বাংলাদেশে বৈরী অভ্যর্থনা
প্রায় প্রতিদিনই আমি গাড়ি নিয়ে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কমপ্লেক্সের সামনে দিয়ে যাওয়া-আসা করি। কমপ্লেক্স পেরোনোর সময় দ্রুত নির্মীয়মাণ তৃতীয় টার্মিনাল দেখে দারুণ মুগ্ধ হই। নির্মাণকাজ দেখে আশাবাদী হয়ে উঠি—দেশের দ্রুত প্রবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে অচিরেই একটি আধুনিক বিমানবন্দর টার্মিনাল গড়ে উঠবে সেখানে।
কিন্তু এর মানে তো এই নয় যে, নতুন টার্মিনালটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত বিদ্যমান অবকাঠামোতে যাত্রীদেরকে বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ অভিজ্ঞতার স্বাদ নিতে হবে।
খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (ভিআইপি) না হলে—অর্থাৎ সরকারি চাকরিজীবী বা ক্ষমতাসীন দলের অভিজাত সদস্য না হলে—সবাইকেই বিমানবন্দরে ভয়ানক বৈষম্যমূলক অভিজ্ঞতার স্বাদ নিতে হয়।
প্রবাসী শ্রমিক, পর্যটক ও বিদেশিদের জন্য—শাহজালাল বিমানবন্দরের সেবাগুলো কেবল একটা কথাই বলবে: বাংলাদেশে আপনাকে স্বাগত জানানো যাচ্ছে না।
ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া ছাড়া শাহজালাল বিমানবন্দরের আর সবকিছুরই হ-য-ব-র-ল অবস্থা। এ বিমানবন্দরে যত মানুষ আসে, সেই তুলনায় এখানকার সেবার গতি অত্যন্ত ধীর। সে কারণে শাহজালাল বিমানবন্দর বেশিরভাগ সময়ই লোকে লোকারণ্য থাকে। ফলে এখানে সবসময় ট্রলি-সংকট লেগেই থাকে।
সবচেয়ে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হলো লাগেজ পুনরুদ্ধার করা। এ যেন রীতিমতো দুঃস্বপ্ন। লাগেজ বেল্টগুলো এতটাই মন্থর যে আপনি সম্ভবত হেঁটেই বিমানের লাগেজ হোল্ডের কাছে চলে গিয়ে নিজেই নিজের স্যুটকেস খুঁজে বের করত পারবেন।
এ বিমানবন্দরে এখনও সেই আশির দশকে চালু হওয়া লাগেজ ক্লিয়ারেন্স সিস্টেম চলছে। বিমানে একটি ছোট লাগেজ ট্রাক নিয়ে যাওয়া হয়—তাতে ৩০টির মতো ব্যাগ আনলোড করা হয়। তারপর ট্রাকটিকে বেল্টে ফিরিয়ে এনে লারেলাপ্পা গতিতে এক এক করে ব্যাগগুলোকে বেল্টে রাখা হয়। এরপর আবার ৩০-৪০টি ব্যাগ আনতে বিমানে ফিরে যায় ট্রাকটি।
লাগেজ কর্মীদের মধ্যে যাত্রীদের প্রতি ন্যূনতম সহমর্মিতার দেখা পাওয়া যায় না। আপনাকে কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হচ্ছে, তা নিয়ে তাদের কোনো গরজ নেই। আপনার বিমান যদি শিফট পরিবর্তনের মধ্যে পৌঁছে যায়, তাহলে নিজে লাগেজের চেহারা দেখার জন্য আপনাকে দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতে পারে—কারণ সকালের শিফটের দায়িত্বরতরা চলে গেছে, আর পরবর্তী শিফটের লোকেরা দুপুরের খাবার খেয়ে ঢেঁকুর তুলতে তুলতে হেলেদুলে মাত্র দায়িত্বে যোগ দিতে আসছে।
