গভীর রাতে মাওয়া ঘাটে, হামানদিস্তায় পদ্মার ইলিশ ভর্তা..আরও কত কী!
"বর্ষার মাঝামাঝি। পদ্মায় ইলিশ মাছ ধরার মরসুম চলিয়াছে। দিবারাত্রি কোন সময়েই মাছ ধরিবার কামাই নাই। সন্ধ্যার সময় জাহাজঘাটে দাঁড়াইলে দেখা যায়- নদীর বুকে শত শত আলো অনির্বাণ জোনাকির মত ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। জেলে নৌকার আলো ওগুলি। সমস্তরাত্রি আলোগুলি এমনিভাবে নদীবক্ষের রহস্যময় স্নান অন্ধকারে দুর্বোধ্য সঙ্কেতের মত সঞ্চালিত হয়। এক সময় মাঝরাত্রি পার হইয়া যায়। শহরে, গ্রামে, রেল স্টেশনে ও জাহাজঘাটে শ্রান্ত মানুষ চোখ বুজিয়া ঘুমাইয়া পড়ে। শেষরাত্রে ভাঙা-ভাঙা মেঘে ঢাকা আকাশে ক্ষীণ চাঁদটি উঠে। জেলে নৌকার আলোগুলি তখনো নেভে না। নৌকার খোল ভরিয়া জমিতে থাকে মৃত সাদা ইলিশ মাছ। লণ্ঠনের আলোয় মাছের আঁশ চকচক করে, মাছের নিষ্পলক চোখগুলিকে স্বচ্ছ নীলাভ মণির মত দেখায়।"- বাঙালির মানসপটে স্থায়ী দাগ করে নেয়া একটি দৃশ্য। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালজয়ী উপন্যাস পদ্মানদীর মাঝি-র প্রথম অনুচ্ছেদ।
নদী থেকে দূরে যাদের বাস তাদের কল্পনাতে হাহাকার জাগায় রাতের পদ্মার এই বর্ণনা। অদ্ভুত রূপ এই কীর্তিনাশার। দিনের আলোতে উত্তাল, সূর্যাস্তে ঝিলমিল আর পূর্ণিমার আলোতে স্বপ্নীল এক মুগ্ধতার সৃষ্টি করে পদ্মার ঢেউ। ঢাকা শহরকেন্দ্রিক যান্ত্রিক জীবনে হাপিয়ে উঠা রুটিনে দম ফেলার ফুসরত মিলতেই তাই শহরবাসীর প্রিয় গন্তব্যের তালিকায় থাকে পদ্মা পাড়ের মাওয়া ফেরি ঘাট।
রাতের মাওয়া ঘাটে এখন পদ্মানদীর মাঝি-র সেই জেলে ভিত্তিক নদী জীবনের দেখা মেলে না, বরং এক অন্যরকম উৎসবের পসরা সাজানো থাকে এই পদ্মার পাড়ে। ঢাকা থেকে মাত্র আধাঘন্টার দূরত্ব হওয়ায় চাইলেই রাত -বিরাতে দলববেঁধে উপস্থিত হওয়া যায় সেই উৎসবে সামিল হতে। মেঘলা বাতাস, পূর্ণিমার চাঁদ বা তাজা ইলিশ ভাজাকে উপলক্ষ করে এই উৎসবে সামিল হতে পারেন আপনিও।
দলবেঁধে কোনো এক রাতে গাড়ি, বাইক বা পাবলিক বাসেই রওনা হতে পারেন মাওয়ার পথে৷ ঢাকার প্রায় সব এলাকা থেকেই মাওয়া ঘাট পর্যন্ত বাস আছে৷ তবে মধ্যরাতের দিকে নিশ্চিত বাস পেতে হলে শুরুতে গুলিস্তান বা যাত্রাবাড়ী চলে যাওয়াই ভালো। রাত ১২টা পর্যন্ত একটু পর পর এখান থেকে মাওয়াগামী বাস পাবেন আপনি৷ ১০০ টাকার মতো লাগবে জনপ্রতি বাস ভাড়া। শুনশান এক্সপ্রেসওয়েতে বাসে উঠেই পেতে পারেন বিমানের ছোঁয়া!
মধ্যরাতে আশেপাশের সব যখন অতল ঘুমে নিরব হয়ে যায় তখনো মাওয়া ফেরিঘাটে থাকে জমজমাট পরিবেশ৷ সকল বয়সের মানুষের উচ্ছ্বল আড্ডায় মুখরিত থাকে নদীর পাড়৷ হোটেলগুলোতে চলতে থাকে মাছ কেনা-বেচা, কাটাকুটি আর ভাজাভাজির ব্যস্ততা। ফেরিঘাটের পরিবেশ দেখে ভুলেই যেতে পারেন ঘড়ির কাঁটার এগিয়ে চলা সময়কে। জনারণ্যে ঘেরা এই মাওয়া ঘাটে তাই নিরাপত্তার ভয় নিয়ে ভাবতে হয় না।
ফেরিঘাটের পাশেই খোলা জায়গায় টেবিল পেতে আছে বেশ কিছু অস্থায়ী খাবার হোটেল৷ নদীর পাড় ঘেঁষে আছে আরো কিছু স্থায়ী হোটেল। নদীর বাতাস উপভোগ করতে করতে আড্ডা দেওয়ার জায়গা চাইলে সবচেয়ে ভালো হয় পানির কাছের ভাতের হোটেলগুলো। জানালা দিয়েই সেখানে দেখা যায় নদীর সৌন্দর্য। পূর্ণিমা রাতে নদীর পানিতে চিকচিক করতে থাকা চাঁদের আলো সৃষ্টি করে এক ঐন্দ্রজালিক মুহূর্তের।
পদ্মার তাজা ইলিশ মাওয়া ঘাটের হোটেলগুলোর প্রধান আকর্ষণ৷ তবে আসল ইলিশের স্বাদ পেতে হলে নিজে দেখেশুনে ইলিশ কিনে নেওয়াই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। আকৃতি আর ওজন অনুযায়ী প্রতি পিস ইলিশের দাম পড়বে ৮০০-১০০০ টাকা। সিজনভেদে হতে পারে দামের ওঠানামা। চাইলে পিস হিসেবেই বাছাই করে নেওয়া যায় ইলিশ। দাঁড়িয়ে থেকে তদারকি করে সরষের তেলে ইলিশ ভাজিয়ে নিতে পারেন। বিশাল তাওয়ায় হাতা-খুন্তি নেড়ে নিজেও রান্নার স্বাদ নিতে পারবেন।
মাওয়াঘাটের সবচেয়ে বিশেষ খাবার হলো হামানদিস্তায় পিশে বানানো ইলিশের লেজ ভর্তা। সাথে গোল গোল বেগুনভাজা। এছাড়াও আরো অনেক পদের ভর্তা পাবেন এখানে। আছে অন্যান্য মাছও। ভাত-মাছ ছাড়াও পাবেন মুরগি, ডিম, চিংড়ি বা ডালের পদ। অবশ্য গরম গরম ভাতের সাথে সরষের তেলে ইলিশ ভাজা, ইলেশের লেজভর্তা আর বেগুন ভাজার কাছে অন্য সব পদ বাহুল্যই মনে হবে৷
ইলিশ দিয়ে উদরপূর্তির পর ফেরিঘাটের মালাই চায়ের সাথে চলতে পারে অবিরাম আড্ডা। সারারাতই কিছুক্ষণ পর পর ফেরি পারাপার হয় পদ্মায়৷ চাইলে এই ফেরিতে উঠে পদ্মা পাড়ি দেওয়া যায়। পূর্ণিমার চাঁদ বা আকাশ ছেয়ে থাকা তারা দেখতে দেখতে ঘন্টাখানেকের ফেরি ভ্রমণ চোখের পলকেই কেটে যাবে। মাঝে বিশাল পদ্মা সেতুর দেখাও মিলবে।
নদীর তীরে ভোরের নির্মল পরিবেশ উপভোগ করা যায় ওপাড়ে বসেই৷ আবার হাঁটতে হাঁটতে হারিয়ে যাওয়া যায় কোনো গ্রামের ভেতর। ট্রলার নৌকা ভাড়া করে ঘুরে আসা যায় পদ্মার চরে। সকাল ৭টার পর থেকেই লঞ্চ চালু হয় নদীতে। ফেরার পথে আসতে পারেন লঞ্চের ছাদে করে।
ভোর বেলায় পদ্মানদীর মাঝিদের কাছ থেকে সরাসরি দেখে কিনে নিতে পারেন ইলিশ মাছ। ঢাকার যান্ত্রিক জীবনে ফিরে আসার আগে মুন্সিগঞ্জের ভাগ্যকূলে বা লৌহজং-এ বিখ্যাত মিষ্টির দোকানে গিয়ে ঘোল-মিষ্টি খেয়ে আসার পরিকল্পনা রাখা যায়। মিষ্টি প্রেমীদের জন্য এখানকার মিষ্টি খাওয়া ছাড়া ঢাকায় ফিরে যাওয়া পাপ!
সারারাত ধরে এই টানা অভিযানে ক্লান্ত হয়ে গেলে পদ্মা পাড়ে অবশ্য থাকার ব্যবস্থাও আছে। আরামপ্রিয় ভ্রমণার্থীরা চাইলে পদ্মা রিসোর্ট বা মাওয়া রিসোর্টে গিয়ে জিরিয়ে নিতে পারবেন।
হুটহাট প্রিয়জনদের সাথে একদিন বা একবেলার ভ্রমণের জন্য ঢাকার কাছে মাওয়াঘাটের বিকল্প বোধহয় কিছু নেই। পদ্মার পাড়ের এই এলাকায় প্রতিবার ভ্রমণে আপনার নতুন অভিজ্ঞতা জন্মাবে। কিছুদিন পরই রাতের মাওয়া ভ্রমণে যোগ হবে নতুন আকর্ষণ, পদ্মা সেতুতে দাঁড়িয়ে পূর্ণিমার চাঁদ দেখা!