খোলা তেল বিক্রি বন্ধ করতে আরও সময় চায় রিফাইনারিগুলো
অবকাঠামো স্থাপনে পিছিয়ে থাকা এবং বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার শঙ্কা তুলে ধরে খোলা সয়াবিন বিক্রি বন্ধ করতে আরও ১৯ মাস সময় চায় বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স এন্ড ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশন।
অথচ বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড এন্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) তেল পরিশোধনকারী বেশ কয়েকটি কোম্পানি পরিদর্শন করে জানিয়েছে, 'রিফাইনারিগুলো আন্তরিক হলেই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ভোজ্যতেল বোতলজাত করা সম্ভব।'
শিল্প মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, চলতি মাসের ৩১ তারিখের মধ্যে খোলা সয়াবিন তেল এবং চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে খোলা পাম অয়েল বিক্রি বন্ধ করতে হবে। এ সিদ্ধান্ত বেশ কয়েক মাস আগেই মিল মালিকদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বাজারে ভোজ্যতেলের সংকট ও দাম বৃদ্ধির কারণে ভোক্তারা যখন ক্ষুব্ধ, ঠিক তখনই বাজার আরও অস্থিতিশীল হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে খোলা তেল বিক্রি বন্ধে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় চেয়ে শিল্প মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে ভোজ্যতেল রিফাইনারিদের সংগঠন।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের কারিগরি সহায়তা প্রকল্পের আওতায় খোলা সয়াবিন ও পাম অয়েল বিক্রি বন্ধের চেষ্টা চলছে। কিন্তু রিফাইনারিগুলোর বাধার মুখে প্রায় এক দশক ধরে ঝুলে রয়েছে এই কার্যক্রম।
২০১৩ সালে ডিও প্রথা বাতিল করে পরিবেশক প্রথা চালু করতে নতুন আইন করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ওই আইনেও খোলা তেল বিক্রি নিষিদ্ধ করেছে সরকার।
খোলা ভোজ্যতেল বিক্রি যে কোনভাবেই স্বাস্থ্যসম্মত নয়- এ তথ্য স্বীকার করে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স এন্ড ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশন। বলছে, কোভিড-১৯ এর কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো তেল প্যাকেটজাত করার জন্য প্রয়োজনীয় মেশিনারিজ স্থাপন ও বিশেষজ্ঞ আনতে পারে নি।
তারা বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিরতার মধ্যে রিফাইনারিগুলোর প্রস্তুতি সম্পন্ন না করে খোলা তেল বিক্রি বন্ধ করা হলে চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ব্যাপক ঘাটতি তৈরি হতে পারে। যা স্থানীয় বাজারকে আরও অস্থির করে তুলতে পারে।
বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনারিগুলো দাবি করছে ড্রামের পরিবর্তে ভোজ্যতেল প্যাকিং এ নিয়ে আসার লক্ষ্যে সিটি গ্রুপ মেশিনারিজ আমদানি করেছে। প্রতিষ্ঠানটি তাদের সরবরাহকৃত ৪৫ শতাংশ তেল বোতলজাত করে বিক্রি করছে। এছাড়া গ্লোব এডিবল অয়েল লিমিটেড ৪৫ শতাংশ তেল বোতলজাত করে বিক্রি করছে।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (মান নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবসা সহায়তা) ড. আছমা আক্তার জাহান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'রিফাইনারিগুলো ২৫ এপ্রিলের মধ্যে যে তথ্য দেওয়ার কথা ছিল, তা পুরোপুরি দেয়নি। আমরা তাদের তথ্যগুলো আবার চেয়েছি। যে তথ্য পেয়েছি সেগুলো বিশ্লেষণ করছি। বিশ্লেষণ শেষ হলে তখন আমরা সিদ্ধান্ত দিব আসলে ৩১ মে এর মধ্যে খোলা তেল বিক্রি বন্ধ করতে পারবো কিনা।'
