দুরবস্থা কাটিয়ে উঠতে নাভানার ১০ বছরের মহাপরিকল্পনা
দেশের স্বনামধন্য ব্যবসায়িক শিল্প সংস্থা নাভানা গ্রুপ তাদের দুরবস্থা কাটিয়ে উঠতে দশ বছরের একটি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। সঙ্কট কাটানোর জন্য ২০১৯ সালের শেষের দিকে নাভানা গ্রুপ ১,২০০ কোটি টাকা আর্থিক সহায়তার জন্য সরকারের কাছে আবেদনও করে।
গ্রুপটির শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেন, ভুল ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত, লাগামহীন ঋণ, অব্যবস্থাপনা এবং সুশাসনের অভাবে দেশের অন্যতম বৃহৎ ব্যবসায়িক গ্রুপটি অনেকটাই খাদের কিনারায় চলে গিয়েছিল। অবস্থা এতোটাই খারাপ হয়েছিল যে টিকে থাকার জন্য সরকারের কাছে অর্থ চেয়ে ধর্না দিতে হয়েছে। তবে দেরিতে হলেও মালিকপক্ষের বোধদয় হয়েছে, যে সুযোগ তাদের রয়েছে সেটা সঠিকভাবে ব্যবহার করলে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব। আর সে কারণে ২০২১ সালে গ্রুপটির চেয়ারম্যান শফিউল ইসলাম কামাল নাভানা গ্রুপকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা নিয়েছেন।
আর এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রথম ধাপে করপোরেট রিস্ট্রাকচারের অংশ হিসেবে গ্রুপটির শীর্ষ নেতৃত্বে পরিবর্তন আনা হয়েছে। সেখানে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে ওয়াহেদ আজিজুর রহমান, চিফ হিউম্যান রিসোর্সেস অফিসার (সিএইচআরও) খন্দকার ইসতিয়াক মাহমুদ, চিফ স্ট্র্যাটেজি অফিসার (সিএসও) মোহাম্মদ নাভেদ ফেরদৌস ইকবাল এবং রাজিবুল হাসান খানকে চিফ ফাইন্যন্সিয়াল অফিসার (সিএফও) হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তাদের প্রত্যেকেরই মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে।
নতুন নেতৃত্ব দায়িত্ব নিয়েই নাভানা গ্রুপকে শীর্ষ পর্যায়ে নিয়ে যেতে ১০ বছরের মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
পাশাপাশি ডেবট-ইকুইটি রিস্ট্রাকচার এবং কর্পোরেট ফিন্যান্সিয়াল স্ট্রাটেজি ঠিক করার জন্য মার্চেন্ট ব্যাংক রিভারস্টোন ক্যাপিটাল লিমিটেডের সঙ্গে কর্পোরেট এডভাইজরি এগ্রিমেন্ট করেছে নাভানা।
২০২১ সালে নিয়োগ পাওয়া গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ওয়াহেদ আজিজুর রহমান বলেন, "আমাদের এখানে উদ্যোক্তারা নিজের শক্তির বাইরে গিয়ে সব ব্যবসা করতে চায়। এটা উদ্যোক্তাদের ইগো সমস্যা। এতে গ্রুপের যে দুয়েকটা প্রতিষ্ঠান ভাল করছে সেগুলোর উপর চাপ আসে। নাভানা সে অবস্থায় ছিল। তবে গ্রুপটির চেয়ারম্যান ও ডিরেক্টররা বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন।"
তিনি আরো বলেন, "গ্রুপটি ব্যবসা পুনরুদ্ধারের জন্য পরিকল্পনা নেয়। তাছাড়া মার্কেটে গ্রুপটির সুনাম এবং সুযোগ রয়েছে। সেকারণে আমাদের মতো প্রফেশনালদের এখানে যোগ দেয়া। আমাদের লক্ষ্য গ্রুপটিকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া।"
নাভানা গ্রুপের চিফ হিউম্যান রিসোর্সেস অফিসার খন্দকার ইসতিয়াক মাহমুদ বলেন, "গত দুই দশকে ব্যবসার ধরন পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু এই পরিবর্তনের সাথে নাভানা গ্রুপ খাপ খাওয়াতে পারেনি। এর প্রধান কারণ এখানে যোগ্য ও সঠিক লোকের অভাব ছিল। এই গ্যাপটা পূরণ করা হচ্ছে আমাদের লক্ষ্য।"
