রিসাইকেল জার ইকোসিস্টেম: বর্জ্যকেও মূল্যবান করে তুলছে
মোহাম্মদপুরে একটি ভাঙারির দোকান চালান জায়েদ আহমেদ। জায়েদ দায়িত্ব নেওয়ার আগে দোকানটি চালাতেন তার বাবা। আমাদের অনেকের ব্যবহৃত বেশিরভাগ জিনিসের শেলফ লাইফই (কার্যকরী স্থায়িত্বকাল) খুব কম। তবে জায়েদের জীবিকাই হলো বর্জ্য পুনর্ব্যবহার, নতুন কাজে ব্যবহার ও বিক্রি করা।
দোকানের জন্য উপকরণ জোগাড় করতে জায়েদকে বরাবরই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হতো। এই প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ। আর তিনি যে ফেরিওয়ালাদের বর্জ্য খোঁজার জন্য পাঠান, তাদেরকে সাধারণত আশপাশের এলাকায় জঞ্জাল ঘাঁটাঘাঁটি করতে হয়। কিন্তু এসব উৎস থেকে জায়েদ সবসময় উপকরণ পেতেন না, আবার পেলেও উৎসগুলো সবসময় নিরাপদ হতো না।
তবে দু-মাস আগে রিসাইকেল জার ইকোসিস্টেমের সাথে অংশীদারিত্বে যাবার পর থেকে জায়েদ এ বিষয়ে বিস্তর সহায়তা পেয়েছেন।
রিসাইকেল জার ইকোসিস্টেম হলো একটি সামাজিক উদ্যোগ যা মার্কেট প্ল্যাটফর্ম দিয়ে থাকে। এ প্ল্যাটফর্মে যে-কেউ তাদের গৃহস্থালি বর্জ্য বিক্রি করতে পারে। ব্যবহৃত প্লাস্টিক, ইলেকট্রনিকস পণ্য, রান্নার তেল, কাগজ, কার্ডবোর্ড ইত্যাদি যেকোনো কিছু থাকতে পারে বর্জ্যের তালিকায়।
বিক্রেতাদের সঙ্গে স্থানীয় রিসাইক্লারদের—যেমন জায়েদের মতো ভাঙারিওয়ালা—যোগাযোগ করিয়ে দেয় রিসাইকেল জার। রিসাইক্লাররা এসব বর্জ্য কিছুটা কম দামে কিনে নেন। এরপর তারা সেগুলো মেরামত করে লাভ রেখে ফের বিক্রি করেন।
রিসাইকেল জার ইকোসিস্টেম মূলত মধ্যস্থতাকারীর কাজ করে। আগ্রহী বিক্রেতাদের সঙ্গে তারা রিসাইক্লারদের যোগাযোগ করিয়ে দেয়।
জায়েদ এখন দিনে নয়-দশটি অর্ডারের পণ্য পেয়ে যান। যারা রিসাইকেল জারের প্ল্যাটফর্মে জিনিস বিক্রি করে, তাদের বাড়িতে তিনি নিজের ফেরিওয়ালাদের পাঠান। সেখান থেকে তারা দোকানের জন্য উপকরণ কিনে নিয়ে আসে। এতে জায়েদের সময়, জনবল ও অর্থ সাশ্রয় হয়।
এসব সুবিধা ছাড়াও রিসাইকেল জারের দিকনির্দেশনা বর্জ্য সম্পর্কে জায়েদের দৃষ্টিভঙ্গি আমূল বদলে দিয়েছে। বর্জ্য কীভাবে প্রক্রিয়াজাত করতে হবে, সে সম্পর্কে তার ধারণাও বদলে দিয়েছে রিসাইকেল জার।
জায়েদ বলেন, 'আগে আমরা ইলেকট্রনিকস পণ্য খুলে, কিনে নিয়ে নির্দিষ্ট যন্ত্রাংশ ফের বিক্রি করতাম। যেমন, ফ্রিজের ভালো তামার তারের জন্য সাধারণত ৬৫০ টাকা পাওয়া যেত। ছোটগুলোর দাম ৩৫০ টাকা। তাই আমরা নষ্ট হয়ে যাওয়া ফ্রিজ ১ হাজার টাকায় কিনে, যন্ত্রাংশ খুলে নিয়ে যেতাম। তারপর এসব যন্ত্রাংশ ফের বিক্রি করতাম।
'এরপর রিসাইকেল জার আমাদের দেখিয়ে দিল কীভাবে একটা ইলেকট্রনিক পণ্য [নষ্ট হয়ে যাওয়ার পরও] মেরামত করে পুনরায় ব্যবহার করা যায়। তাই এখন আমরা কোনো মেরামতযোগ্য যন্ত্র সোর্স করলে সেটিকে ফের দোকানে বিক্রি করে দিই। আমাদের থেকে কিনে নিয়ে তারা সেটিকে মেরামত করে সেকেন্ড-হ্যান্ড পণ্য হিসেবে বিক্রি করে।'
রিসাইকেল জার ইকোসিস্টেম কী?
সবচেয়ে বেশি জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। তা সত্ত্বেও জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রস্তুতি আমাদের নেই।
রিসাইকেল জার ইকোসিস্টেমের সিইও ও প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান সবসময় জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি নিয়ে ভাবতেন। সেই ভাবনাই তাকে এই উদ্যোগ শুরু করতে অনুপ্রাণিত করে।
২০১৯ সালে তিনি আকর্ষণীয় চাকরি ছেড়ে দিয়ে রিসাইকেল জার ইকোসিস্টেম প্রতিষ্ঠা করতে নিজের সমস্ত সঞ্চয় ঢেলে দেন। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আকার বাড়তে থাকে তার প্রতিষ্ঠানের। জিয়াউরের লক্ষ্য ছিল দূষণের বিরুদ্ধে লড়াই করা এবং অর্থনৈতিক উপায়ে আমাদের কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমানো। তিনি চেয়েছিলেন বর্জ্য সম্পর্কে মানুষের ধারণা বদলে দিতে, বর্জ্যের সম্ভাব্য মূল্য মানুষকে জানাতে।
জিয়াউর বলেন, 'বাংলাদেশে বাস্তুচ্যুত জলবায়ু উদ্বাস্তুর সংখ্যা ১ কোটি। কিন্তু তারপরও আমরা আমরা যে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত, তা পুরোপুরি বুঝতে পারিনি। এর কারণ হলো এই সমস্যা থেকে আমরা লাভের সুযোগ দেখি না। আর সত্যিটা হলো, কোনো কিছু থেকে লাভের সম্ভাবনা দেখতে পেলেই কেবল আমরা পদক্ষেপ নিই। তাই আমি এই মানসিকতা নিয়ে কাজ করতে চেয়েছিলাম এবং এভাবেই এই উদ্যোগটি শুরু করি।'
জিয়াউর যুক্তরাজ্যে পড়াশোনা করেছেন। বেশ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন তিনি। কাজ করেছেন বিশ্বব্যাংকের সাথে 'লাইটিং এশিয়া' নামক একটি প্রকল্পেও। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভিন্নতা আনার প্রবল ইচ্ছে ছিল তার। আর বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে ভালো কাজে দেবে, এমন সমাধান খুঁজে বের করায় মন দেন।
তিনি বলেন, 'বর্জ্যহীন বাংলাদেশের কথা ভাবুন। এই স্বপ্নকে সামনে রেখেই কাজ করছি আমরা। আমরা বিশ্বাস করি যে বর্জ্যেরও মূল্য আছে। তাই আমরা একটি সমন্বিত প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছি যেখানে যে-কেউ তাদের ব্যবহৃত, নষ্ট পণ্য বিক্রি করতে পারবেন। এবং বর্জ্যের মানদণ্ডের উপর ভিত্তি করে আমরা এই বিক্রেতাদের সাথে ভাঙারিওয়ালা, ফেরিওয়ালার মতো রিসাইক্লারদের যোগাযোগ করিয়ে দিই। তারপর তারা এই বর্জ্য রিসাইকেল করে, মেরামত করে এবং পুনর্ব্যবহার করে।
'মানুষ তাদের উৎপাদিত বর্জ্য বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করতে পারে। এইভাবে তারা যেমন টাকা রোজগার করতে পারে, তেমনি ভূমিকা রাখতে পারে পরিবেশ সংরক্ষণেও।'
বিক্রেতারা রিসাইকেল জারের ওয়েবসাইট গিয়ে তৎক্ষণাৎ তাদের পণ্য বিক্রি করতে পারেন। সাইটের নিজস্ব কার্বন ফুটপ্রিন্ট ক্যালকুলেটর ব্যবহার করে নিজেদের কার্বন আউটপুট গণনা করতে পারেন তারা। এ পর্যন্ত রিসাইকেল জার ইকোসিস্টেম প্রায় ৬ হাজার পরিবারের আয় বাড়িয়েছে, আর কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ কমিয়েছে ৬৬ টন। এখন পর্যন্ত ৬১ হাজারেরও বেশি পণ্য পুনরায় বিক্রি করেছে রিসাইজেল জার।
বর্তমানে জায়েদের মতো মোট ৪৭৮ জন অংশীদার রয়েছে রিসাইকেল জারের। অংশীদারদের মধ্যে আছে ফেরিওয়ালা (১৭৮ জন), ভাঙারিওয়ালা (২১১), রিসাইক্লিং কোম্পানি (৪), স্ক্র্যাপ ব্যবসায়ী (১৩), ই-বর্জ্য সংগ্রহকারী (১৬), মার্চেন্ট বর্জ্য ব্যবসায়ী (১১) ও ব্যবহৃত রান্নার তেল ক্রেতা (১)।
মার্কেটপ্লেস সেবার পাশাপাশি রিসাইকেল জার মেরামত, ভাড়া ও বিনিময় সেবাও দিয়ে থাকে।
রিসাইকেল জারের স্থানীয় মেরামত সেবার মাধ্যমে যে-কেউ নষ্ট হয়ে যাওয়া জিনিস মেরামত করতে পারে। সেলফ-স্টোরেজ বা বা ভাড়া সেবাও দিয়ে থাকে রিসাইকেল জার। এ সেবার মাধ্যমে যেকোনো পরিবার তাদের খালি জায়গা অন্যদের ভাড়া দিতে পারে।
বিভিন্ন কোম্পানির মধ্যে ইনভেন্টরি বিনিময় বা অদলবদল সেবাও দেয় রিসাইকেল জার। এই সেবার মাধ্যমের কোম্পানিগুলো কোনো যন্ত্রপাতি ফেলে না দিয়ে সেগুলো নিজেদের মধ্যে বিনিময় করতে পারে। এছাড়া রিসাইকেল জার কর্পোরেট রিসাইক্লিং সমাধানও দেয়। এ সেবার আওতায় রিসাইক্লিংয়ের উদ্দেশ্যে রিসাইক্লারদের সঙ্গে কর্পোরেশনগুলোকে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া হয়।
এছাড়া রিসাইকেল জার একটি নতুন কার্বন অপসারণ সেবাও দিচ্ছে। বাংলাদেশে এ ধরনের উদ্যোগ এটাই প্রথম। এই সেবার মাধ্যমে কর্পোরেশনগুলো তাদের কার্বন বর্জ্য ফেলে না দিয়ে সঞ্চয় করতে পারছে।
রিসাইকেল জার এখন ভারতের সঙ্গে যৌথ সুন্দরবন-পুনর্বনায়ন নামক একটি প্রকল্পেও কাজ করছে। সুন্দরবন করিডোর বরাবর ক্ষয়প্রাপ্ত বাস্তুতন্ত্রের একটি পুনরুদ্ধার প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজও করছে তারা।
এ প্রকল্পে ভারত কাজ করছে ১৫ হাজার হেক্টর, আর বাংলাদেশ কাজ করছে ৫ হাজার হেক্টর জমিতে। এনকিং ইন্টারন্যাশনাল ১৫ বছর মেয়াদি প্রকল্পটি পরিচালনা করছে।
পুনর্বনায়ন প্রক্রিয়া কার্বন অফসেটিং দিয়ে সম্পন্ন করা হবে। বাংলাদেশে এই প্রথম একটি বেসরকারি কোম্পানি কার্বন স্টোরেজ নিয়ে কাজ করবে। জিয়াউর বলেন, 'কার্বন অফসেটিং একটি গতিশীল পদ্ধতি। এদেশে কেউ এই ধারণা নিয়ে কাজ করেনি। ভবিষ্যতে আমরা এটি আরও স্থানীয়ভাবে চালু করার পরিকল্পনা করছি।'
ভবিষ্যতে টেকসই প্যাকেজিং ও প্লাস্টিক দূষণ সমাধান নিয়ে আসার পরিকল্পনাও আছে রিসাইকেল জারের। এ বছর নিজেদের অ্যাপ চালু করার লক্ষ্যও রয়েছে তাদের। এখন তারা শুধু ঢাকার মধ্যেই কাজ করলেও, রহমানের লক্ষ্য ভবিষ্যতে সারা রিসাইকেল জারকে বাংলাদেশে বিস্তৃত করা।
তিনি বলেন, 'বর্তমানে আমরা নিজেদের অর্থায়নে চলচি। তবে আন্তর্জাতিক জলবায়ু পরিবর্তন তহবিল বা অনুদান পাওয়ার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। জলবায়ুতে আগ্রহী ইক্যুইটি বিনিয়োগকারীদেরও টানতে চাই আমরা।'
তিনি আরও বলেন, ব্যবসা না করে একটা প্রভাব তৈরির দিকেই তাদের মনোযোগ বেশি। তাদের মূল লক্ষ্য জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করা এবং আমাদের কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমানো।
'আমরা কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান না, আমরা একটি সামাজিক উদ্যোগ। আমরা এনজিও না, লাভের উদ্দেশ্যে কাজও করি না।'
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে অবদান রাখার জন্য রিসাইকেল জার ইকোসিস্টেমকে ইয়ুথ কো:ল্যাব-এর স্প্রিংবোর্ড প্রোগ্রাম ৪-এ বাংলাদেশের সেরা দশ স্টার্টআপের একটি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।