আমদানির জোয়ারে ৯ মাসে বাণিজ্য ঘাটতি ২৫ বিলিয়ন ডলার
রপ্তানির তুলনায় ব্যাপক হারে আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় ও বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্য, জ্বালানিসহ সব ধরনের পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে দেশের বাণিজ্য ঘাটতি অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার।
চলতি অর্থবছরের নয় মাসের বাণিজ্য ঘাটতি গত অর্থবছরের পুরো সময়ের তুলনায় ৯ দশমিক ২৫ শতাংশ বেশি। আর জুলাই-মার্চ সময়ের চেয়ে বেশি প্রায় ৬৪ শতাংশ।
২০২০-২১ অর্থবছরের এই ৯ মাসে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১৫ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার। আর পুরো অর্থবছরে এই ঘাটতি ছিল ২২ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার।
চলতি অর্থবছরে বিশাল অঙ্কের বাণিজ্য ঘাটতির কারণে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যেও (কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্ট) বড় ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ।
জুলাই-মার্চ সময়ে এই ঘাটতির পরিমাণ ১৪ দশমিক শূন্য ৭ বিলিয়ন ডলারে উঠেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক মাত্র ৫৫৫ মিলিয়ন ডলারের ঘাটতি ছিল।
অর্থনীতিবিদরা বলেন, পণ্য আমদানি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় বাণিজ্য ও লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতিতে ব্যাপক পরিমাণে বেড়েছে।
করোনা মহামারি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর থেকেই আমদানিতে জোয়ার বইছে। আর এতে আমদানি-রপ্তানির মধ্যে ব্যবধান বা বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েই চলেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক রোববার বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায় ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে ৬১.৫২ বিলিয়ন ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরের এই ৯ মাসে ৪২ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল।
অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ৩৬ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার আয় করেছেন রপ্তানিকারকরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩২ দশমিক ৯২ শতাংশ বেশি।
এ হিসাবেই অর্থবছরের ৯ মাসে পণ্য বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৪ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার।
এদিকে চলতি হিসাব লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি ১৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়াল। ২০২১-২২ অর্থবছর শুরুই হয়েছিল লেনদেনের ভারসাম্যে ঘাটতি নিয়ে। প্রথম তিন মাসে অর্থাৎ জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২.৩১ বিলিয়ন) ডলার। চার মাস শেষে (জুলাই-অক্টোবর) তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪.৭৬ বিলিয়ন ডলার। জুলাই-নভেম্বর সময়ে ঘাটতি ছিল ৬ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার।
ডিসেম্বর শেষে তা আরও বেড়ে ৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। জানুয়ারি শেষে ১০ দশমিক শূন্য ১৯ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়।
ফেব্রুয়ারি শেষে তা ১২ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলারে ওঠে। সবশেষ মার্চ শেষে ১৪ দশমিক শূন্য ৭ বিলিয়ন ডলারের চূড়ায় উঠেছে। এর আগে কোনো অর্থবছরেও এত বিশাল ঘাটতিতে পড়েনি বাংলাদেশ।
করোনা মহামারির কারণে আমদানি কমায় ৯২৭ কোটি ৪০ লাখ (৯.২৭ বিলিয়ন) ডলারের বড় উদ্বৃত্ত নিয়ে ২০২০-২১ অর্থবছর শেষ হয়েছিল। তার আগের বছরে উদ্বৃত্ত ছিল ৩১৬ কোটি ৯০ লাখ ডলার।
তবে দেশের ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট এখনও উদবৃত্ত রয়েছে। জুলাই-মার্চ সময়ে এই উদ্বৃত্ত দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরের এই সময়ে ৭ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলারের উদ্বৃত্ত ছিল।
করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিসহ অন্য দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত ঋণসহায়তা পাওয়ায় আর্থিক হিসাবে উদ্বৃত্ত হয়েছে বলে জানান অর্থনীতিবিদরা।
তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে ৬ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলারের ঋণসহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৫৫ দশমিক ১৬ শতাংশ বেশি।
২০২০-২১ অর্থবছরের এই ৯ মাসে ৪ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারের ঋণসহায়তা পেয়েছিল বাংলাদেশ।
এদিকে জুলাই-মার্চ সময়ে ১৫ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ কম। ২০২০-২১ অর্থবছরের একই সময়ে ১৮ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স এসেছিল দেশে।
কোভিডের পর দেশে সব ধরনের পণ্যের চাহিদা ব্যপক বেড়েছে। এছাড়া বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বাড়ছিল দ্রুত গতিতে। সর্বশেষ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পণ্য সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ায় আরও বাড়ছে দাম।
গত বছরের এপ্রিলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেলের দাম ছিল ৬০ ডলার। রোববার সেই তেল ১১২ ডলারের বেশি দামে বিক্রি হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুতে এর দর ১৩৯ ডলারে উঠে গিয়েছিল।
এপ্রিলে রপ্তানি বেড়েছে ৫১ শতাংশ
মাত্র ১০ মাসেই ২০২২ অর্থবছরের জন্য নির্ধারিত রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রার (৪৩.৫ বিলিয়ন) কাছাকাছি পৌঁছেছে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়। পোশাকের বৈশ্বিক চাহিদা বাড়ার পাশাপাশি চীন থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কাজের অর্ডার আসায় এটি সম্ভব হয়েছে।
এপ্রিল পর্যন্ত টানা ৮ মাস ধরে রপ্তানি আয় ছিল ৪ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের তুলনায় এ বছরের এপ্রিলে রপ্তানি বেড়েছে ৫১ শতাংশ।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সূত্রে জানা গেছে, জুলাই-এপ্রিল মাসে রপ্তানিতে ৪৩.৩৪ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ, যার মধ্যে তৈরি পোশাক খাতেই রপ্তানির পরিমাণ ছিল বেশি (৮১ শতাংশেরও বেশি)।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "বাণিজ্য ঘাটতি শুধু বাংলাদেশ কেন্দ্রিক ঘটনা নয়, এটি অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশেও রয়েছে। যেখানে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট এবং ট্রেড ব্যালেন্স ঘাটতি উভয়ই বাড়ছে।"
"এটি মূলত উচ্চ আমদানি ব্যয় এবং কম রপ্তানি প্রবৃদ্ধির কারণে ঘটছে। আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির প্রধান কারণ, পণ্য এবং পেট্রোলিয়াম বেশি দামে আমদানি। যদিও গত বছর রেমিট্যান্স ভাল ভূমিকা পালন করেছিল, এ বছর তা তুলনামূলকভাবে কম। এটি সামগ্রিক ভারসাম্যকেও প্রভাবিত করেছে," তিনি যোগ করেন।
সিপিডির রিসার্চ ডিরেক্টর আরও বলেন, বাণিজ্যে বিশ্বায়নের অস্থিরতার কারণে চলতি হিসাব ও বাণিজ্য ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
"আমাদের কাছে যে পরিমাণ রিজার্ভ রয়েছে তা এখনও সহনীয় পর্যায়ে আছে। তবে আমদানির এই হার অব্যাহত থাকলে সময়ের সাথে রিজার্ভও কমবে। এখন আমাদের আমদানি ব্যয় কমাতে হবে," যোগ করেন তিনি।
এ বিষয়ে তিনি আরও বলেন, সরকারের উচিত অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি সীমিত করা। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যেই লেটার অফ ক্রেডিট (এলসি) খোলার জন্য ২৫ শতাংশ মার্জিন রাখতে বলেছে।
"আমাদের উচিত টাকা ডিভ্যালুয়েট করার মাধ্যমে ডলারের মূল্য বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। একইসঙ্গে কম সুদে বিদেশি ঋণ পাওয়া যেতে পারে," যোগ করেন তিনি।