এস আলম গ্রুপের সিনিয়র ম্যানেজার কাজী সালাহউদ্দিন অহমদ টিবিএসকে বলেন, 'কনজ্যুমার প্যাক ধীরে ধীরে প্যাকেটজাত করা গেলেও ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইউজের তেলগুলো ড্রামের বিকল্প নেই। না হলে ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে।'
তিনি জানান, প্রতি লিটার তেল বোতলজাত করা হলে সেখানে ভ্যালু অ্যাড হয় ২৫ টাকা, যেখানে ড্রামে ভ্যালু অ্যাড হয় মাত্র ৩ টাকা। এর জন্য ড্রাম বন্ধ না করে কোম্পানির সিল বাধ্যতামূলক করা উচিত। এতে মানসম্পন্ন তেল না দিলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে জবাবদিহির আওতায় আনা যাবে।
ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলো বলছে, কনজ্যুমার প্যাকিং বোতলজাত তেল সরবরাহে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে বসুন্ধরা গ্রুপ ও বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেড। এখন ৩০ শতাংশ ভোজ্যতেল প্যাকিং এর মাধ্যমে বিক্রি হচ্ছে এবং ৭০ শতাংশ খোলা বিক্রি হয়। খোলা তেল বিক্রির সুযোগে পাম অয়েল আমদানি করে সয়াবিন নামে বেশি দামে বিক্রি করে মিলগুলো।
কোম্পানিগুলোর দাবি, খোলা তেল বিক্রি বন্ধ করতে হলে আরও এক বছর সময় লাগবে। কারণ করোনার মধ্যে কারখানায় প্রয়োজনীয় অবকাঠামো স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। বিদেশ থেকে যেসব বিশেষজ্ঞ আসার কথা ছিল, তারা আসতে পারে নাই। এখন কাজ শুরু হয়েছে, যা সম্পন্ন হতে আরও সময়ের প্রয়োজন।
গত এপ্রিলের শেষদিকে রিফাইনারি কোম্পানিগুলোকে নিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয় একটি বৈঠক করে। ওই সভায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের প্রতিনিধি জানান, ঘোষিত সময়ের পর সয়াবিন ও পাম অয়েল ড্রামে বাজারজাত না করার সচেতনতা তৈরি করে মনিটরিং করা হচ্ছে। এ সময় বাড়ানো হলে মনিটরিংয়ে সমস্যা তৈরি হবে। ফলে খোলা তেল বিক্রি বন্ধে পূর্ব নির্ধারিত সময় পরিবর্তনের সুযোগ নেই।
বিএসটিআই বলছে, খোলা তেলের বেশিরভাগের মধ্যেই ভিটামিন এ ফর্টিফিকেশন ঠিকমত হচ্ছে না। কোম্পানিগুলো এই সুযোগ নিচ্ছে। কারণ ড্রামের তেলে কোম্পানির নাম লেখা থাকে না। তাছাড়া, বাজারে খোলা তেলের দাম বাড়লেও দায়ী কোম্পানি চিহ্নিত করা যায় না। ড্রামে কোম্পানির সিল না থাকায় অবৈধভাবে খোলা তেলের দাম বাড়ানোর দায় স্বীকার করে না কোনো কোম্পানি।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ) গবেষণা করে দেখেছে, ভোজ্যতেলের জন্য যে ড্রাম ব্যবহার করা হচ্ছে তার বেশিরভাগই স্বাস্থ্যসম্মত নয়, এমনকি ড্রামগুলো ফুডগ্রেডেডও নয়। ফলে পরিশোধিত তেলগুলো ড্রামে নেওয়ার পরই দূষিত হয়ে পড়ছে। এটা জনস্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর।
ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, 'খোলা তেল দ্রুত বন্ধ করতে হবে। এখানে প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহার করে খরচ বাড়ানোরও কোন প্রয়োজন নেই, বিভিন্ন দেশের মতো পলিপ্যাক ব্যবহার করলে খরচও কমানো সম্ভব।'
তিনি বলেন, সব তেল প্যাকেটে বিক্রি হলে বাজারে অস্থিরতা তৈরি করার অবৈধ সুযোগও কমে আসবে।