ভারতের গম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা: আমরা কৃষিতে কীভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করব এখনই ভাবতে হবে
ভারত কি তাহলে খাদ্যের রাজনীতিতে নামল? ভারতের ২০২১ -২২ অর্থবছরের উৎপাদন তাদের চাহিদার তুলনায় হিসাব অনুসারে প্রায় সাত মিলিয়ন মেট্রিক টন উদ্বৃত্ত। ভারতের গমের স্থায়ী ক্রেতা বাংলাদেশ। ভারত ধারাবাহিকভাবে বেশ কয়েক বছর যাবৎ তাদের কৃষি উৎপাদন বাড়িয়ে যাচ্ছে এবং তার ভোক্তা হিসেবে বাংলাদেশকে পাশে পেয়েছে। ইতিমধ্যে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা, ইউরোপ এবং অস্ট্রেলিয়া ভারতের বিরুদ্ধে বিশ্ববাণিজ্য চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগ এনেছে। ভারত চুক্তি বহির্ভূতভাবে তাদের প্রাইস সাপোর্ট খ্যাত পদ্ধতিতে সহায়তা প্রদান করছে কৃষক এবং সরবরাহকারীদের, যারা আন্তর্জাতিক বাজারে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার চুক্তি বহির্ভূতভাবে তাদের উৎপাদিত চিনি, গম, চাল বিক্রি করছে।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা কাছে ভারতের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে- তা নিয়ে পশ্চিমবাংলার দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় একটি উপ-সম্পাদকীয় প্রচার হয়েছে; আমাদের কাছে "উত্তর আছে তো" এই শিরোনামে।
বিশ্বের দানাদার শস্যের ক্ষেত্রে ভারত তার অবস্থান বৃদ্ধি করে চলছে। বাংলাদেশের চাল এবং গমের যে ঘাটতি- তা মূলত ভারতকেন্দ্রিক। ভারতের বাজার থেকেই আমাদের বেসরকারিখাত সাধারণভাবে সরবরাহ নিয়ে থাকে। ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধের ফলে বিশ্বের গমের যোগান যখন সংকটময়, সরবরাহ টানটান তেমন একটি সময়ে শর্তযুক্ত একটি সরবরাহ ব্যবস্থার পথে গিয়ে ভারত গমের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। আর এর প্রধান শিকার বাংলাদেশ তাতে কোন সন্দেহ নেই। গম রপ্তনির ক্ষেত্রে যে শর্ত জুড়ে দিয়েছে তাতে বলা হয়েছে: "কোন দেশের সরকার যদি চায় তাহলে ভারত সরবরাহ করতে পারে।"
এই নিষেধাজ্ঞার ফলে হয়তো ভারতীয় গমের আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বৃদ্ধির সুযোগ ঘটবে। স্থানীয় বাজারে স্থিতিশীলতা থাকবে। যদিও এই মুহূর্তে তাদের দেশীয় বাজারেও কিছুটা মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে সামগ্রিক যুক্তি হিসাবে নিজস্ব চাহিদার কথাই উল্লেখ করেছে ভারত সরকার।"
ইতোপূর্বে পেঁয়াজের ক্ষেত্র ভারত একই রকম পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও ইলিশ রপ্তানির ক্ষেত্রে এমনি একটি বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বহু আগেই। সবকিছু পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন করলেও গম সরবরাহের ক্ষেত্রে এই মুহুর্তে এমন পদক্ষেপ প্রশ্নের সৃষ্টি করবেই।
বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৭০ লক্ষ টন গম আমদানি করে থাকে যার প্রধান সরবরাহকারী দেশ- ইউক্রেন, রাশিয়া, কানাডা ও ভারত। ইউক্রেন-রাশিয়ার সরবরাহ যুদ্ধের কারণে স্থগিত হয়ে গেছে। সঙ্গে নানান মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ব্যাপার তো আছেই। সব মিলিয়ে যুদ্ধ ও এসব নিষেধাজ্ঞায় বাংলাদেশের রাশিয়া থেকে গম ক্রয়ে এক অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে।
