ঢাকার হারানো পাখি, দৃশ্যমান পাখি
পাখির সংখ্যা এবং প্রজাতির সংখ্যা দুইই কয়েক শতাব্দী আগের ঢাকাতে আমরা আজ যা দেখতে পাই তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল। অতীতের ঢাকা ছিল আবাসস্থান, অফিস, দোকান আর রাস্তার চেয়ে জলা, বন, জঙ্গল, তৃণভূমির সমন্বয়ে গঠিত এক অপূর্ব ক্যানভাস। শহরের সাধারণ পাখি কাক, চিল, কবুতরের চেয়ে এই স্থানগুলোতে পানির পাখি, বাতাই, ডাহয়, সারস, মানিকজোড়, ঈগল, বাজ, শাহিন, প্যাঁচা, বক, বগাদের আধিক্য ছিল। মিরপুর, কুর্মিটোলা, পল্টন ও তেজগাঁওর জঙ্গল এবং সাভার ও টঙ্গির বন কয়েকশ জাতের বনের পাখির আবাস ছিল। কামারাঙ্গির চর, বেগুনবাড়ি এবং ধামরাইয়ের বাদা পানির পাখির জন্য বিখ্যাত ছিল।
শহর থেকে সামান্য দূরত্বে অবস্থিত বড় জলা যেমন বেলাই, শালদহ, লবণধলা, ঢোল সমুদ্র এবং আড়িয়াল বিল ছিল জলচর পাখির জন্য বিখ্যাত। বিশাল সব নদী দিয়ে ঘেরা শহরটার মধ্য দিয়ে মাকড়শার জালের মত ছড়িয়ে থাকা তাদের শাখা-প্রশাখা, অগণিত দীঘি আর ঝিলের সমন্বয়ে গঠিত পরিবেশ অনেক রকমের পাখি আসতো যা আজ আমরা কেবল অভয়ারণ্যে দেখতে পাই।
তের হারিয়ে যাওয়া সেই পাখিময় বিশ্বের সামান্য ছোঁয়া পাওয়া যায় RC Tytler-এর (১৮১৮-৭২) মত পক্ষীবিদ এবং FB Simson-এর মত শিকারিদের লেখাতে, যারা ১৮৬০ সালের দিকে ঢাকায় ছিলেন। এছাড়াও কাহিনীকার W.W. Hunter এবং সংগ্রাহক Magistrate Clayi-এর সুবাদেও ঢাকার পাখিকূল সম্পর্কে ভাল ধারণা পাওয়া যায়। তাদের সেই বর্ণনা অনেক পাখি অবশ্য কেবল ঢাকা নয়, সারা বাংলাদেশ থেকেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সাধারণ সরীসৃপ ও স্তন্যপায়ী প্রাণীদের তুলনায় পাখিরা মানুষের দখল করা, সম্পূর্ণ ঢেলে সাজানো ভূখণ্ডেও বেশী টিকে থাকতে সক্ষম। যার কারণে ঢাকার বাঘ, চিতাবাঘ, বুনো মহিষ, হাতি, কুমির, ঘড়িয়ালরা হারিয়ে গেলেও পাখিরা টিকে আছে এখনো। তবে স্থলচর এবং বিশালাকৃতির মাংসল পাখিরাও শেষ পর্যন্ত সরে যেতে বাধ্য হয়েছে বা হারিয়ে গেছে।
আমরা এখানে সেই পাখিদের নিয়েই আলোচনা করব যারা গত কয়েক শতক ধরে ঢাকার মানুষদের কাছে সুপরিচিত ছিল কিন্তু বর্তমানে হারিয়ে গেছে বা অতি অল্প সংখ্যায় টিকে আছে।
দেশী ময়ূর ও লাল বনমুরগি
ঢাকার প্রান্তসীমার জঙ্গলে ও কাছের শালবনে ময়ূরেরা (Indian Peafowl) থাকত। উনিশ শতকের শেষ পর্যন্ত এই বিশাল, অপূর্ব সুন্দর পাখিদের সংখ্যা এতই বেশী ছিল যে বনে তো বটেই, এমনকি শহরের কিনারেও দেখা যেত। ঢাকার একজন চিকিৎসক জেমস টেইলর ১৮৪০ সালে লিখেছিলেন ময়ূরের প্রাচুর্যের কথা। বর্ষাকালে পুরুষ ময়ূর লেজের বিশাল পালকগুলো ঝালরের মত মেলে ধরে এবং উচ্চস্বরে কেকার মাধ্যমে শুধুমাত্র তাদের যারা যারা কদর করত তাদেরই নয়, বরং অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করত। বাঘ, চিতা বাঘ ও অন্যান্য বুনো বিড়ালের খাবারের তালিকার ময়ূর বিশেষ অংশ দখল করে ছিল। বনভূমিতে এলোমেলো পড়ে থাকা বর্ণীল, লম্বা পালকের অস্তিত্ব যে কেবলমাত্র তাদের প্রজনন ঋতু শেষে পালক ঝেড়ে ফেলার ইঙ্গিত ডি তা নয়, সেই সাথে হয়ত কোন দুর্ভাগা পুরুষ ময়ূরের জীবনের শেষ মুহূর্তের কথাও জানাতো। পরবর্তী একশ বছরে অসাধারণ পাখিটি শহরের পার্শ্ববর্তী বন থেকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যায়। বাংলাদেশের শেষ দেশী ময়ূর গত শতকের আশির দশকের প্রথম দিকে মধুপুরের বনে দেখা গিয়েছিল।
লাল বনমুরগি, যা কিনা বিশ্বের সকল গৃহপালিত মোরগ-মুরগীর পূর্ব-পুরুষ, তাদের বিশ শতকের প্রথম দিকেও ঢাকায় প্রচুর দেখা যেত, এবং শিকারে পরিণত হত। পোষা মুরগীর মতই স্থলচর পাখিগুলোকে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে সকাল বেলা খাবার খুঁজতে দেখা যেত শহরের উত্তর প্রান্তের বনে। তারা আক্রান্ত হলে উড়ে গাছের মাথায় আশ্রয় নিতে বা বনের গহীনে দ্রুত বেগে ছুটে পালাতে সক্ষম ছিল। রঙ ঝলমলে লাল বনমোরগটি তাঁর চকচকে লাল পালক, ফুলে থাকা ঝুঁটির কারণে অপেক্ষাকৃত ছোট ও বিবর্ণ মুরগীর তুলনায় অনেক বেশী দৃষ্টি আকর্ষণ করত।
সরব ও সুদর্শন মোরগেরা ছিল শহরতলির বাসিন্দা মগ ও অন্যান্য শিকারিদের নিয়মিত শিকার। ঈষৎ হলদে ও বাদামী বর্ণের বনমুরগী ভূমিতে পড়ে থাকা পাতার দঙ্গলের সাথে চমৎকার মিশে যেতে সক্ষম হলেও, ডিমে তা দেবার সময় তারাও অবলীলায় শিকারের সম্মুখীন হত। লাল বনমুরগি ঢাকা থেকে হারিয়ে গেলেও এখনো অল্প সংখ্যায় টিকে আছে মধুপুরের বনে, সিলেট ও চট্টগ্রামের পাহাড়ি বনে, এবং সুন্দরবনের কিছুটা ভাল অবস্থায়।
তিতির, বটেরা, বাতাই
গত কয়েকশ বছর ধরেই ঢাকার চারপাশের বনের ধার, পরিত্যক্ত জমি, ঘাসের প্রান্তর, আবাদি ভূমিতে কয়েক জাতের তিতির, বটেরা, বাতাইয়ের বাস ছিল। ছোটখাটো, দৃঢ় গড়নের মুরগি ধরনের এই ভূচর পাখিগুলো ঘাসের বীজ থেকেই পর্যাপ্ত খাবার জোগাড় করতে পারত, আবার গাছপালা, ঝোপঝাড়ের আত্মগোপনও করতে পারত। তবে জমিতে চরে বেড়ানোর কারণে সহজেই পেশাদার শিকারিদের ফাঁদে আটকা পড়ত। সাধারণত এই জাতীয় পাখির মাংস শিকারিদের পরিবারেই সহজপ্রাপ্ত খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হত, যদিও ঢাকার বিত্তাশালী পরিবারের টেবিলে বুনোহাঁসের মাংসের ডিশের পাশে তাদের স্থান হত না। সাহেব শিকারিদের কাছে মাটিতে চর বেড়ানো লাজুক পাখিগুলো ঘাসের বনের সারাদিন অতিবাহিত করে মারার মত আকর্ষণীয় শিকার ছিল না। গত শতাব্দী পর্যন্তও এই জাতের পাখিরা ঢাকায় টিকে ছিল।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে Frank B. Simson তাঁর Letters on sport in Eastern Bengal-এ কালা তিতির (Black Flancolin), বাদা তিতির (Swamp Francolin), রাজ বটেরা (King Quail), পাতি বটেরা (Common Quail)-এর নাম উল্লেখ করেছেন। ১৮৫৪ সালে পক্ষীবিদ RC Tytler ঢাকার পাখিদের মাঝে মেটে তিতির ((Grey Francloin) এবং দাগি নাটাবটের (Barred ButtonQuail)। এদের কেউই আজ ঢাকায় টিকে নেই, আর বাদা তিতির ও মেটে তিতির সারা বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত। কয়েক প্রজন্মের শিকারি ও তাদের ফাঁদ যা করতে সক্ষম নয় নি আমরা মাত্র ৫০ বছর সমস্ত বাদা, ঘেসো ভূমি, পতিত জমিতে কংক্রিট অরণ্য গড়ে তুলে সেই কাজ করেছি, এই পাখিদের ইতিহাসে ঠাই দিয়ে দিয়েছি বর্তমান থেকে।
