ফায়ারপান খান সাহস বাড়ান!
পুরান ঢাকার কাচ্চি বিরিয়ানি, বা মোরগ পোলাওয়ের তো কোনো জবাব নেই। আর এসব খাওয়ার পর এক খিলি মিষ্টি পান- রীতিমতো বাঙালির ঐতিহ্য। আর ধরুন, সেটা যদি হয় আগুন দেওয়া মিষ্টি পান, তাহলে?
মিষ্টি সুপারি, সাদা খোরমা, মোরব্বা, মিষ্টি গুঁড়া মৌরী, খোরমা ও মিক্স, নারকেল জিরা, নানা ধরনের মিষ্টি জিরা, চকলেটসহ প্রায় ৪০ রকমের মশলায় তৈরি এ পানটি ২০০১ সালে বাংলাদেশে প্রথম প্রচলন করেন পুরান ঢাকার অধিবাসী মো. জাবেদ নামে এক ব্যক্তি। বেশ কম বয়সেই তিনি পানের ব্যবসা শুরু করেন। তার ফায়ার পান বা আগুন পান অন্য যেকোনো ধরনের মিষ্টি পানের তুলনায় খিলি প্রতি ৫০ ও ১০০ টাকা করে বিক্রি হয়। এ পান দামে আলাদা, স্বাদেও আলাদা।
কীভাবে? পান পাতার ওপর একে একে প্রায় ৪০ ধরনের উপকরণ দেওয়া শেষে, সেগুলোর ওপর গ্লিসারিন পার পটাশিয়াম ও পানির মিশ্রণ ছড়িয়ে দেওয়া হয়। পরে লাইটার দিয়ে ধরিয়ে দেওয়া আগুন জ্বলে ওঠার পর পান ভাঁজ করে তা পরিবেশন করেন ক্রেতাদের। অর্থাৎ মুখে পুরে দেন।
যদিও শুরুতে কিন্তু আগুন পান তৈরির ক্ষেত্রে এ মিশ্রণ দেওয়ার পদ্ধতি ছিল না, জানালেন জাবেদ। সেসময় ভারত থেকে একধরনের লবঙ্গ এনে দেয় তার এক আত্মীয়। ওই লবঙ্গের ভেতরই দাহ্য কোনো পদার্থ থাকত, যা জ্বালানোর মাধ্যমে এই আগুন পান তৈরি করে সবাইকে চমকে দেন তিনি। তারপর থেকেই তার আগুন পানে ফেরি শুরু।
এরপর একে একে আগুন পান পুরান ঢাকার অলিগলিতে ছড়িয়েছে। তার দেখাদেখি আরও অনেকেই ফায়ার পানের দোকান সাজিয়ে বসেছে।
যদিও জাবেদের দাবি, অন্য যেকোনো জায়গায় বানানো পানের তুলনায় তার আগুন পানের স্বাদ অন্যরকম। তার পানের স্বাদ, গন্ধ ও আকৃতি সবই অন্যরকম। আর আলাদা হওয়ার কারণও ব্যাখ্যা করলেন জাবেদ: 'তিনি যে পান বিক্রি করেন, তা তৈরি করেন চুয়াডাঙ্গার বিখ্যাত সাঁচি পান দিয়ে। অন্য এলাকার পানের চেয়ে এ পানের আকৃতি কিছুটা ছোট, আবার ঘ্রাণও অনেক বেশি। ফলে আগুন দেওয়া হলেও ধোঁয়া ধোঁয়া ভাবটাও তার পানে বেশ কম।' এছাড়া জিহ্বা ভারীও হয় না, মুখে দেওয়ার কিছুক্ষণের ভেতরই পান সুন্দরভাবে মিলিয়ে যায় বলেও জানালেন জাবেদ।
তার সঙ্গে একমত প্রকাশ করে পুরান ঢাকার বাসিন্দা জালাল উদ্দিন বলেন, 'আশেপাশের সব এলাকার আগুন পানের তুলনায় জাবেদের আগুন পানের স্বাদ অনেক বেশি ভালো। মজাদার। জিহ্বা ভারী হয় না, পানের একটা সুন্দর ঘ্রাণও রয়েছে।'
পানের স্বাদ নিতে সুদূর সাভার থেকে এসেছিলেন রিপন নামে এক ব্যক্তি, পেশায় তিনি গাড়িচালক। তিনি বলেন, 'গাড়ির মালিককে নিয়ে এসেছি একটা কাজে। এদিকটায় খুব ভালো আগুন পান পাওয়া যায় শুনে আর লোভ সামলাতে পারলাম না। অন্য জায়গায় এর আগেও আগুন পান খেয়েছি, তবে এই পানের স্বাদ একদম আলাদা। মুখে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে গেল।'
রিপন যখন তার পান খাওয়ার অভিজ্ঞতা জানাচ্ছেন তখন মাত্র দোকান খুলে বসেছেন জাবেদ, মানে জাবেদ মামা। তার দোকানের নাম জাবেদ মামার শাহী মিষ্টি পান। জাবেদের দোকান খুলে সকাল দশটায়। তবে পুরান ঢাকার অন্য দোকানগুলো খোলে বিকালে।
জাবেদও জানালেন আশপাশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা আসতে শুরু করে সন্ধ্যার দিকে। ফায়ার পানের ম্যাজিক পুরান ঢাকাবাসীর কাছে অনেকটা ফিকে হয়ে গেলেও, দূরদূরান্ত থেকে খেতে আসে প্রচুর সংখ্যক খদ্দের। মেয়েদের কাছে জ্বলন্ত আগুন পান মুখে দেওয়াটা বেশ সাহসী একটা ব্যাপার। অনেকটা যেন এরকম- 'আগুন পান খান, সাহস বাড়ান!'