এক সপ্তাহের পারিবারিক ট্যুর শেষে বৃহস্পতিবার আমি থাইল্যান্ড থেকে দেশে ফিরেছি। শাহজালাল বিমানবন্দরে নেমে আমাদের লাগেজ পেতে সময় লেগেছে ৯০ মিনিট।
যারা দেশের বাইরে গেছেন, তারা সমস্ত লাগেজ হাতে পেতে আধঘণ্টার বেশি সময় লাগে না—সেটা কলকাতা, দিল্লি, কলম্বো, সিঙ্গাপুর, লন্ডন, নিউ ইয়র্ক বা মস্কো যেখানেই হোক না কেন।
আমি দেখেছি বিদেশিরা প্রথমে তাদের লাগেজের জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেন। রসিকতা করে পরিস্থিতি হালকা করার চেষ্টা করেন। শেষে তারা হতাশায় ভেঙে পড়েন। বিড়বিড় করে গাল দিতে থাকেন। আমি মনে মনে তাদের গালাগালের প্রতিবাদ করার চেষ্টা করি। কিন্তু পারি না। কারণ আমার মনের অবস্থাও তাদের মতোই।
তারপরে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সে গিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে পড়ে যাবেন আরেক ভিড়ের মধ্যে।
লাগেজ সংগ্রহ করবেন বাইরে বেরোনোর চেষ্টা করতে গেলেই—হয় লাল চ্যানেল দিয়ে নয়তো সবুজ চ্যানেল দিয়ে—লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হবে আপনাকে। সেখানে প্রত্যেককে যার যার লাগেজ বাধ্যতামূলকভাবে স্ক্যানারে রাখতে হয়। কাজেই লাইন হয়ে ওঠে বিশাল।
আজতক কোনো বিমানবন্দরে আমি এমন ব্যবস্থা দেখিনি। কাস্টমস বিভাগ যদি কাউকে সন্দেহ না করে, তাহলে কোথাও যাত্রীদের এভাবে লাইনে দাঁড় করিয়ে রাখে না। বাংলাদেশেও এই ব্যবস্থার প্রচলন ছিল না। এই ব্যবস্থাটি নতুন চালু হয়েছে।
সব যাত্রীকেই নিষিদ্ধ জিনিসপত্র বহন করার জন্য সন্দেহ করা হচ্ছে—কাস্টমস বিভাগের এমন মনোভাবেরই প্রতিফলন এ ব্যবস্থা। নির্দোষ প্রমাণিত না হলে সবাই-ই এখানে চোরাচালানকারী।
আমার চাচা মার্কিন নাগরিক। গত মাসে তিনি ঢাকায় বেড়াতে এসেছিলেন। তখন তিনি আমাকে ফোন করেন তার অভিজ্ঞতা জানানোর জন্য। তিনি বলেন, 'কাস্টমসের লোক আমাকে যা জিজ্ঞেস করেছে, তা আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না। লোকটা নিচু গলায় আমাকে জিজ্ঞেস করল, কত বোতল মদ এনেছেন?'
তাহলে কি তারা মদের জন্যই সব মানুষকে এভাবে আটকাচ্ছে? আচ্ছা, বিদেশ থেকে কয়জন মানুষ অ্যালকোহল নিয়ে আসে? আনলেও কতটুকুই বা আনে?
হয়তো খেয়াল করেছেন, বিমানবন্দরের ভেতরে একটি পর্যটন শুল্কমুক্ত দোকান আছে। কাস্টমস যেসব অ্যালকোহলের বোতল জব্দ করে, সেগুলো 'বিক্রি' হয় সেখানে। এরকম কাজ কতটা নৈতিক?
হয়রানির শিকার না হয়ে বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার জন্যও আপনাকে ভিআইপি হতে হবে কিংবা কোনো ভিআইপির সঙ্গে সম্পর্ক থাকতে হবে। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও যদি ভিআইপি সংস্কৃতি না থাকত, তাহলে এই হয়রানি থেকে মুক্তি পাওয়া যেত। বিমানবন্দর পরিচালনাকারী আমলা বা কর্মকর্তারা নিজেরাই হয়রানিতে পড়লে তারা নিশ্চয় এ সমস্যার সমাধান করতেন।