হাঁস ও রাজহাঁস
শহরময় ছড়িয়ে থাকা নদী, খাল, দীঘি ও বাদা বুনোহাঁসের বিশাল ঝাঁকের জন্য বিখ্যাত ছিল। এছাড়া সারা বছরই পাতি শরালি (Lesser Whistling Duck), দেশী মেটেহাঁস (Indian Spot-billed Duck), ধলা বালিহাঁস ( Cotton Pygmy.goose) , নাকতা হাঁস (Knob-billed Duck), গোলাপি হাঁসদের (Pink-headed Duck) দেখা যেত।
তবে শীতের সময় স্থানীয় হাঁসদের চেয়ে বিপুল সংখ্যায় বেশী হাঁস ও রাজহাঁস , যেমন—দাগি রাজহাঁস, মেটে রাজহাঁস, রাজ শরালি, খয়রা চকাচকি, পাতি চকাচকি, উত্তুরে ল্যাঞ্জা হাঁস, উত্তুরে খুন্তে হাঁস, ইউরেশীয় সিঁথিহাঁস, পিয়ং হাঁস, গিরিয়া হাঁস, টিকি হাঁস এবং তিন জাতের ভুতিহাঁসদের আগমন ঘটত। শীতের এই সমাগম যেমন পাখি বিশেষজ্ঞদের জন্য উপভোগ্য দৃশ্য ছিল, তেমনি ছিল শিকারিদের জন্যও।
অতীতের অনেক পক্ষীবিদ, শিকারি, পর্যটক ও সাংবাদিক ঢাকার হাঁস ও রাজহাঁসদের মনোমুগ্ধকর বর্ণনা দিয়েছেন। ১৮৪০ সালে James Taylor লিখেছিলেন দাগি রাজহাঁসের বিশাল ঝাঁক এই জেলাতে পাওয়া যেত। তাদের সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পাওয়া সত্ত্বেও ১৯৮০ সাল পর্যন্ত মিরপুর চিড়িয়াখানার হ্রদে তাদের নিয়মিত দেখা যেত।
হাঁসদের সেই বিশাল মহাসমাবেশ আজ শীতকালে দু-চারটে মৃত প্রায় পুকুরে আশ্রয় নেওয়া কয়েক হাজার সরালিতে পরিণত হয়েছে। বাকী সমস্ত হাঁস ও রাজহাঁসেরা ঢাকা থেকে নেই হয়ে গেছে, আর নাকতা হাঁস বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্তির সম্মুখীন। গোলাপি হাঁস, যা কিনা ১৮৫৪ সালে James Taylor-এর লেখাতে ঢাকার স্থায়ী পাখি বলে উল্লেখিত ছিল, আজ সম্ভবত সারা বিশ্ব থেকেই বিলুপ্ত। কয়েক জাতের হাঁসের বিশাল ঝাঁক এখনও উপকূল ও হাওর অঞ্চলে দেখা যায় বটে, কিন্তু ঢাকার ধারেকাছে নয়। ঢাকার সমস্ত খাল, হ্রদ, বাদা আজ চাপা পড়েছে কংক্রিটের নিচে, নদীর পানি এতটাই দূষিত এবং সরব জলজান দ্বারা পরিপূর্ণ যে নিজেদের নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্যসচেতনতা নিয়ে সামান্যতম ধারনা থাকলেও কোন পানির পাখির কাছে তা আর আকর্ষণীয় নয়।
বাংলা ডাহর
বাংলা ডাহর (Bengal Florican) এক ধরনের ডাহর (Bustard) যারা ঢাকার উত্তরে সাভার এলাকায় অবস্থিত তৃণভূমিতে বিচরণ করত। লম্বা পায়ের অধিকারী ছিপছিপে মুরগীর মত দেখতে পাখিটি প্রায় দুই কিলোগ্রাম ওজনের হত। এটি সেই তৃণরাজ্যের পোকা, নানা ধরনের গিরগিটি, সাপ ইত্যাদি খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করত। ময়ূরের মতই এটি একটি বিশালাকায় ভূচর পাখি যারা সাধারণত তাদের পাখা কেবল কোর্টশিপের সময় এবং জরুরী মুহূর্তে ওড়ার কাজে ব্যবহার করত। বসন্তে পূর্বরাগ (কোর্টশিপের) সময় পুরুষ ডাহর দীঘল ঘাসের উপর লাফিয়ে লাফিয়ে শূন্যে ভেসে সাদা পাখা এবং ঘাড়ের চমৎকার কালো পালক প্রদর্শন করত। ঘাসের উপর মাঝে মাঝে লাফিয়ে এই দীর্ঘলম্ফের কারণেই শিকারিদের কাছে লক্ষ্যভেদের লোভনীয় বলে বিবেচিত হত বড় আকারের পাখিটি। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধেও এই পাখির প্রাচুর্য নিয়ে ঋই ঝরসংড়হ তাঁর খবঃঃবৎং ড়হ ংঢ়ড়ৎঃ রহ ঊধংঃবৎহ ইবহমধষবইতে উল্লেখ করেছেন।
বাংলা ডাহরের নামের মাঝে বাংলা কেবল ইংরেজি (Bengal Florican) এবং বাংলা ভাষায় স্থান করে নেয়নি, এমনকি বৈজ্ঞানিক নামেও বাংলা উল্লেখ আছে—Houbaropsis bengalensis. গত শতকের শুরু দিকেই অনন্য পাখিটি সাভার থেকে হারিয়ে যায় চিরতরে। বর্তমানে বাংলাদেশের কোথাও এটির অস্তিত্ব নেই, শুধু অল্প কিছু সংখ্যক আসাম, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামে টিকে আছে। সারা বিশ্বে এটি সংকটাপন্ন অবস্থায় আছে, এবং মূলত ভারতের নেওয়া উদ্যোগের উপরেই এই ডাহরের টিকে থাকা নির্ভর করছে। বাংলার নামে নামাঙ্কিত এই অসাধারণ পাখিটি আর কোন সময়ই বাংলাদেশে চরে বেড়াবে না।
সারস
ঢাকার নদীর তীর ও জলাগুলো দেশি সারস ও পাতি সারস-এর পরি যাজন কালে অবস্থানের সময় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। দেশী সারস আট কিলোগ্রাম ওজনের বিশালাকৃতির পাখি এবং পাতি সারসের ওজন ছিল পাঁচ কিলোগ্রামের কাছাকাছি। দেশী সারস মূলত মাছ, ব্যাঙ, গিরগিটি ও বৃহদাকৃতির পোকা খেতো, সেখানে পাতি সারস সর্বভুক হিসেবে পোকার সাথে সাথে নরম অঙ্কুর, কন্দ ইত্যাদি খেত। দেশী সারসদের সাধারণত জোড়ায় জোড়ায় দেখা গেলেও পাতি সারসদের দলে বেঁধে বিচরণ করতে দেখা যেত। ট্রফি শিকারিদের জন্য বৃহদাকৃতির পাখিগুলো খুব সহজ লক্ষ্য ছিল।
স্বাভাবিকভাবেই FB SimsonGi Letters on sport in Eastern Bengal বইতে ঢাকার দুই ধরনের সারসের কথায় উল্লেখ আছে। এরা এখনও অতি অল্প সংখ্যায় বাংলাদেশে আসে, কিন্তু ঢাকার নদী তীরে তাদের দর্শন পাওয়া হবে বিরলতম ঘটনাগুলোর একটি। সারা বিশ্বেই দেশী সারসের সংখ্যা দিন দিন কমছে, এদের অবস্থা বর্তমানে সংকটাপন্ন।
শকুন
গত এক হাজার বছর ধরেই শকুন ছিল ঢাকার সবচেয়ে অজনপ্রিয় কিন্তু সহজলভ্য পাখি। তারা ছিল শহরে বিনাবেতনে কর্মরত নিষ্ঠাবান পরিষ্কার কর্মী (মেথর)। শকুনেরা সবসময় দ্রুতগতিতে কোন জীবের মৃতদেহ বা পচা-গলা মাংস উধাও করে খেয়ে ফেলার ব্যাপারে ছিল সদা তৎপর। সারা দিন আকাশে চক্কর মারতে মারতে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তারা নজর রাখত কোথায় শকুনের সেবা প্রয়োজন এবং কারও প্ররোচনা ছাড়াই জায়গামত হাজির হয়ে যেত। ঢাকার বাসিন্দাদের কাছে অতি পরিচিত ছিল বাংলা শকুন (White-rumped Vulture) ও রাজ শকুন (Red headed Vulture)। বিশাল, কদাকার পাখিগুলোর যেমন কোন প্রাকৃতিক শত্রু ছিল না, তেমন