‘ঢাকা কলেজ দোকানদার মারপিট আমাদের ঐতিহ্যের অংশ’!
সমসাময়িক কোন ঘটনা বেশ আলোচিত হলে সেটা নিয়ে কৌতুক বানানোর চেষ্টা চলে। যেমন-
প্রথম বন্ধু- দোস্ত কেমন আছিস? কোথায় আছিস?
দ্বিতীয় বন্ধু- আর বলিস না। দোযখে আছি।
প্রথম বন্ধু- জানি তো তোর বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া। কিন্তু ঢাকায় আসলে কই থাকস?
দ্বিতীয় বন্ধু- নিউমার্কেটের পাশে! এখনও সেখানেই আছি!
বাংলাদেশের সব জায়গা আমার প্রিয়। কৌতুক শুনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ানরা দয়া করে কিছু মনে করবেন না। তবে নিউমার্কেট যার আমলে তৈরি হয়েছিল তার নাম নূরুল আমিন। ভদ্রলোক একদা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। জন্মেছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শাহবাজপুরে, লেখাপড়া করেছিলেন ময়মনসিংহে।
নিউমার্কেট তৈরি হয়েছিল ১৯৫২ থেকে ১৯৫৪ সনের ভেতর। এখানে মার্কেট তৈরি নিয়ে তখনও গন্ডগোল হয়েছিল। নূরুল আমিন সাহেব সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন, ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানেই মৃত্যুবরণ করেন। সাধারণ মানুষ বলতো নিউমার্কেট আর হোটেল শাহবাগ (বর্তমানের বঙ্গবন্ধু মেডিকাল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়) তৈরি করা হয়েছিল নূরুল আমিনের পরিবারের সদস্যদের সুবিধার জন্য!
এখনও কেনাকাটার জন্য নিউমার্কেট সুবিধাজনক জায়গা কিনা (হাতিরপুলের ইস্টার্ন প্লাজার পরে পান্থপথের কাছে বসুন্ধরা এসে জেঁকে বসার পর) সেই বিষয়ে কোন জরিপ বা পরীক্ষা নিরিক্ষা হয় নি। তবে নামের কারণে নিউ মার্কেট যেমন পুরোনা হয় না, ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সাথে নিউমার্কেট বা আশে পাশের মার্কেটের ব্যবসায়ীদের দ্বন্দ্ব বা সংঘর্ষও পুরোনো হয় না।
সুতরাং সংঘর্ষ আবারো বাধতে পারে, থাকতে পারে রাস্তা বন্ধ, জ্যাম হতে পারে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। ভোগান্তি বেড়ে চরমে উঠতে পারে। রোগী মারা যেতে পারে, অ্যামবুলেন্স ভাংচুর হতে পারে, ছাত্র ও ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষের মধ্যে পরে মারা যেতে পারে নাহিদ (কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মী) ও মোরসালীনের (বিক্রয় কর্মী) মতো কেউ কেউ। ঐতিহ্যবাহী এই সংঘর্ষ থামবে না! বিশ্বাস হচ্ছে না?
স্বাধীনতার আগে আমার বাবা ও তার এক বন্ধু এসেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। ফেরার পথে নিউমার্কেটের সামনে ছোটখাটো একটা সংঘর্ষের ভেতর পড়লেন তারা। কোথা থেকে ছুটে এলো এক ঢিল,বাবার বন্ধুর মাথা ফাটলো! এই গল্প বহুবার শুনতে হয়েছে আমাকে ও আমার ভাই বোনদের!
মুক্তিযুদ্ধ গবেষক আফসান চৌধুরী 'ঢাকা কলেজ-দোকানদার মারপিট-জাতীয় ঐতিহ্যের অংশ' শিরোনামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন- 'আমি ৬৯ থেকে ৭২ সাল পর্যন্ত ঢাকা কলেজের ছাত্র ছিলাম। আমি শপথ করিয়া বলিতেছি যে আমাদের কালেও এইটা হইতো তবে ছোট আকারে। উদ্দেশ্য চাঁদাবাজি। আজকের দিনে এটা তো বড় আকারে হবেই কারণ সব কিছু বেড়েছে জিডিপি সহ। এটা আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য। একে ছোট করবেন না'!
আমরা তাই ঢাকা কলেজের ছাত্র ও নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীদের দ্বন্দ্ব সংঘর্ষকে ঐতিহ্য মেনে নিয়ে ছোট করছি না! আফসান চৌধুরী বলেছেন সেকালের ছোটখাট সংঘর্ষের কথা। ছোটখাট একটা ঘটনা নিয়েই এবারকার সংঘর্ষের সূত্রপাত।
১৮ এপ্রিল দিবাগত রাত ১২টায় নিউমার্কেটের ওয়েলকাম ও ক্যাপিটাল ফাস্টফুডের কর্মচারীদের মধ্যে বচসা হলে ঢাকা কলেজের কয়েকজন ছাত্রকে জানানো হয়। তারা এসে এটা নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ কথা কাটাকাটি শুরু করলে এক ফাস্টফুড দোকানের কর্মচারীরা ব্যবসায়ীদের খবর দেয়। এরপর মারামারি, ছুরিকাঘাত এবং ঐতিহ্যবাহী গুজব। ১৯ এপ্রিলের পুরোদিন আর ২০ এপ্রিল এর দিনেরবেলা নিউমার্কেট, ঢাকা কলেজ আর সাইন্স ল্যাবরেটরি এলাকা হয়ে যায় দোযখ বা একালের রণক্ষেত্র। এরপর দিনভর টেলিভিশনের খবর, টক শো আর পত্রিকার রিপোর্ট। যার সারমর্ম এমন-
এক. এই সংঘর্ষ আসলে চাঁদাবাজি আর আধিপত্য বিস্তারের প্লে অফ ম্যাচ। ব্যবসায়ী বনাম ছাত্র আর রেফারির ভুমিকায় আসা বিতর্কিত পুলিশ।
দুই, ব্যবসায়ীদের অভিযোগ -ঢাকা কলেজের ছাত্র পরিচয়ে এরা বই বা কাপড় কিনে টাকা কম দিতে চায়! কখনো কখনো টাকা না দিয়েই চলে যায়। খেয়ে দেয়ে বিল দেয় না! সিনেমা হলে টিকেট কাটে না।
তিন. ব্যবসায়ীদের মাঝে দ্বন্দ্ব হলে তারা আবার ছাত্রদের একটা অংশকে টানে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য। বহুবছর ধরে বিরোধী দলের ছাত্র সংঘটন রাস্তাঘাটে নেই। তাই সরকার দলীয় ছাত্রসংগঠনই ভরসা!
