পি কে হালদার: একজন প্রতারকের ১১ হাজার কোটি টাকার সাম্রাজ্য
তার বাবা ছিলেন একজন কৃষক এবং মা ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষিকা। তাই তাকে নিয়মিত পিরোজপুরের নাজিরপুরে অবস্থিত দীঘিরজান প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব পড়ে তার মায়ের উপর। স্কুলে অসাধারণ প্রতিভার জন্য প্রথমবারের মতো সবার চোখে পড়েন প্রশান্ত কুমার হালদার।
একটি ছোট খড়ের বাড়িতে তার পরিবারটি কোনোমতে দিনযাপন করতো।
কিশোর প্রশান্তের জীবন কেটেছে দরিদ্রতার মধ্যে। কিন্তু শ্রেণীকক্ষে তিনি ছিলেন একজন তারকা। তার প্রতিভা যাতে বিনষ্ট না হয় সেই লক্ষ্যে কাজ করেছেন তার শিক্ষকরাও।
পাশাপাশি, ছেলের পড়াশোনার বিষয়ে সচেতন ছিলেন তার মা-ও। পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পান প্রশান্ত।
সেখান থেকে দীঘিরজান উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। সেখানে আবারও নিজের প্রতিভা দিয়ে মুগ্ধ করলেন সকলকে। পঞ্চম শ্রেণির মতো অষ্টম শ্রেণিতেও তিনি বৃত্তি পান।
স্থানীয়দের মতে, মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় (এসএসসি) ফার্স্ট ডিভিশন অর্জনের পাশাপাশি বৃত্তি পান প্রশান্ত।
ততদিনে তার প্রতিভার খবর ছড়িয়ে পড়েছে পিরোজপুর গ্রামে। সবাই ভেবেছিলেন যে, তিনিই হবেন এমন কেউ যে কিনা এখানকার মানুষকে অবিরাম অর্থনৈতিক দুর্ভোগ থেকে মুক্তির পথ দেখাবেন।
এসএসসি পাস করার পর প্রশান্ত বাগেরহাটের পিসি কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে দেশের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ইঞ্জিনিয়ারিং বাংলাদেশ প্রকৌশল টেকনোলজিতে (বুয়েট) পড়ার সুযোগ পান তিনি।
অন্তর্নিহিত প্রতিভা ও নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের তৃষ্ণা থেকেই প্রশান্ত ট্র্যাক পরিবর্তন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অফ বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে এমবিএ করেন।
এমবিএ করে তিনি যোগ দেন ব্যাংকিং সেক্টরে। তার নিয়োগকর্তারা ভেবেছিলেন যে দেশের এক উজ্জ্বল লক্ষত্রকে নিয়োগ দিয়েছেন তারা।
এখান থেকেই প্রশান্ত রূপ বদলানো শুরু করেন। প্রশান্ত থেকে তিনি হয়ে ওঠেন পি কে হালদার।
চার কেলেঙ্কারির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
পিরোজপুরের নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মেধাবী এই ছেলেটি একসময় দেশের চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে পথে বসিয়ে দেন। জন্ম দেন দেশের আর্থিক খাতের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারির।
সবার কাছে 'ম্যানেজ মাস্টার' হিসেবে পরিচিত পি কে হালদার মাত্র ১০ বছরের ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা নিয়েই ২০০৯ সালে রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের এমডি হয়ে যান। এরপর ২০১৫ সালের জুলাইয়ে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের এমডি পদে যোগ দেন।
২০০৯ সাল থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে মাত্র ১০ বছরেই ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি) থেকে ১১ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেন নানা কৌশলে। চারটি প্রতিষ্ঠান দখলে নিলেও কোনো প্রতিষ্ঠানেই পি কে হালদারের নিজের নামে শেয়ার নেই।
