পণ্যমূল্যের অস্থিরতা সমাজের বিভাজনকে ক্ষমতা বদলের হাতিয়ারে রূপ দিবে
সময়ের ব্যবধানে হিসেব করলে এক শতাব্দীর হিসাব। বিগত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল।(১৯১৪-১৯১৮)। তার মাত্র দুই দশকের মাথায় দ্বিতীয়(১৯৩৯-১৯৪৫) বিশ্বযুদ্ধ ও পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্রের ব্যবহারও পৃথিবীবাসী দেখেছে । তারপরই দুনিয়ায় নতুন শান্তির আন্দোলন শুরু হয়েছিল ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরই যখন দুই পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের ক্ষমতার লড়াইকে ছড়িয়ে দেওয়ার উন্মত্ততায় লিপ্ত হয়ে বিশ্বকে বিভাজিত করল। গড়ে তুলল দুটি সামরিক জোট ন্যাটো, আর অন্যটি ওয়ারশ। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো এই দুই জোটের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে গড়ে তুলেছিল জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন। যুগোস্লাভিয়ার মার্শাল টিটোর নেতৃত্বে এ আন্দোলন যথেষ্ট শক্তি সঞ্চার করেছিল ।
কিউবার ফিদেল কাস্ত্রো, মিশরের আনোয়ার সাদাত, ভারতের ইন্দিরা গান্ধী- এরা সবাই ছিলেন সেই জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের নেতৃত্বে। ৫০-৭০ দশক পর্যন্ত শক্তিশালী অবস্থানে ছিল সেই জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন। কোরীয় ও ভিয়েতনাম যুদ্ধ- এ দুই যুদ্ধেই মার্কিনীদের ভূমিকার সমালোচনা করেছিল জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের তখনকার নেতৃত্ব।
এরপর বিশ্বে নতুন আরেক পরিবর্তন সূচিত হয় ৯০ দশকের শুরুতে; সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ভেতর দিয়ে ওয়ারশ জোটের পরিসমাপ্তি ঘটে। সাথে সাথে সেই জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনও তার গতি হারিয়ে ফেলে হারিয়ে যায়। মার্শাল টিটোর সেই যুগোস্লাভিয়া খন্ডিত হয়ে কয়েকটি রাষ্ট্রে পরিণত হয়। আজকের বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতিতে- পৃথিবীর স্বল্পোন্নত দেশ তথা সিংহভাগ দেশের বর্তমানের ইউক্রেন- রাশিয়ার যুদ্ধের সঙ্গে কোন সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও দেশগুলো তার পরিণতির শিকার হচ্ছে ।
দুই পরাশক্তির বিরোধের সূত্রে ইউক্রেন-রাশিয়ার মধ্যে সংগঠিত যুদ্ধে- এশিয়া, আফ্রিকা সর্বত্র অর্থনৈতিক সংকট তীব্রভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। রাশিয়া ও আমেরিকা পৃথিবীর প্রায় ৪০০-৫০০ কোটি মানুষকে খাদ্যের সন্ধানে নামতে বাধ্য করছে। জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের মতন একটি শক্তিশালী আন্দোলন আর কখনো গড়ে উঠবে না; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ওই ধরনের জোটের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার দ্বন্দ্ব- আজকে আমরা তার শিকার- এই যুদ্ধের কারণে আমাদের মতন দেশগুলো কিভাবে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা এখনই পরিষ্কার হবে না ।অন্যদিকে, দেশের অভ্যন্তরীণ সংকট এর পরিণতিতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে । কোনো কোনো ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সংকট ক্ষমতা হাতবদলের হাতিয়ার হবে। ইতিমধ্যেই আমরা তা শ্রীলঙ্কায় ঘটতে দেখছি। তেমনি সামনের কয়েক মাস যদি এই অর্থনৈতিক সংকটে খাদ্য মূল্য বাড়তেই থাকে- তাহলে বহু দেশেই তার প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। সেই ক্ষেত্রে দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ সমাজের যে বৈরিতা তার ব্যাপক প্রতিফলন ঘটবে। প্রতিবাদ ক্ষমতার হাতবদলের হাতিয়ারে পরিণত হবে।