শিকারিদের কাছেও ট্রফি হিসেবে তারা ছিল মূল্যহীন। তারপরও তারা গোলাপি-মাথা হাঁস, বাংলা ডাহর, দেশী ময়ূরের মতই অতি দ্রুত বিলুপ্তির গহ্বরে চলে গেছে। ঢাকার আকাশে এখন কোন শকুনের ডানা নজরে আসে না। রাজ শকুন প্রায় ৫০ বছর আগেই নেই হয়ে গেছে, এবং সমগ্র বাংলাদেশে তা অতি বিপন্ন বলে গণ্য। শতকরা ৯৫ ভাগেরও বেশী বাংলা শকুন আজ আর নেই, যে কটি আছে সেগুলো আগামি কয়েক বছরের মধ্যে মারা যাবে মূলত গবাদিপশুর রোগ সারাতে ব্যবহৃত Diclofenac নামে এক বিষাক্ত রাসায়নিক ঔষধের কারণে। শেষ বাংলা শকুন মারা যাবার সাথে সাথে আমরা আরও একটা পাখি চিরতরে হারাবো যার বৈজ্ঞানিক নাম ছিল Gyps bengalensis.
চামচঠুঁটি ও কাস্তেচরা
অতীতে ব্যতিক্রমী ঠোঁটের কিছু পাখি ঢাকার হ্রদ ও জলা চষে বেড়াত। রণ-পা ধরনের লম্বা লম্বা পায়ের অধিকারির পাখিগুলো সাধারণত বকদের সাথে মিশে মাছ শিকার করত, এবং সত্যিকারের পর্যবেক্ষক ছাড়া সকলেরই নজর এড়িয়ে যেত। এদের মাঝে সবচেয়ে বড় আকৃতির ছিল ইউরেশীয় চামচঠুঁটি (Eurasian Spoonbill), যার বিশাল ঠোঁটের সম্মুখভাগ ছিল চামচের মত। উনবিংশ শতাব্দীতেও FB Simson ও Dr James Taylor-এর লেখাতে চামচঠুঁটির উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়া আর তিন প্রজাতি কাস্তে ধরনের বিশাল ঠোঁটের অধিকারীর পাখির দর্শনও মিলত তখন। যাদের নাম খয়রা কাস্তেচরা, কালামাথা কাস্তেচরা, কালা কাস্তেচরা। কালামাথা কাস্তেচরার সমস্ত শরীর সাদা হলেও ঘাড়, মাথা ও ঠোঁট কালো। কালা কাস্তেচরার গাঢ় ধূসর বর্ণের দেহে লাল ন্যাড়া মাথা এবং খয়রা কাস্তেচরার সুদৃশ্য খয়রা রঙের পালক দেহাবৃত থাকলে ডানাতে ধাতব সবুজ বর্ণের চকচকে পালক থাকে। পক্ষীবিদ James Taylor ১৮৫৪ সালে ঢাকাতে খয়রা কাস্তেচরার অস্তিত্ব লিপিবদ্ধ করেন এবং এড়ফরিহ অঁংঃবহ ১৮৭০ সালে কালা কাস্তেচরার কথা জানান। গত শতকেই উপরে উল্লেখিত চার প্রজাতির পাখিই ঢাকা থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। ইউরেশীয় চামচঠুঁটি এবং কালামাথা কাস্তেচরা এখনও অল্প সংখ্যায় বাং
লাদেশে উপকূলে দেখা যায় কিন্তু কালামাথা কাস্তেচরা ও কালা কাস্তেচরা সারা দেশেই আজ অতি বিরল।
গগনবেড়
আজকের দিনে এটি অচিন্ত্যনীয় যে অতীতে ঢাকার হ্রদ ও জলাভূমিগুলোতে ঝাঁকে ঝাঁকে গগনবেড়রা থাকত। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি শময়ে ঢাকায় কর্মরত চিকিৎসক জেমস টেইলর লিখেছিলেন—গগনবেড় এখানের সমস্ত জলার বাসিন্দা। গগনবেড় এক ধরনের বড় আকৃতির মেছো পাখি যারা সেই সমস্ত জায়গাতেই টিকতে পারে যেখানে ক্ষুদে ক্ষুদের মাছের বিশাল ঝাঁক আছে এবং সহজেই যাদের পানির উপরিভাগ থেকে শিকার করা যায়। তাদের প্রতিদিনই এক কিলোগ্রামের উপরে মাছে লাগে। জেলেরা ঢাকাবাসীদের জন্য মাছ ধরে বাজারে সরবরাহ করার পরেও এত এত গগনবেড়ের খাবার মত যথেষ্ট মাছ ঢাকার জলাগুলোতে যথেষ্টই ছিল।
মানুষ ও গগনবেড়ের মাঝে মাছ ধরার কারবার অস্থিতিশীল হবার আগ পর্যন্ত বড় ধলা গগনবেড় (Great White Pelican) ও চিতিঠুঁটি গগনবেড় (Spot-billed Pelican) ছিল এখানের নিয়মিত বাসিন্দা। আজ সারা দেশের কোথাও গগনবেড়ের দেখা মেলে না। মাঝে মাঝে স্মৃতিকাঁতর এক জোড়া বড় ধলা গগনবেড় হয়ত জনারণ্য থেকে লুকিয়ে থাকা দূরের কোন জলাশয়ে কালেভদ্রে অতীতের পথ ধরে খানিকক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিতে নামে, অতি সৌভাগ্যবান না হলে তাদেরও দেখা মেলা ভার।
মানিকজোড়, মদনটাক ও শামখোল
ঢাকার জলাগুলো আরও একদল পাখির পদচারণায় মুখর ছিল যাদের খাদ্য তালিকায় মাছের চেয়ে ব্যাঙ, কাঁকড়া, ঝিনুক, গিরগিটি, সাপ, পোকা, ক্ষুদে স্তন্যপায়ী প্রাণী ও বর্জ্যের অংশই বেশী ছিল। এই পাখিগুলর ছিল বিশাল ঠোঁট এবং শক্তিশালী লম্বা পা। সাধারণত পানির কিনারে ও সিক্ত মাঠে এদের নিভৃতে টহল দিতে দেখা যেত, এই দলতির নাম মানিকজোড়, কিন্তু দলের দুই প্রজাতি মদনটাক এবং একটি শামখোল নামে পরিচিত। যে পাঁচ জাতের মানিকজোড় ঢাকায় দেখা যেত তারা হচ্ছে রাঙা মানিকজোড়, কালা মানিকজোড়, ধলা মানিকজোড়, ধলাগলা মানিকজোড়, কালাগলা মানিকজোড়। এছাড়া বড় মদনটাক হাড়গিলা নামেও পরিচিত, এবং ছোট মদনটাকও ছিল ঢাকার বাসিন্দা। আর ছিল খুবই পরিচিত এশীয় শামখোল, যার বিশেষ ধরনের ঠোঁট, যা ঝিনুক খোলার প্রয়োজনে এমন আকৃতি ধারণ করেছে, সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করত। Dr J Taylor, RC Tytler, FB Simson গত বিংশ শতকের অনেকেই এই পাখিদের নিয়ে লিখে গেছেন।
এই আট জাতের মানিকজোড়ের মাঝে একমাত্র এশীয় শামখোল বাদে আর কোনটাই বর্তমানে ঢাকাতে টিকে নেই। মাঝে মাঝে ছন্নছাড়া দুয়েকটি শামখোল শহরতলীতে, বিশেষ করে সাভারে দেখা যায়।
বাকি সাত প্রজাতি ঢাকা থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও বাংলাদেশ থেকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয় নি এখনও। গুটিকয়েক রাঙা মানিকজোড় এবং কালা মানিকজোড় মাঝে মাঝে শীতকালে পদ্মা ও যমুনার তীরে দেখা যায়। বাকী তিন প্রজাতি অপেক্ষাকৃত বিরল হলেও মাঝে মাঝে দেশের কোন জনবিরল স্থানে দেখা যায়। আর মদনটাকদের মাঝে সুন্দরবনে ছোট মদনটাক কিছু পরিমাণে টিকে আছে, যদিও বড় মদনটাক গত তিরিশ বছরেও বাংলাদেশে দেখা যায় নি। সারা বিশ্বেই মানিকজোড়দের সংখ্যা ক্রমাগত কমতেই আছে।
ঘাস পাখি
ঢাকা থেকে চিরতের হারিয়ে যাওয়া অগণিত ক্ষুদে পাখির মাঝে আমরা এখানে মূলত একটা পাখি নিয়ে কথা বলব যার নাম বাংলা ঘাসপাখি (Roufous-rumped Grassbird, Graminicola bengalensis)। সেই বিশেষ পাখিকে নিয়ে আলোচনার মূল কারণ ২টি, প্রথমত তাঁর বৈজ্ঞানিক নাম রাখা হয়েছে বাংলার নামে, দ্বিতীয়ত এটি বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি শময়ে ঢাকাতেই আবিষ্কৃত হয়েছিল। যদি RC Tytler পাখিটি উনি নাকি Dr Jerdon—কে প্রথম আবিষ্কার করেছেন সেই নিয়ে বিতর্ক শুরু করেছিলেন। এই ক্ষুদে পতঙ্গভুক পাখিটি চিহ্নিত করা