চার, ছাত্রদের অভিযোগ ছাত্র বুঝলেই নিউমার্কেট বা আশেপাশের মার্কেটগুলোর ব্যবসায়ীরা দাম বেশি চায়। নারী বা ছাত্রীদের কাছেও বেশি টাকা চায়,কটুক্তি করে। প্রতিবাদ করলে প্রথমে মারধর খেতে হয়।
পাঁচ. নিউমার্কেট থেকে নীলক্ষেত আর অন্যপাশে সাইন্স ল্যাবরেটরি। রাস্তার দু-পাশে ফুটপাত। এই ফুটপাতও ব্যবসা ও চাদঁবাজির উর্বরভূমি। পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক নেতা সেই সাথে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রনেতারাও আছেন এই উর্বর কাজের সাথে। ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের দোকান ভাড়া ও প্রতিদিন বা প্রতিমাসে চাঁদা দিতে হয়। যে ছাত্রদের সময় কাটানোর কথা ছিল পড়ালেখা,গবেষণা, খেলাধুলা কিংবা শিক্ষার আধুনিকীকরন নিয়ে, তারা এইসব বাদ দিয়ে সবসময় কী চাঁদাবাজির সাথে থাকতেই এখন বেশি পছন্দ করছে? সংঘর্ষের পর সাদা পতাকা উড়িয়ে যখন সন্ধির দিন চলছে তখন বন্ধ করা হয়েছে ঢাকা কলেজ। এই কলেজের অধ্যক্ষ বলেছেন-ব্যবসায়ীদের মনোভাব ও মনোবৃত্তির পরিবর্তন আবশ্যক। তাহলে কিছু কিছু ছাত্র ও পুলিশের চাঁদাবাজ হবার প্রবনতা থেকে তাদের রক্ষা করবে কারা?
ঢাকা কলেজ বন্ধ করে দেবার ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে বলেছেন-এই সরকার ব্যবসায়ী বান্ধব সরকার শিক্ষা বান্ধব নয়!
আমরা প্রথমেই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম জাতীয় ঐতিহ্যকে আমরা ছোট করবো না। তাই ঘটনার ভেতরে লুকিয়ে থাকা বড় কিছু বলে বিদায় নেই। দয়া করে এটা নিয়ে কেউ জল ঘোলা করবেন না। কারণ ঢাকা কলেজের ছাত্র আর নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষের ঘটনায় তিনটা মামলা হয়েছে। সেখানে বাইশ তেইশ জনের নাম থাকলেও অজ্ঞাত ১২০০ জনের কথাও উল্লেখ আছে। এটা মনে রাখা উচিত।
তিন বন্ধুর দেখা বহুদিন পর। একজন গবেষক, একজন পুলিশ কর্মকর্তা আর অন্যজন ঠিকাদার। তাদের কথোপকথনের সার সংক্ষেপ-
ঠিকাদার: দোস্ত তুই কী গবেষণা করিস? কিছুই তো জানি না।
গবেষক: নারে দোস্ত চাকরি করার জন্য করি। বলার মত কোন গবেষণা নেই।
ঠিকাদার: তোর চাকরিতে উপরি নেই?
গবেষক: আছে। তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ, উপাদান কেনা এসবের মাধ্যমে কিছু টাকা আসে। বিদেশ ভ্রমণ আছে।
ঠিকাদার: পুলিশ দোস্ত তোরে কিছু না জিগাই ! কী বলিস?
পুলিশ: তুই বড় বড় কথা বলিস না। তুই কী করিস?
ঠিকাদার: আমি চাকরির নামে ঘুষ বা ফাইল মামলার নামে পয়সা খাই না। ছাত্রকাল থেকেই চাঁদা তুলতাম। এখনও কোন না কোনভাবে সেটাই করি। ছাত্র রাজনীতি করার সময় ফার্স্টক্লাস ঠিকাদারি লাইসেন্স করেছি। যেখানে শক্তি দেখাতে পারি সেখানে টেন্ডারবাজি করি। নিজে কাজ না করলেও পাওয়া কাজ বেঁচে দেই। কখনো কখনো টেন্ডারের সময় ঘাপলা করি। আমাকে থামাতে 'মিউচুয়াল মানি' দিতে হয়। আমি সুখী!
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হোক কি রাজনীতির নামে হোক, যারা টাকা তোলে তাদের চাঁদাবাজ না বললে কেমন হয়? পৃথিবী বিখ্যাত এক মনিষীর বানী হচ্ছে-'মানি ইজ দ্য ভিজিবল গড'! অর্থাৎ টাকার মুখ দেখাটাই আসল। ভেবে নিন-টাকাই দেবতা আর ব্যাংকের চেয়ে বড় কোন উপসনালয় নেই। টাকা দেবতার কাছে থাকুন, সুখী হোন!
- লেখক: রম্য লেখক