১৯৮৭ সালের দিকে পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডে ঐতিহ্যবাহী 'নিরব হোটেল' এর পাশে ফুটপাতে মিষ্টি পানের দোকান দেন মো. জাবেদ। কাছেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) হওয়ায় খুব দ্রুত তার জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের এলাকাগুলোয়। হোটেলে খাওয়া শেষে আড্ডা দিতে দিতে একটা মিষ্টি স্বাদের আগুন পানের লোভ সামলানো অনেকের জন্যই সহজ না।
নিরব হোটেলে এক সময় সুলভে হরেক রকম ভর্তা ভাজির পাওয়া যেত বলে খুব অল্প সময়েই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের কাছে। লোকজনের মুখে মুখে ছিল এই হোটেলের নাম। এর পাশেই জাবেদরে পানের দোকান। ফলে তার মিষ্টি ও আগুন দিয়ে পানও সবার মন জয় করতে খুব একটা সময় লাগেনি জাবেদ মামার।
সাধারণ মিষ্টি পান থেকে শুরু করে স্পেশাল শাহি পান, কাঁচা বাদাম মিষ্টি পান, জাফরান শাহি পানই ছিল তার শুরুর দিকের মূল আকর্ষণ! দামেও বরাবরই সাশ্রয়ী তার পান। সাধারণ মিষ্টি পানের দাম ১০ টাকা, আর স্পেশাল মিষ্টি পান ১৫ টাকা। এছাড়া ৫০ ও ১০০ টাকায় মিলবে তার বিখ্যাত কাঁচা বাদাম মিষ্টি পান ও জাফরান পান। আগুন পান সর্বোচ্চ ১০০ টাকা। ৫০ টাকায় পাওয়া যায় যে আগুন পান, তাতে মশলার কমতি থাকে মূলত।
গত ৩০ বছর ধরে জাবেদের হাতের মিষ্টি পান খাচ্ছি। সকাল সকাল নাশতা সেরেই তার হাতে বানানো এক খিলি মিষ্টি পান খাওয়ার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ি, এমনটি জানালেন জালাল উদ্দিন নামে ওই ক্রেতা।
কিছুক্ষণ পর দেখা মিলল জাবেদের আরেক কাস্টমারের। ওই নারীর মতে, সকালবেলায় জাবেদের মিষ্টি পান ছাড়া দিনের শুরুটা তার একেবারেই ভালো হয় না।
নিরব হোটেলের সেই রমরমা নেই। জাবেদের পানের দোকানেরও আগুন পান ক্রেতা হারিয়েছে অনেক। আগে এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে সুখেই কাটছিল জাবেদের। তবে করোনাভাইরাসের কারণে ব্যবসায় ধ্স নামে। মাঝখানে একটু চাঙা ভাব আসছিল, কিন্তু এরইমধ্যে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা- ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে দুর্মূল্যের বাজারে ক্রেতার সংখ্যা অনেকটাই কমে গেছে, আর মালিকানা বদলসহ বিভিন্ন কারণে নিরব হোটেলের সেই সুদিনও আর নেই, তাই তাদের ব্যবসায়ও ক্রেতা কমেছে।
জাবেদ কিছুটা আক্ষেপের সঙ্গেই বললেন, 'বছর তিনেক আগেও যেখানে দিনে ৫/৬ হাজার টাকার পানই বিক্রি করতাম; সেখানে দিনে ১৫শ' টাকাও আয় নেই এখন।' দুই ছেলে-মেয়ের পড়াশোনা, দোকান ভাড়া সবকিছু মিলিয়ে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। সঙ্গে মাসে প্রায় ৭ হাজার টাকা দোকানভাড়া তো রয়েছে। তাই পানের পাশাপাশি ব্যবসা চালানোর জন্য বিক্রি করছেন কোল্ড ড্রিঙ্কস, বিস্কুট, চিপসও। দিনশেষে এনিয়ে কিছুটা কষ্টে থাকলেও হতাশ নন জাবেদ। আশা এ অবস্থা থেকে খুব দ্রুত বেরিয়ে আসতে পারবেন তিনি।