খুবই দুরূহ কারণ এটি ঘাসের রাজ্যে ঝোপ থেকে ঝোপে উড়ে বেড়িয়ে খাদ্য সংগ্রহ করে, এবং ঘাসের আড়াল থেকে বেরোয় না বললেই চলে। বাংলা ঘাসপাখি নিয়ে RC Tytler লিখেছিলেন—১৮৫২ সালে ঢাকাতে এই পাখি সংগ্রহ করার পরে বর্ণনা ও অংকনচিত্র গৎ ইষুঃযএর কাছে পাঠিয়ে দিই। ঢাকার ঘাসের রাজ্য এদের দেখা প্রায়ই মেলে। মনে হয় Dr JerdonGi Birds of India-তে Graminicola bengalensis নামের যে পাখিটি আছে এইটিই সেই বিশেষ পাখি।
ঢাকার ঘাস এবং ঝোপঝাড়ের সাথে সাথে বাংলা ঘাসপাখিও সম্পূর্ণ নির্মূল হয়ে গেছে, যদিও কারও জানা নেই কেমন করে এমনটা হল, বা শেষ পাখিটি চাক্ষুষ কে করেছেন। সৌভাগ্যক্রমে পাখিটি এখনও বাংলাদেশে আছে, বিশেষ করে টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রান্তসীমার গাছপালায়। এছাড়ারাও আরেক জাতের ঘাসপাখি , শতদাগি ঘাসপাখি বিংশ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত ঢাকায় দেখা যেত। এখন বাংলাদেশের কোথাও পাখিটিকে দেখা যায় না। গত শতাব্দীতে আরও দুটি ক্ষুদে পাখি লালটুপি ছাতারে, হলদেচোখ ছাতারে ঢাকা থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। খুবই কম মানুষই আজ পর্যন্ত এই চার পাখির ঢাকা থেকে নাই হয়ে যাওয়া এবং একটির দেশ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া খেয়াল করেছেন, এবং তাই নিয়ে দুশ্চিন্তা করেছেন।
টিকে থাকা পাখিরা
যদিও গত চারশ বছর হারিয়ে যাওয়া পাখির মিছিল আমাদের শোকার্ত করে তোলে, কিন্তু এখন পর্যন্ত টিকে থাকা পাখিদের নিয়ে আমরা আশাবাদী ও উল্লসিত হই। একজন সচেতন পর্যবেক্ষক ঢাকার যেখানেই গাছ, ঝোপ, ঘাস টিকে আছে সেখানেই দৈনন্দিনের সুপরিচিত পাখি ছাড়াও বিরল কিছুর দেখা পেতেই পারেন। সমস্ত শহর কংক্রিটে মুড়ে, সমস্ত পানিতে বিষ ঢেলে দূষিত করার পরেও বর্তমানে ঢাকায় প্রায় ২০০ প্রজাতির পাখি দেখা যায়, যা এক কথায় অবিশ্বাস্য।
একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে বিগত কয়েক শতাব্দীতে সাধিত পরিবেশের ভয়াবহ ক্ষতি থেকে কিছুটা হলেও উত্তরণ ঘটছে ঢাকার খুব ধীরে ধীরে। নগর পরিকল্পনাকারীরাও শহরের কিছু স্থানে নালা, জলা, সবুজ ঝোপ ইত্যাদি ফিরিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। যদিও তা করা সম্ভব হয় তাহলে এই শহর শুধু মাত্র মানুষের বসবাসের জন্যই শ্রেয়তর হবে না, শীঘ্রই ক্ষুদের ঘাসপাখি ও জলের পাখির উপস্থিতিও দেখা দিবে।
যদি আমরা সচেতন সুনাগরিক হবার চর্চা ধরে রাখি, হয়ত এই শহরে একদিন ফিরে আসবে চকাচাকি, ভুতিহাঁসের ঝাঁক, যার জন্য ঢাকা একদা বিখ্যাত ছিল।
- ইংরেজি থেকে অনুবাদ: তারেক অণু
[অনুবাদকের কথা:
ঢাকা মহানগরীর ৪০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত Environment of Capital Dhaka গ্রন্থের Wildlife of Dhaka অধ্যায়টি পড়ে মুগ্ধ হয়ে তখনই লেখক ইনাম আল হকের কাছ থেকে সেটি বঙ্গানুবাদের অনুমতি আদায় করি। অসাধারণ এই লেখাটির মূল মেজাজ হয়তো আমার দুর্বল বাংলাতে পাঠকেরা পাবেন না, কিন্তু মূল তথ্য এবং সবুজ ঢাকার কিছুটা ছোঁয়া পাবেন সেই আশা রাখতেই পারি।