রাশিয়া মূলত এই মুহূর্তে তেল-গ্যাস-গম সরবরাহ করতে রুবলে দাম পরিশোধের দাবি জানাচ্ছে। এমন একটি সংকটময় অবস্থা বাংলাদেশকে কতটা অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে সেটি বোঝা যাবে পরবর্তী ভারতীয় পদক্ষেপগুলো দেখে। অর্থাৎ সরকারি ব্যবস্থাপনায় গমের সরবরাহ নিশ্চিত করতে কতটা সময় লাগে এবং তা কতটা সঠিকভাবে সম্পন্ন করা হয় তা দেখে। সঙ্গে এটা মনে রাখতে হবে, গমের ক্রয়মূল্য যাতে প্রকাশ্যে আসে। যেন আমরা বুঝতে পারি যে, আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় আমাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত কোনো মূল্য আদায় করা হচ্ছে কিনা? কিংবা এরমধ্যে আবার কোন এজেন্ট ব্যবস্থার সৃষ্টি হবে কিনা, যারা মধ্যস্বত্বভোগী হিসাবে কিছু কামিয়ে নেবে। যেমনটি হয়েছে আমাদের দেশের কোভিড ভ্যাকসিন নিয়ে। কোন এক শিল্প গ্রুপ তাদের নিজেদের দাবি অনুযায়ী, ৬২ কোটি টাকা লাভ করেছে দেশের ভ্যাকসিন সরবরাহ ব্যবস্থার সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করে।
বর্তমান আন্তর্জাতিক বিশ্বের সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনা করলে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ কোন দিকে মোড় নেবে তা এই মুহূর্তে বোঝা যাচ্ছে না। উভয় পক্ষই যুদ্ধের পরিসমাপ্তিতে টানার বিষয়ে অনমনীয়। এরসঙ্গে নতুন গোলযোগ সৃষ্টি হয়েছে ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের ন্যাটোতে যোগদান করা নিয়ে। রাশিয়ার দিক থেকে শক্ত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হয়েছে। ফলে ন্যাটোতে যদি এই যোগদান সম্পাদিত হয় তাহলে ইউরোপের এ যুদ্ধ পরিস্থিতি আরো সংকটময় হবে।
আমাদের জনবহুল এই দেশটিতে নানান ধরনের কৃষিপণ্য সংকট রয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ভোজ্যতেল, গম, এবং নানা প্রকারের মসলা। নতুন এই বিশ্ব পরিস্থিতির দিকে লক্ষ্য রেখে কেবলমাত্র জিডিপি লক্ষ্যমাত্রাকে মাথায় না রেখে; নতুনভাবে কৃষিপণ্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে তা সঠিকভাবে বাড়াতে হবে।
আমরা কীভাবে কৃষিতে সত্যিকারের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারব সেই বিষয়টিকে আমাদের মাথায় নিতে হবে। এর মধ্যে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কতটা জরুরি তা আমাদের আরো ভালোভাবে ভাবতে হবে। কৃষি জমির ব্যবহার শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে। নতুন করে ঘরবাড়ি, অবকাঠামো সম্প্রসারণ করতে গিয়ে যেন কৃষিজমি বিনষ্ট না হয়- সেদিকে দৃঢ়ভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে। আগামীতে যদি আমরা কৃষিপণ্যের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে না পারি, তাহলে আমাদের মতন দেশের ভাগ্যে বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি হবে। যে ধরনের বাণিজ্য ঘাটতির সৃষ্টি হচ্ছে গত কয়েক মাস ধরে, তাতে অনুমান করা যায় সকল ধরনের কৃষি পণ্যের দাম পৃথিবীতে আকাশচুম্বী হবে। সেদিকে লক্ষ্য রেখে অবশ্যই অবকাঠামো প্রজেক্টগুলো আপাতত স্থগিত রাখা দরকার। আগামী বাজেটে বড় জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা চেয়ে কম ঘাটতি বাজেটের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।