নাজিরাবাজারের কাজী আলাউদ্দিন রোডেও গড়ে উঠেছে কিছু ফায়ার পানের দোকান। এখানকার চিত্র খানিকটা ভিন্ন। ব্যস্ত রাস্তার ধারে হওয়ায় বেশ ভালোই চলছে `আল্লাহর দান, জলিলের মিষ্টি পান'- নামের ফায়ার পানের একটি দোকান। এ দোকানের কর্মচারী মো.শাহাদাত হোসেন জানান, তিনিসহ দোকানটিতে রয়েছে আরও ৪ কর্মচারী। সারাদিন মিষ্টিপানের চাহিদা থাকলেও বিকেল থেকেই মূলত শুরু হয় আগুন পানের বিকি-কিনি, তখন পান বিক্রি করে কুলিয়ে ওঠা যায় না।
বিপরীত দিকে থাকা সিক্কাটুলী রোড ধরে কিছুটা সামনে এগিয়ে গেলেই পাওয়া যাবে কাশ্মীরি মিষ্টি পানের দোকান। এ দোকানেও বিকেলের পর থেকে পাওয়া যায় আগুন পান।
তবে আগুন পান মানেই যে মজার, বিষয়টি এমন নয় বলে জানালেন নাফিসা তাসমিম নামে একজন। তার মতে, 'আগুন দেওয়া পান খাওয়ার বিষয়টি অবশ্যই সাহসের! সাহস বাড়াতে এ পান খাওয়াই যেতে পারে (হাসি)। তবে কিনা পানের প্রকৃত স্বাদের এ পানে হারিয়ে যায়, প্রবল মিষ্টিভাবটাই এতে বেশি।' বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে এসে পানটি খেয়ে কিছুটা হতাশার কথাই জানালেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের এ শিক্ষার্থী।
জাবেদের দাবি অনুয়ায়ী, ২০০১ সালের দিকে প্রথম আগুন পানেরর দেখা মিললেও ব্যাপকভাবে দেশে এ পানের প্রচলন শুরু হয় ২০১৮ সালেরদিক থেকে। ফায়ার পানসহ অন্য সব পানেরই মশলার বেশিরভাগ আমদানি হয় ভারত থেকে।
পার্শ্ববর্তী ভারত ও পাকিস্তানেও এ পানের জনপ্রিয়তা রয়েছে। ভারতের গুজরাটের রাজকোটে 'গ্যালাক্সি পান শপ' নামে বিখ্যাত একটি পানের দোকানে প্রথম উদ্ভাবন করা হয় বিশেষ এ আগুন পান। প্রেম তারওয়ানি নামে দোকানটির মালিক হিস্টোরি ইন্ডিয়া ডটকমকে জানান, ব্যবসার উদ্দেশে ভাইসহ মুম্বাইয়ে গিয়ে একবার বেশ কয়েক ধরনের অ্যালকোহলের মিশ্রণ বাককটেলে আগুন দিয়ে পরিবেশনা দেখতে পান। অ্যালকোহল জাতীয় পদার্থ যদি আগুন দিয়ে পরিবেশন করা যায়, তবে পান নয় কেন!- এরকম একটি ভাবনা তাদের মাথায় আসে। এরপর ৪৫ দিন ধরে পুরো পরিবার মিলে ব্যাপক গবেষণা শেষে তারা তৈরি করেন আগুন পান।
তবে সেইসময় পানটির মুখ আটকানো হতো লবঙ্গ দিয়ে। পানটি অল্প কিছুদিনেই এতো জনপ্রিয়তা পায় যে, এ পানের স্বাদ নিতে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসতে থাকে।
পাকিস্তানেও দারুণ জনপ্রিয় আগুন পান। বরং পাকিস্তান যেন আরো এক কাঠি উপরে, তারা আগুনের সঙ্গে যোগ করেছেন বরফ। আগুন ও বরফের সংমিশ্রণে তৈরি আইস-ফায়ার পান।
ঢাকার আগুন পানের বাইরে দোকানে আরও হরেক রকমের পান থাকে: দিলখোশ পান, শাহি পান, বেনারসী পান, বউ-জামাই পান, মুম্বাই পান, কস্তুরী পান, কা্শ্মীরি মাসালা পান, চুইংগাম পান, বরফি পান, টক-ঝাল-মিষ্টি পান, ভ্যানিলা পান, চকলেট পান, স্ট্রবেরি পান, দিল্লি জেলি পান কী নেই! নাম শুনেই বেশির ভাগ পানের উপাদান কি বোঝা যাচ্ছে। এসব পানের একটা বৈশিষ্ট্য হলো এগুলো ঝাল পান বাদে সবই তীব্র মিষ্টি পান। এসব পানের দাম ১৫ টাকা থেকে শুরু ১৫০ টাকা সর্বোচ্চ।
আগুন পানের পর সবচেয়ে বেশি চাহিদা বউ-জামাই পানের। ৫০ টাকা মূল্যের এ পান দোকানীরা মশকরা করে বলেন, তাদের এ পান নব-দম্পতিদের জন্য। আগুন পানের বাইরে ১৫ টাকার সাধারণ `দিলখোশ পান' বা ২০ টাকার `শাহি পানের' চাহিদা থাকে সারাবছরই।