ব্যবহৃত সমস্ত আলোকচিত্র ইনাম আল হকের কাছ থেকে পাওয়া।
অনুবাদটি করতে আমার দুই মাসের অধিক সময় লেগেছে, কোনো সময় সাগরে জাহাজে ভেসে, কোনো সময় উপকূল ট্রলারে, চলন্ত ট্রেনে, বাসে, নিভৃতে লেখার টেবিলে আস্তে আস্তে কাজটি করার সময় মূল লেখার জন্য লেখক কী অপরিসীম পরিশ্রম করেছেন, নিখুঁত তথ্য ইতিহাসের আঁধার থেকে আলোতে আনার জন্য কী পরিমাণ নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন, তা ভেবে বিস্মিত হয়েছি। ইনাম আল হককে অনেক অনেক ধন্যবাদ এই অসামান্য কাজটি করার জন্য।
সেই সাথে আশা রাখছি, একদিন বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চল নিয়ে, সমগ্র দেশ নিয়ে এমন তথ্যবহুল কাজ সম্পাদিত হবে।]
- References:
- Taylor, J. Surgeon 1840. A Sketch of the Topography & Statistics of Dacca, (Orphan Press, Huttmann), Calcutta, India, pp.19-33, 45, 66-8
- Tytler, R. C. 1854. Miscellaneous notes on the fauna of Dacca, (The Annals and Magazine of Natural History, vol. 2(14)), Dehli, pp. 168-177
- W. W. Hunter A. 1877. Statistical Accounts of Bengal, vol V. Districts of Dhaka, Bakarganj, Faridpur and Maimansinh, (Trubner & Co.), London, pp.22-31
- Simson, F. B. 1882. Notes on Birds Found near Dacca, (Ibis vol. 4 (6)), London, pp.84-95
- Simson, F. B. 1886. Letters on Sport in Eastern Bengal, (R. H. Porter), London, pp.55-61
- Allen, B. C. 1912. Easteern Bengal District Gazetteers Dacca, Allahabad, India, pp. 8, 21, 68
- Rizvi, S. N. H 1969. East Pakistan District Gazetteers Dacca, (East Pakistan Govt. Press), Dhaka, pp. 29-31
- জেমস টেলর, ১৯৭৮, কোম্পানি আমলে ঢাকা, মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান অনুদিত, বাংলা একাডেমী ঢাকা
- Ahmad, Y. A. 1981. With the Wild Animals of Bengal, (Y S Ahmad), Dhaka, pp. 24-5, 33-4, 42-9, 65-71
- Grove, R. H. V., Damodaran and S. Sangwan, 1998. Nature and the Orient, the Environmental History of South and
- অনুপম হায়াৎ ২০০১, নওয়াব পরিবারের ডায়েরিতে ঢাকার সমাজ ও সংস্কৃতি, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লি, ঢাকা
- Southeast Asia, (Oxford University Press), Delhi, pp. 243-8, 426-9
- Kabir, S. M. H., E. U. Haque and M. A. Islam, 2010. Wildlife of Dhaka. In: Environment of Capital Dhaka- Plants Wildlife Gardens Parks Open Spaces Air Water Earthquake (Ed. Md. Anwarul Islam), Asiatic Society of Bangladesh (Celebration of 400 Years of Capital Dhaka Series 6), Dhaka, pp. 83-128; ISBN: 978-984-33-1558-8.