অন্যরকম এক পহেলা বৈশাখ
ভোরে রমনা বটমূলে ছায়ানটের আয়োজন শুরু হলেও শাহবাগ এলাকায় এবার বসেনি কোন পান্তা-ইলিশ খাওয়ার দোকান। দুপুর একটার পরেই গণপরিবহন চলাচল শুরু হয়ে গেছে রমনার আশেপাশের রোডে। দুপুরের পর নেই কোন গান পরিবেশন। এবার যেন অন্যরকম এক পহেলা বৈশাখ পালিত হচ্ছে, যার মিল পাওয়া যায় না করোনা পূর্ববর্তী আয়োজনের সঙ্গে।
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে প্রায় দুই বছর পর রাজধানীতে বর্ণিল আয়োজনে নববর্ষ-১৪২৯ উদ্যাপন করা হয়েছে। ভোর ৬টা ১৫ মিনিটে রমনা বটমূলে শুরু হয় ছায়ানটের আয়োজন। আর সকাল ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) সামনে থেকে বের হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা।
এ বছর পহেলা বৈশাখ রমজান মাসে হওয়ায় আয়োজনে জনসমাগম কিছুটা কম। আজিজ সুপার মার্কেট থেকে রমনা টেনিস কোর্ট এলাকা পর্যন্ত সকাল ৮টা থেকে ঐতিহ্যবাহী বৈশাখী বিভিন্ন পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছিল হকাররা। তবে এখানে তেমন ভিড় ছিল না। হস্তশিল্প, খেলনাসহ নানান জিনিসপত্র নিয়ে শাহবাগ এলাকায় হকাররা বসলেও তারা জানান বিক্রি তেমন হয় নি। বসে নি কোন খাবারের দোকান। অন্যবারে পান্তা ভাত, আর ইলিশ ভাজা বিক্রি হতো।
বাংলা নববর্ষ উদযাপন ও পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান দুপুরের মধ্যে শেষ করার নির্দেশনা দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। মঙ্গলবার রাজধানীর রমনা বটমূলে নববর্ষের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরিদর্শন শেষে ডিএমপি কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম জানান, 'এবার রমজানের মধ্যে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান হবে। তাই খাবারের কোনো দোকান খোলা থাকবে না।'
মোহম্মদ মিঠু 'পহেলা বৈশাখ' লেখা মাথায় বাঁধা গামছা বিক্রি করছিলেন। বেলা ১১টায়ও বিক্রি তেমন না হতে দেখে শেষ পর্যন্ত বলছিলেন 'কিনতে হবে না, মাথায় বেঁধে সেলফি তুলুন '। মিঠু জানান, এখন যা বিক্রি হচ্ছে তার তুলনায় করোনার আগে যে অনুষ্ঠান হয়েছে সেই সময় দ্বিগুণ বিক্রি হতো।
গত দুই বছর করোনার কারণে এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠান অনলাইনে আয়োজন করা হয়। এবার সরাসরি আসতে পেরে উৎফুল্ল অনেকে। খুব ভোরে এই আনন্দ উদযাপনে ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে বের হয়েছেন সর্বস্তরের মানুষ। পুরুষরা পাজামা-পাঞ্জাবি, নারীরা শাড়ি আর উজ্জ্বল পোশাকে শিশুরা রমনা বটমূলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিল। সকাল ১০টায় লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে রমনা পার্ক, শাহবাগ ও চারুকলা এলাকা। একটার পর থেকে লোকজন বাসায় চলে যেতে শুরু করে। তখন শাহবাগের রাস্তা দিয়ে গণপরিবহন চলাচল শুরু হয়ে যায়।
আরেক বিক্রেতা মনিরুল ইসলাম প্লাস্টিকের ফুলের মালা, টুপি, বাচ্চাদের খেলনা বিক্রি করতে বসেছিলেন শাহবাগ মোড় এলাকায়। তিনি বলেন, 'দুপুর একটার দিকেই রাস্তায় গাড়ি চলাচল শুরু হয়েছে। এর জন্যে আমাদের রাস্তা থেকে বিক্রি শেষ করে উঠে যেতে হয়েছে। কিন্তু আগে আমাদের সন্ধ্যা পর্যন্ত বসতে দিতো। মাত্র দেড় হাজার টাকার বিক্রি করেছি আজকে। করোনার আগে যে অনু্ষ্ঠান হতো তখন ২০ হাজারের বেশি বিক্রি হয়েছিল। এবার করোনার আগের অনুষ্ঠানের তুলনায় লোক এসেছে বিশভাগের এক ভাগ। আর লোক না আসলে কিনবে কারা।'
এবার রমনা বটমূল বাদে মাত্র এক জায়গায় গান পরিবেশন করতে দেখা যায়। 'ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠী' ' শিশুপার্ক এলাকায় গান পরিবেশন করে সকালে। অন্যবার বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বেশ কয়েক জায়গায় শিল্পীরা গান পরিবেশন করে থাকে।
বিজয় নাগ অভিজিত দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে এসেছেন রমনায়। তিনি বলেন, 'দীর্ঘদিন পর এই আয়োজন। তবে একটু মলিনতা আছে। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো এবার সেটা হচ্ছে না।'
ধানমন্ডি এলাকা থেকে পরিবারের সবাই মিলে এসেছেন মুনিরা খানমরা। তিনি বলেন, 'আগের চেয়ে এই আয়োজন কিছুটা ভিন্ন মনে হলো। করোনার আগে যখন আয়োজন হতো তখন আরও লোকজন আসতো। পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা মানুষে ভরা থাকতো। এবার রমজান তাই খাবারের দোকান বসে নি, রমজানে এটাতো আমাদের মেনে নিতে হবে।'
কলেজ পড়ুয়া তনুশ্রী রায় এবার ছায়ানটের আয়োজনে অংশ নিয়েছেন। তনুশ্রী রায় বলেন, 'আমার ইচ্ছে ছিল রমনা বটমূলে গান গাইবো সেই ইচ্ছে পূরণ হয়েছে। তবে অন্যবার ছায়ানটের আয়োজন শেষ হওয়ার পর পান্তা ইলিশ খেতাম সেটা এবার হয় নি। বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঘোরাও হলো না।'
ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক শিল্পী লাইসা আহমদ রমনা বটমূলের অনুষ্ঠান শেষে সকাল ৯টায় সাংবাদিকদের বলেন, 'আমরা দুই বছরের বেশি সময় করোনার কারণে গৃহবন্দি ছিলাম। আমরা অনলাইনে শুধু আয়োজন করেছি। এবার রমনায় এসে গান গাইতে পেরেছি, আয়োজন করতে পেরেছি এতে স্বস্তি এসেছে।'