তিনি আরো বলেন, "এজন্য আমরা চারটি প্রকল্প নিয়ে কাজ করছি। এর মধ্যে রয়েছে গ্রুপের মিশন, ভিশন, মূল্যবোধ (ভ্যালু) এবং নীতি (প্রিন্সিপাল) ঠিক করা, ব্যবসায়িক প্রক্রিয়ার রি-ইঞ্জিনিয়ারিং, দক্ষ জনশক্তি তৈরি এবং আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে গ্রুপের সব ব্যবসাকে প্রফিটেবল পর্যায়ে নিয়ে আসা।"
তিনি বলেন, "এই পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নের জন্য আমাদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। ২০২১ সালে যখন আমরা দায়িত্ব নেই তখন গ্রুপটি ডুবে ছিল। ২০২২ সালে এসে আমি বলতে পারি এটা ভেসে উঠছে।"
নাভানা গ্রুপ
নাভানা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা শফিউল ইসলাম কামাল দেশের অন্যতম শীর্ষ বিজনেস কনগ্লোমারেট ইসলাম গ্রুপের অটোমোবাইল খাতটি দেখাশোনা করতেন। ইসলাম গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন তার ভাই জহরুল ইসলাম। শফিউল ১৯৬৮ সালে ইসলাম গ্রুপে যোগ দেন। তার হাত ধরেই ইসলাম গ্রুপের অধীনে টয়োটা গাড়ির পরিবেশক নাভানা লিমিটেড এবং হিনো কমার্শিয়াল ভেহিকল ডিস্ট্রিবিউটর ও অ্যাসেম্বলার আফতাব অটো প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৯৫ সালে জহরুল ইসলাম মারা গেলে শফিউল ইসলাম কামাল ইসলাম গ্রুপ থেকে আলাদা হয়ে যান। ১৯৯৬ সালে তিনি নাভানা লিমিটেড এবং আফতাব অটো এই দুটি কোম্পানি নিয়ে নাভানা গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন।
বর্তমানে শফিউল ইসলাম নাভানা গ্রুপের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। তার ছেলে সাইফুল ইসলাম সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান এবং আরেক ছেলে সাজেদুল ইসলাম গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান পদে রয়েছেন। পরিচালক পদে দায়িত্ব পালন করছেন শফিউলের স্ত্রী খালেদা ইসলাম ও মেয়ে ফারহানা ইসলাম।
১৯৯৬ সালে শফিউল ইসলাম কামাল নাভানা রিয়েল এস্টেট লিমিটেড এবং নাভানা কনস্ট্রাকশন লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেন। এই কোম্পানিগুলো হাউজিং এবং কনসট্রাকশন খাতে ব্যবসা করছে।
এছাড়া তিনি কম্প্রেসড ন্যাচারাল গ্যাস (সিএনজি), অটোমোটিভ অয়েল, লজিস্টিক সার্ভিস, ফুড, ওয়েল্ডিং ইলেক্ট্রড, প্লাস্টিক, রিনিউয়েবল এনার্জি ইক্যুইপমেন্ট এবং সর্বশেষ এলপিজি ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন। ১৭টি কোম্পানির মাধ্যমে তিনি এই ব্যবসাগুলো পরিচালনা করছেন।
এদের মধ্যে আফতাব অটো ও নাভানা সিএনজি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত রয়েছে।
টেক্সটাইল এবং ট্যাক্সি-ক্যাব ব্যবসায়ও বিনিয়োগ করেছিলেন তিনি; কিন্তু লোকসানের কারণে সেটা ছেড়ে দেন।
ব্যবসা বাড়াতে গিয়ে তাকে ব্যাংক থেকে মোটা অংকের ঋণ করতে হয়। ২০১৯ সাল পর্যন্ত নাভানা গ্রুপের ১৭টি কোম্পানি ৩১টি ব্যাংক ও ১৯টি নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে মোট ৫,২৩৩ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে।
২০১৮ সালে চেয়ারম্যান অসুস্থ হয়ে পড়লে নাভানা গ্রুপের আর্থিক অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে। তার ছেলেরা তখন কোম্পানির দায়িত্ব নেয়। তারপরেই আসে কোভিড মহামারির ধাক্কা! গ্রুপের দুর্বল ব্যবসায়িক ব্যবস্থাপনা মহামারির আঘাত কাটিয়ে উঠতে ব্যর্থ হয়।