এই সময়ে হালদার তার বিশ্বস্ত লোকজন, বন্ধু-বান্ধবকে কৌশলে ওইসব প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পর্যায়ে বসিয়েছেন। বিশ্বস্ত লোকদেরকে প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগ দিয়ে নিজের জালিয়াতির কাজে লাগিয়েছেন। এছাড়া, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর কিছু কর্মকর্তা যারা এসব তদারকিতে ছিলেন তাদেরও তিনি নানাভাবে ম্যানেজ করেছেন।
প্রশান্ত কুমার হালদার প্রতিষ্ঠান দখল ও অর্থ আত্মসাৎ করেছেন নিয়ন্ত্রক সংস্থার চোখের সামনে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে সমর্থনও পেয়েছেন।
সব শেয়ার অন্যদের নামে হলেও ঘুরেফিরে আসল মালিক পি কে হালদারই। নিজেকে আড়ালে রাখতে এমন কৌশল নেন তিনি। নিজের নামের সঙ্গে মিল রেখে পি কে হালদার গড়ে তুলেন একাধিক প্রতিষ্ঠান, যার বেশির ভাগই কাগুজে।
কাগজে-কলমে এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় ছিলেন পি কে হালদারের মা লীলাবতী হালদার, ভাই প্রিতিশ কুমার হালদার, প্রিতিশ কুমারের স্ত্রী সুস্মিতা সাহা, খালাতো ভাই অমিতাভ অধিকারী, অভিজিৎ অধিকারীসহ বিভিন্ন আত্মীয়স্বজন। সাবেক সহকর্মী উজ্জ্বল কুমার নন্দীও ছিলেন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মালিকানায়।
১০ বছরে ১১ হাজার কোটি
মূলত শেয়ারবাজার থেকে শেয়ার কিনে চারটি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেন পি কে হালদার। এভাবে নিয়ন্ত্রণ নেওয়া চারটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পিপলস লিজিং ও বিএফআইসির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের একধরনের সহায়তা ছিল।
এই দুই প্রতিষ্ঠানের আগের পরিচালনা পর্ষদের একাধিক সদস্য আইন ভেঙে নামে-বেনামে ঋণ নেওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। আর এই সুযোগে এসব কোম্পানির শেয়ার কিনে প্রতিষ্ঠান দুটির নিয়ন্ত্রণ নেন পি কে হালদার।
ইন্টারন্যাশনাল লিজিং একসময় ভালো চলছিল। ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠানটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পরই প্রতিষ্ঠানটি ভেঙে পড়ে। প্রায় ৩০টি প্রতিষ্ঠানের নামে বের করে নেওয়া হয় ২ হাজার ২৯ কোটি টাকা। এই টাকা ব্যয় হয় অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে শেয়ার কেনার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য ।
একই বছর পিপলস লিজিংয়ের নিয়ন্ত্রণ নেয় হালদারের প্রতিষ্ঠান আনান কেমিক্যাল। এফএএস ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট ও রিলায়েন্স ব্রোকারেজের মাধ্যমে এই শেয়ার কেনা হয়।
বিভিন্ন মাধ্যমে টাকা আত্মসাতের পর পিকে হালদার পাচার করেছেন কানাডা ও ভারতে। সেখানে আগেই নিজের ও ভাইয়ের নামে কোম্পানি খুলেছিলেন তিনি।
২০১৮ সালে ভাই প্রিতিশ হালদোর ও নিজের নামে ভারতে হাল ট্রিপ টেকনোলজি নামে কোম্পানি খোলেন হালদার। কলকাতার মহাজাতি সদনে তাদের কার্যালয়।
কানাডায় পিঅ্যান্ডএল হাল হোল্ডিং ইনক নামে কোম্পানি খোলা হয় ২০১৪ সালে, যার পরিচালক পি কে হালদার, প্রিতিশ কুমার হালদার ও তার স্ত্রী সুস্মিতা সাহা।
কানাডা সরকারের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কানাডার টরন্টোর ডিনক্রেস্ট সড়কের ১৬ নম্বর বাসাটি তাদের।
দীর্ঘদিন ধরে সবার নাগের ডগায় বহাল তবিয়তে থাকলেও পি কে হালদারের নাম সামনে আসে ক্যাসিনোবিরোধী সাম্প্রতিক শুদ্ধি অভিযানের সময়। এ সময় দুদক যে ৪৩ জনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে, তাদের মধ্যে পি কে হালদার একজন।
তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হাজির হতে নির্দেশ দিলেও দুদকের নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই দেশ থেকে পালিয়ে যান হালদার। দীর্ঘ তিন বছর পর ভারতে গ্রেপ্তার হন শনিবার (১৪ মে)।
গ্রাম থেকে অসম্মানজনক প্রস্থান
পড়াশুনার সময় তিনি প্রায়ই ছুটি পেলে গ্রামে আসতেন যদিও তখন যোগাযোগব্যবস্থা খুবই কঠিন ছিল। কিন্তু নিজের গ্রাম, আত্মীয়-স্বজন ও পরিবারের ভালোবাসায় তিনি সেখানে যেতেন। প্রকৌশলী হওয়ার পর চাকরির পাশাপাশি গ্রামের মানুষকে সাহায্য করা শুরু করেন তিনি।
ওয়ান ইলেভেন এর পরবর্তী সময় হালদার এলাকায় 'দানবীর' হিসেবে পরিচিতি পান। তিনি অনেককে চাকরি এবং আর্থিক সহায়তা দিতে থাকেন। এমনকি গ্রামে তার মায়ের নামে নিজের খরচে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।
প্রায় ১৫ বছর আগে তিনি দুইবার ধিরঞ্জন উচ্চ বিদ্যালয়ের স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বলে জানিয়েছেন বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক জানান। স্কুল ম্যানেজিং কমিটির দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি গ্রামের মানুষদের আচরণে হতবাক হন।
পি কে হালদারের সভাপতিত্বে ম্যানেজিং কমিটির সভা চলাকালে আমজাদ হোসেন নামে এক স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি হঠাৎ সভায় ঢুকে হালদারকে মারধোর শুরু করে। একই সময়ে আমজাদের নির্যাতনের পাশাপাশি তাকে ব্যাপকভাবে অসম্মানিত করা হয় এবং তার সমালোচনা করা হয়। কিন্তু সেসময় কেউই পিকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেনি বলে এলাকার এক কলেজ শিক্ষক জানান। এমনকি পরবর্তী সময়ে কেউ এর প্রতিবাদ করেনি।
এমন অপ্রত্যাশিত বড় ধাক্কা এবং অসম্মান পেয়ে পি কে গ্রাম ছেড়ে চলে যান এবং সেখানে তিনি আর ফেরত যাননি। অপমানে গ্রামের সঙ্গে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন তিনি। ইতোমধ্যে তার মা শিক্ষকতার চাকরি থেকে অবসর নেন। ঘটনার পর তার বাবা-মাসহ পি কে-র পুরো পরিবার দেশ ছেড়ে স্থায়ীভাবে অন্য দেশে বসবাস শুরু করে।
গ্রাম ছাড়লেও রাজধানীতে আস্তান গেঁড়েছিলেন ভালভাবেই। নিজের 'ইঞ্জিনিয়ারিং দক্ষতায়' খালি করে দিয়েছেন চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কোষাগার। পাচার করেছেন বিদেশে।
তবে ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানের সময় নিজের সব অপকর্ম সামনে এলে দেশ ছাড়েন পি কে হালদার। সেখানে বনে যান শিবশংকর। তবে বিশেষ রক্ষা হয়নি। শনিবার গ্রেপ্তার হন ভারত সরকারের তদন্ত সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) এর হাতে।
ইডি জানিয়েছে, পি কে হালদার নিজেকে শিবশংকর হালদার পরিচয় দিতেন। দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে শিবশংকর পরিচয়ে তিনি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রেশন কার্ড, ভারতের ভোটার পরিচয়পত্র, আয়কর দপ্তরের পরিচয়পত্র, নাগরিকত্বের পরিচয়পত্র ইত্যাদি জোগাড় করেছিলেন।
এ বিষয়ে দেয়া এক বিবৃতিতে ইডি আরও জানায়, এসব ভুয়া পরিচয়ের মাধ্যমে তারা পশ্চিমবঙ্গে বেশ কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলেছিলেন। এছাড়া কলকাতার অভিজাত এলাকায় বেশ কয়েকটি বাড়ি ছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় জমিও কিনেছিলেন পি কে।
তার কার্যক্রমে বোঝা যায়, পি কে হালদার আসলে বদলান নি। কেবল তার কেলেঙ্কারির অবস্থান বদলেছিল।