায় হয়েছে সেটি পীড়নমূলক এবং তার বিচারের দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলিতে যে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে, তা খুবই প্রেরণাদায়ক। বাংলাদেশের মানুষ অন্যায়ের প্রতিবাদ করছে, নাগরিক এবং মানবিক অধিকার আদায়ের দাবি জানাচ্ছে- এটি খুবই আশার কথা।
এই প্রতিবাদ ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার একটি আন্দোলন। সঙ্গতভাবে তাই হওয়া উচিত। কিন্তু, একদিকে এই প্রতিবাদ যেমন একটি হেনস্থা, লাঞ্ছনার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, ঠিক একইভাবে এই প্রতিবাদের কিছু ভাষা, অঙ্গসজ্জার একটি সাংস্কৃতিক চর্চাকে (এক্ষেত্রে কপালে টিপ দেয়া) এক ধরনের সার্বজনীন রূপ দেবার চেষ্টা করছে। যেকোনো সাংস্কৃতিক চর্চাকে যখন আপনি সার্বজনীন রূপ দেবার চেষ্টা করেন, তখনই আপনি প্রথমত ঘাত-প্রতিঘাত এবং গ্রহণ-বর্জনের মাধ্যমে, সময়ের সাপেক্ষে যে সংস্কৃতির রসায়ন তৈরি হয়- সেই সাংস্কৃতিক বিনির্মাণকে অস্বীকার করছেন। দ্বিতীয়ত, আপনি সংস্কৃতির একটি স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করে দিচ্ছেন, যার বাইরে গেলে কিংবা ব্যত্যয় ঘটলে তাকে সংস্কৃতিবিমুখ বলতে দ্বিধা করবেন না। এভাবেই তৈরি হয় সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের কিংবা সাংস্কৃতিক বৈষম্যের- আর একটি অপসংস্কৃতি।
পুলিশ কনস্টেবলের বিচার, হেনস্তা-সংস্কৃতির দমন, কিংবা বিচারহীনতার সংস্কৃতির পরিসমাপ্তির দাবিকে ছাড়িয়ে যখন তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ টিপ পরার সাংস্কৃতিক ইতিহাসকে এবং টিপ পরাকে বাঙালি সংস্কৃতির সার্বজনীন আবহমান চর্চা বলে চিহ্নিত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন- তখন কলেজ শিক্ষকের সাথে যে অন্যায় করা হয়েছে, সেখান থেকে আমাদের দৃষ্টি সরে গিয়ে একটি নতুন বিভেদমূলক বিতর্কের জন্ম হয়, যেটি কারোরই কাম্য নয়।
টিপ পরার সাথে ধর্মীয় সংযোগ আছে কি নেই, টিপ পরার সাথে হিন্দু ধর্মের জাত-পাতভেদের কোনও সম্পর্ক আছে কি নেই, মন্দিরে উৎসর্গীকৃত নারীদের চিহ্নিত করার জন্য টিপ দেওয়া হতো কি না, টিপ আধুনিকতার চিহ্ন বহন করে কি না ( "ইতিহাসের অলিগলি" বইয়ে জিয়াউল হক টিপকে "বাঙালি তথা- আধুনিক বাঙালি নারীর প্রাত্যহিক জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ" হিসেবে দেখেছেন)- বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে সেটি মূল বিবেচ্য বিষয় নয়। জিয়াউল হকের আধুনিকতা সম্পর্কে ধারণা বেশ সীমিত এবং গণ্ডিবদ্ধ মনে হল।
লতা সমাদ্দারকে "টিপ পরছোস কেন?"- বলাটা যেমন অন্যায়, একপ্রকার ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ এবং এক ধরনের লাঞ্ছনা, ঠিক একইভাবে কাউকে "হিজাব পরেছিস কেন?"- বলাটাও তেমনই আপত্তিকর, ব্যক্তি-স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ এবং লাঞ্ছনা।
কাউকে তার কোনো অঙ্গসজ্জা কিংবা শারীরিক অবয়বের জন্য হেনস্থা করা- সমানভাবে ব্যক্তি-স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ- হোক তা চুল, দাড়ি, ট্যাটু কিংবা হিজাব। ২০২২ সালে অস্কার অনুষ্ঠান চলাকালীন, উইল স্মিথের উপস্থাপক ক্রিস রককে চড় দেওয়া যেমন একটি লাঞ্ছনার নমুনা, ঠিক একইভাবে ক্রিস রক উইল স্মিথের স্ত্রীর শারীরিক সীমাবদ্ধতা নিয়ে যে আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন- সেটাও একধরনের হেনস্তা। দুটোই অপরাধ।
অন্যায়কে অন্যায় হিসেবে না দেখে, যখন ভুক্তভোগীর আচরণের সাংস্কৃতিক উৎকর্ষগত মূল্যায়ন শুরু করি আমরা, তখন সেটি নতুন সাংস্কৃতিক রাজনীতির জন্ম দেয় এবং নতুন বিভেদের জন্ম দেয়। সাংস্কৃতিক উৎকর্ষের বয়ান কিংবা নিচু বা লোকসংস্কৃতি বনাম উচ্চমার্গীয় সংস্কৃতির বিভেদ- দুটোই সাংস্কৃতিক রাজনীতির হাতিয়ার যেটি কেবল নতুন অন্যায়ের জন্ম দেয়।
শুধু অপরাধীর বিচার নয়, ভুক্তভোগীর মানসিক স্বাস্থ্যের যে ক্ষতি হয়েছে, সেটির দিকেও খেয়াল রাখতে হবে আমাদের, রাষ্ট্রের। হেনস্তাকারীর বিচার শুধু নয়, ভুক্তভোগীর পরবর্তী নিরাপত্তা দেবার দায়িত্বও রাষ্ট্রের। তাই সাংস্কৃতিক উৎকর্ষের বিতর্ক যেন, অন্যায়ের প্রতিকারের দাবিকে ছাড়িয়ে না যায়।
- লেখক: পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অফ নিউ সাউথ ওয়েলস, সিডনি