কী আছে ১০ বছরের পরিকল্পনায়
গ্রুপের কর্মকর্তারা জানান, রিয়েল এস্টেট এবং অটোমোবাইল নাভানা গ্রুপের মূল ব্যবসা। এর পাশাপাশি চলমান যে ব্যবসাগুলোতে ভাল সম্ভাবনা রয়েছে সেগুলোকে ঢেলে সাজানো হবে।
সিইও ওয়াহেদ আজিজুর রহমান বলেন, "একটা গ্রুপকে সব ব্যবসা করতে হবে এমন ধারণা থেকে আমাদের সরে আসতে হবে। যেটায় আমাদের সক্ষমতা নেই সে ব্যবসা আমাদের ছেড়ে দিতে হবে। যেখানে আমাদের বড় বিনিয়োগ রয়েছে এবং বাজারে সম্ভাবনা রয়েছে সে ব্যবসা আমরা ধরে রাখবো।"
গ্রুপটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রিয়েল এস্টেট এবং অটোমোবাইল খাতে ব্যাকওয়ার্ড এবং ফরোয়ার্ড লিংকেজে তারা বিনিয়োগ করতে চায়। পাশাপাশি টয়োটা এবং হিনো ভেহিকেলের ডিস্ট্রিবিউটর হিসেবে বাংলাদেশে অ্যাসেম্বল প্ল্যান্ট স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে গ্রুপটির।
ওয়াহেদ আজিজুর রহমান বলেন, "দেশে এই দুটি খাতের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। তাই এখানে আমাদের ব্যবসা করার ভাল সুযোগ আছে। তাছাড়া টয়োটা ও হিনোর ব্র্যান্ড ভ্যালুর কারণে এগুলোর চাহিদা রয়েছে।"
নাভানা গ্রুপ নতুন ব্র্যান্ডের টয়োটা গাড়ি বিক্রি করে। তবে দেশে সেকেন্ড হ্যান্ড এবং রিকন্ডিশনড গাড়ি এই বাজারের ওপর আধিপত্য বিস্তার করছে। পাশাপাশি উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হওয়ায় এখানে কমার্শিয়াল গাড়ির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
ওয়াহেদ আজিজুর রহমান বলেন, "শুল্ক ও ট্যাক্সের কারণে আমাদের কাছ থেকে গাড়ি কেনার খরচ বেশি পড়ে। সেজন্য বিশেষ করে, হিনো ব্র্যান্ডের ট্রাকের ব্যবসায় আমরা পিছিয়ে রয়েছি। এখানে সব ধরনের গাড়ি অ্যাসেম্বল করলে আমাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়বে।"
এদিকে বর্তমানে সিএনজি ব্যবসা নিম্নমুখী। নাভানার অধীনে বেশকিছু সিএনজি স্টেশন রয়েছে। তাদের ব্যবসাটিও ভাল যাচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে গ্রুপের সিইও বলেন, "অন্য দেশগুলোতে ফিলিং স্টেশনে ফুয়েলের পাশাপাশি বিভিন্ন সহায়ক ব্যবসা থাকে। যেমন- রেস্টহাউজ, সুপারশপ। কিন্তু আমাদের এখানে এগুলোর অনুমোদন দেওয়া হয় না। তারপরও আমরা সরকারের সাথে কথা বলে সেগুলো চালু করার চেষ্টা করবো।"
এলপিজি ব্যবসা নিয়ে তিনি বলেন, "আমাদের এখানে বাজারের তুলনায় কোম্পানির সংখ্যা বেশি। আর এই বাজারে তারা কেউই ভাল করছে না। তবে যেহেতু ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা রয়েছে আমরা সেটা করবো।"
গ্রুপের আর্থিক অবস্থা নিয়ে ওয়াহেদ আজিজুর রহমান বলেন, "ইতিমধ্যে আমরা বড় ঋণগুলো রিশিডিউল করেছি। পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদে অর্থায়নের জন্য আরো কিছু কোম্পানি শেয়ারবাজারে নিয়ে যাওয়া এবং বন্ড ছাড়ার পরিকল্পনা রয়েছে।"
এদিকে খন্দকার ইসতিয়াক মাহমুদ বলেন, "দশ বছর মেয়াদী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য যোগ্য ও দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। আমরা এমনভাবে সিস্টেমটি তৈরী করছি যেখানে কোনো কর্মী চাইলেও গ্রুপের কোন ক্ষতি করতে পারবে না।"