তৃতীয় বিশ্বের দুর্বল গণতন্ত্রের দেশগুলোয় সেনাবাহিনী একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। আমরা দেখতে পাচ্ছি শ্রীলংকার সেনাবাহিনী কার্যকরভাবে সরকারের পক্ষ নিচ্ছে না জনগণের ক্ষোভের কারণে। আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের সেদিকে খুব জরুরি ভিত্তিতে মনোযোগ হওয়া দরকার। কারণ এর পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। আমরা দেখতে পাচ্ছি, আজকে শ্রীলংকার পরিণতি কোভিড-১৯ উত্তর দেশটি অর্থনৈতিক সংকট থেকে উদ্ভূত। তখনই জনমানুষের নানান সংকট সৃষ্টি হচ্ছিল । যে কারণে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ও সরকার বিরোধী মনোভাব জাগ্রত হচ্ছিল; তখন তার সঙ্গে যোগ হয়েছিল দেশটির কর্তৃত্ববাদী সরকারের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ।
দীর্ঘদিন যাবত কর্তৃত্ববাদী শাসনের শিকার হওয়ার ফলে সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠরা রাস্তায় নেমে পড়েছে । শ্রীলংকার এই উদাহরণ নিয়ে কথা বলছে পৃথিবীর নানান দেশের গণমাধ্যম। আমাদের দেশেও শ্রীলংকা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে । আমাদের দেশেও বর্তমান অবস্থা নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা চলছে। সরকারপক্ষ বলছেন, শ্রীলংকার মতন কোনো সংকট হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু প্রতি মাসে আমাদের যে বাণিজ্য ঘাটতি হচ্ছে- তা কীভাবে মোকাবেলা করা হবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাথে এক মত-দ্বৈততা দেখা গেছে। আমাদের সত্যিকারের রিজার্ভ কত তা স্পষ্ট নয়। বৈদেশিক মুদ্রার সঠিক পরিমাণ সত্যিকারভাবে প্রকাশ হওয়া দরকার। মানুষ যেন কোনো ভুল তথ্যের শিকারে পরিণত না হয়।
আশা করা যায়, আমরা নিশ্চয়ই শ্রীলংকার মতন অর্থনৈতিক সংকটে পড়ব না- কিন্তু আমাদের বিভাজিত সমাজ সেই সুযোগ নিবে কিনা সেটিও বড় প্রশ্ন! যেভাবে এ সঙ্কট মুহূর্তে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সামনে নিয়ে যে গণ কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে তা দেশকে নতুন বিভাজনের দিকে ঠেলে দিয়েছে । রিপোর্টের বহুকিছু সত্যতা থাকলেও, এটা তার সঠিক সময় নয় । দেশ এখন অন্য সংকটে সবাই উৎকণ্ঠিত। তেমনি একটি মুহূর্তে সরকারকে আরো বেশি সংকটের মুখে ঠেলে দেওয়া এই রিপোর্টের উদ্দেশ্য কিনা সেটিও ভেবে দেখার বিষয়।
যখন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা প্রচেষ্টা হিসেবে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্ষমতাসীন সরকার নানা উদ্যোগ নিচ্ছে তেমনি সময় আমরা এই রিপোর্টকে সময়োপযোগী নয় বলে মনে করছে দেশের বহু মানুষ। সবচেয়ে বড় কথা, এই সংকটময় মুহূর্তে সর্বোচ্চ সর্তকতা অবলম্বন করে মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে ।গনমাধ্যমের টকশোতে এর পক্ষ-বিপক্ষের মানুষদেরকে আরো বেশি সমঝোতার রাস্তায় যেতে হবে। পারস্পরিক আক্রমণের মাত্রা কমিয়ে, সমঝোতার রাস্তায় হাঁটতে হবে । জাতীয়ভাবে সমঝোতা গড়ে না উঠলে, এই সঙ্কট থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কোন সুযোগ আমাদের থাকবে না।
বিদ্যুৎ খাত নিয়ে, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে ব্যবসায়ী সমাজ সুস্পষ্ট মতামত রেখেছেন । ব্যবসায়ী সমাজের নেতৃবৃন্দ প্রায় সকলেই বর্তমান ক্ষমতাসীনদের অনুসারী, সেই সম্পর্কের কথা মাথায় রেখেই তাদের পরিস্থিতি মূল্যায়ন করতে হবে । গতকালকের গণমাধ্যমে দেখা গেছে, গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক সংস্থাগুলোর সুস্পষ্টভাবে তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির বিপক্ষে মত দিয়েছেন। এফবিসিসিআই প্রধান কুইক রেন্টালের বিরোধিতা করে এগুলো অনতিবিলম্বে বন্ধ করতে বলেছেন। কুইক রেন্টাল নিয়ে অনেক বছর ধরেই জনগণের মধ্যেও তীব্র সমালোচনা রয়েছে।
এদিকে চাকরিজীবীদের একাংশ বেতন বৃদ্ধির দাবি করছেন। সরকারি প্রতিষ্ঠানের বেতন বাড়ানো হয় সর্বত্র তার ব্যাপক প্রতিক্রিয়াও সৃষ্টি হবে- সে বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। মোদ্দা কথা দ্রব্যমূল্যই যদি নিয়ন্ত্রণে না থাকে তাহলে পরিস্থিতি দিন দিন আরও ভয়াবহ পরিণতির দিকেই যে এগিয়ে যাবে- তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক