তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন গমের মজুদ, আর তা চালের জন্যও শুভ নয়
কমছে দেশে গমের মজুদ, বর্তমানে যা রয়েছে তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে। ফলে ভোক্তারা আরও বেশি চালের প্রতি ঝুঁকবে; তাতে প্রধান এই খাদ্যের ওপর গুরুতর চাপও সৃষ্টি হবে।
বর্তমানে বাংলাদেশের কাছে এক লাখ টন গম রয়েছে, যা আগের বছরের একই সময়ের মজুদের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ।
চালের মজুদ নিয়ে এখনও স্বস্তিকর অবস্থানে সরকার, তবে নতুন ভোক্তা যোগ হলে চালের চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে এর ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, গত ২২ মে পর্যন্ত সরকারের কাছে মোট ১১.৫৯ লাখ টন খাদ্যশস্য রয়েছে। এর মধ্যে ১০.৫১ লাখ টন চাল এবং মাত্র ১ লাখ টনের কিছু বেশি গম রয়েছে। গত বছরের একই সময়ে চাল ও গমের মজুদ যথাক্রমে ছিল ৪.৫ লাখ ও ২.৯১ লাখ টন। দুই বছর আগে গমের মজুদ ছিল ৩.৬০ লাখ টন।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে ৬৩ শতাংশ সরবরাহ উৎস দেশ থেকে সংগ্রহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, ক্রমে ফুরিয়ে আসা গমের মজুদ উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের গম আমদানির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সরকারি আমদানি স্বাভাবিক থাকলেও- বেসরকারি আমদানি কমেছে।
চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে গম আমদানি হয়েছে ৩৪.৫৮ লাখ টন; যার মধ্যে সরকার করেছে ৪ লাখ ৪৪ হাজার টন এবং বেসরকারি খাত বাকি ৩০ লাখ ১৩ হাজার টন।
গত অর্থবছরে সরকারি আমদানির পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ৭৮ হাজার টন এবং বেসরকারি পর্যায়ে ৪৮ লাখ ৬৪ হাজার টন আনা হয়। অর্থাৎ, চলতি অর্থবছরে গত ২০২০-২১ অর্থবছরের চেয়ে বেসরকারি পর্যায়ে ১৮ লাখ টন কম আমদানি করা হয়েছে।
এ বাস্তবতায় গম আমদানি বাড়ানোর ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। ভারত ১৩ মে গম রপ্তানি নিষিদ্ধ করে, তবে প্রতিবেশী বাংলাদেশের জন্য সরকার-টু-সরকার (জিটুজি) চুক্তির মাধ্যমে আমদানির একটি সুযোগ খোলা রেখেছে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে ইতোমধ্যেই ভারতের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।
গণমাধ্যমের সাথে আলাপকালে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, তারা ভারত থেকে ১০ লাখ টন গম আমদানির চেষ্টা করছেন।
এরমধ্যেই পাউরুটি, বিস্কুট, নুডলসসহ গম ব্যবহার করে খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্পে যত ধরনের পণ্য তৈরি হয় তার সবগুলোর দামই বেড়েছে, গমের মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কায়। খোলা আটার দাম ৩৬ টাকা থেকে বেড়ে ৪৬ টাকায় উঠেছে। পরোটা, রুটিসহ সব ধরনের ফ্রোজেন বা হিমায়িত খাদ্যের দাম বেড়েছে, যার চাপ পড়ছে ভোক্তাদের পকেটে। খাবারের পেছনে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সীমিত আয়ের মানুষ অনেক ক্ষেত্রে খাওয়া কমিয়ে দিচ্ছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, গমের আটা-ময়দা থেকে তৈরি পণ্যগুলোর দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ভোক্তাদের একটি শ্রেণি এসব খাওয়া কমিয়ে দিবে। তখন তারা হয়তো ভাত খাওয়ার পরিমাণ কিছুটা বাড়িয়ে দেবে।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম খান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, এই দেশের মানুষের প্রধান খাবার যেহেতু চাল, সেহেতু মানুষ বিকল্প পণ্যের ভোগ কমিয়ে দিলে তারা ভাতেই ফিরবে। তবে কতোটা চাপ তৈরি হতে পারে সেটা গবেষণার বিষয় এবং এ বিষয়ে প্রস্তুতিরও দরকার আছে।
গত বছর বোরো মৌসুম শেষ হওয়ার পর পরই চালের দাম বেড়ে যায়। এই দাম কমাতে না পেরে সরকার বেসরকারি খাতে ২০ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছিল। এবারও পরিস্থিতি একই দিকে যাচ্ছে। একেবারে ভরা মৌসুমে চালের দাম বাড়ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার এখনও আমদানির কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ- ইউএসডিএ'র সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরে ৩ কোটি ৬০ লাখ টন চাল উৎপাদন হওয়ার প্রক্ষেপণ রয়েছে। গত বছরে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, ৩ কোটি ৭৬ লাখ টন চাল উৎপাদনের কথা বলা হয়েছে।
তবে হাওড়ে আগাম বন্যা ও ঝড়-বৃষ্টির কারণে ধানের উৎপাদন কিছুটা কমে যাওয়ারও শঙ্কা রয়েছে বোরো মৌসুমে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর চলতি বোরো মৌসুমে ২.৮ কোটি টন উৎপাদনের প্রাক্কলন করেছে।
কৃষিমন্ত্রী ড. মো আব্দুর রাজ্জাক অবশ্য এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন, চলতি বছর বোরো ধানের উৎপাদন কমবে না।
তবে জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, চালের উৎপাদন এবছর যদি গত বছরের সমানও হয়, তাতে খুব একটা স্বস্তির সুযোগ নেই। কারণ গমের ভোক্তারা যদি ভাত বেশি খায়, তাহলে চালে ঘাটতি তৈরি হবে।
এই পরিস্থিতিতে, স্থানীয় বাজারে চালের মূল্য আরও বাড়তে পারে। তখন বাড়তি চাপ সামলানোর জন্য আগেভাগেই আমদানির বিকল্প থাকবে না বলে উল্লেখ করেন তিনি।
'মজুদ কমলেও কোনো সমস্যা হবে না'
খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. শাখাওয়াত হোসেন টিবিএসকে বলেন, "ইতোমধ্যে ভারত থেকে ১ লাখ টন গম চট্টগ্রাম বন্দরে পৌছেছে। আরও এক লাখ টনের ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়েছে, এটাও দ্রুতই চলে আসবে। অন্যান্য দেশ থেকে আরও ১ লাখ টন গম আমদানি প্রক্রিয়াধীন আছে। সুতরাং স্টক কমে গেলেও সেখানে এখন আর কোনো সমস্যা দেখছি না। কারণ পাইপলাইনে আরও তিন লাখ টন গম রয়েছে।"
আমদানিকারকরা বলছেন, যুদ্ধের কারণে দাম বেড়ে যাওয়ার পরও ভারত থেকে গম আমদানি হয়েছে প্রতিটন ৪০০ ডলারের নিচে; কিন্তু বিকল্প উৎস হিসেবে তারা কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র সংগ্রহ করতে গেলেই দাম পড়ছে ৫৫০ ডলারের কাছাকাছি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে এক বছরে গমের দাম ৭৫ শতাংশ বেড়ে প্রতিটন ৫০৬ ডলারে বিক্রি হচ্ছে।
মেঘনা গ্রুপের অ্যাসিসটেন্ট জেনারেল ম্যানেজার মো. তসলিম শাহরিয়ার টিবিএসকে বলেন, সাধারণত যখন কোনো পণ্যের দাম বাড়ে, তার আমদানি কম হয়। বাংলাদেশের তিন দিকেই ভারতের সাথে সীমান্ত থাকায়, অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলেও গম আসে।
যুদ্ধের কারণে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে আমদানির জন্য খোলা এলসি বাতিল হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, "মেঘনা গ্রুপের এরকম কোনো ইস্যু ছিল না। কিন্তু, কিছু কোম্পানির এরকম হয়েছে বলে শুনেছি।"
গত তিন মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে কম হয়েছে গমের আমদানি
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ট্টগ্রাম ও বেনাপোল বন্দর দিয়ে গম আমদানির তথ্য বিশ্লেষণ করেছে টিবিএস। এতে দেখা যায়, যুদ্ধ শুরুর পরের এই তিন মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে সাড়ে তিন লাখ টন গম কম এসেছে।
উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের (চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর) তথ্য বলছে, যুদ্ধ শুরুর (২৫ ফেব্রুযারি) পর থেকে চলতি মে মাসের ২৩ তারিখ পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৮.১ লাখ টন গম আমদানি হয়েছে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে।
অন্যদিকে, বেনাপোল বন্দর দিয়ে ১৮ মে পর্যন্ত তিন মাসে ৩৮ হাজার ৫৮২ টন গম আমদানি হয়েছে। এর পর থেকে বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারত থেকে গম আসছে না বলে জানা গেছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে সাড়ে ৮ লাখ টন গম আমদানি হয়েছে, যেখানে ১২ লাখ টনের বেশি দরকার। একইসময়, গত বছরের বড় দুটি উৎস রাশিয়া-ইউক্রেন থেকে কোনো গমের চালান আসেনি।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্ধরে ভারত থেকে কয়েকটি গমের চালান এসেছে। এর মধ্যে দুই জাহাজে ভারত থেকে এসেছে এক লাখ টনের বেশি গম।
গত দুই সপ্তাহে আমদানি হয়ে আসা গমগুলো এনেছে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের প্রতিষ্ঠান বিএসএম গ্রুপ, রাজশাহীর নাবিল গ্রুপ এবং বসুন্ধরা গ্রুপ। তারা কানাডা ও অষ্ট্রেলিয়া থেকে গম আমদানি করেছে।
উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের (চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর) উপপরিচালক মো. নাসির উদ্দিন বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে ইতোমধ্যে ৬টি জাহাজ গম খালাসের কাজ করছে। আরো কয়েকটি জাহাজ গম নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে আসার কথা রয়েছে।
গম আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী বলেন, ভারত গম আমদানি বন্ধ ঘোষণার পর এপর্যন্ত প্রায় তিন লাখ টন গম এসেছে। আরো কিছু গম আমদানির পথে রয়েছে। ফলে বুকিং দর বৃদ্ধির কারণে গমের দাম কিছুটা বাড়তি থাকলেও- সরবরাহ ঘাটতি তৈরি হবে না।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের তথ্যে জানা গেছে, চীন মজুদ বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের খাদ্যশস্যের মজুদ বাড়াচ্ছে। অন্যদিকে, ভারত স্থানীয় বাজারে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে গম রপ্তানি বন্ধ এবং চিনির রপ্তানি সংকুচিত করার ঘোষণা দিয়েছে।
বাংলাদেশ গমের মত চাল আমদানির ক্ষেত্রেও ভারতের উপর নির্ভরশীল। সেক্ষেত্রে ভারত যেভাবে নিজেদের মজুদ সুরক্ষিত রাখতে একের পর এক রপ্তানি বন্ধ করছে- তাতে করে দরকার পড়লে ভারত থেকে সহজে চাল আমদানি করা যাবে কিনা তা নিয়েও শঙ্কা তৈরি রয়েছে।