দক্ষিণ এশিয়ায় অর্থনৈতিক তারকাখ্যাতির দৌড়ে যেভাবে ভারতকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ
আর্থ-বার্ষিক পরিকল্পনা ও দেনা ব্যবস্থাপনায় ২০০৯ সাল থেকে সতর্ক রয়েছে বাংলাদেশ, আর তাতে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে পেরেছে। একইসঙ্গে, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর কলেবর আর অবকাঠামো প্রকল্পে বিনিয়োগও বেড়েছে।
গত ৪০ বছর ধরে ধারাবাহিকতা রক্ষা করে হচ্ছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং মোট দেশজ উৎপাদন প্রবৃদ্ধিতে পুরো দক্ষিণ এশিয়ার চেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ২০২০ সালে এ অঞ্চলে সার্বিকভাবে জিডিপি সংকোচন হয় ৬.৫৮ শতাংশ, তখন বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৩.৫ শতাংশ।
এক সময় বাংলাদেশের মোট জিডিপিতে এক-তৃতীয়াংশ অবদান ছিল কৃষির, ২০১০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে তা ১৫ শতাংশেরও নিচে নেমে আসে। একইসময়ে শিল্প খাতের অবদান এক-পঞ্চমাংশের কম থেকে দৃঢ় উত্থান নিয়ে এক-তৃতীয়াংশে পরিণত হয়।
১৯৮০'র পর থেকে জিডিপিতে প্রস্তুতকারক শিল্পের অবদান দ্বিগুণ হয়েছে। ১৯৯০ এর দশকের পর থেকে রপ্তানি ২০গুণ বেড়ে হয়েছে ৪ হাজার কোটি ডলারের বেশি। স্বল্প মজুরিতে কাজ করা শ্রমিকদের পাঠানো উচ্চমাত্রার প্রবাসী আয়ও অর্থনীতিকে সমর্থন দিয়েছে।
শক্তিশালী রেমিট্যান্স প্রবাহ, রপ্তানি ও কৃষি খাতে বিকাশের কল্যাণে ২০২৬ সাল পর্যন্ত মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে এগিয়ে থাকবে রয়েছে এমন প্রত্যাশা। ২০২০ সালে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি ২,০৯৮ ডলার থেকে কমে ১,৯২৯ ডলারে নামে। অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতা ২.৮৭ লাখ কোটি ডলার থেকে কমে হয় ২.৬৬ লাখ কোটি ডলার। একই বছর, বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতি ছিল সাড়ে ৩৫ হাজার কোটি ডলারের, কিন্তু ১,৯৬১ ডলার মাথাপিছু জিডিপি নিয়ে ভারতকে পেছনে ফেলে। গত ১৫ বছর ধরে গড়ে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে রেখে এই অর্জন করে বাংলাদেশ।
২০০৪ সাল থেকেই বাড়ছিল বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি। তবে ২০১৭ সাল থেকে ভারতের প্রবৃদ্ধি কমা শুরু হয়, যেকারণে বৃহৎ প্রতিবেশীটিকে টপকে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে। ২০০৮ সালের বৈশ্বিক ঋণ সংকটের আগপর্যন্ত বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ছিল ভারতের অর্ধেক (৫০%)। ২০১৪ সাল নাগাদ সেটি ৭০ শতাংশে পরিণত হয়। এরপর আসে কোভিড-১৯ মহামারির আঘাত, এতে ২০২০ সালে ভারতীয় অর্থনীতি ৭.৩ শতাংশ সংকোচনের শিকার হয়, আর সে তুলনায় বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হয় ৩.৫ শতাংশ।
বর্তমানে বার্ষিক বাজেট ঘাটতি মোকাবিলায়, বৈদেশিক বাণিজ্যের ব্যালান্সে, সরকারি দেনা ও জিডিপি টু বিনিয়োগ অনুপাতে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে ভালো পারফর্ম করছে। বিশেষত নারী শিক্ষার মতো দেশটির মানব উন্নয়ন সম্পর্কিত কর্মসূচিগুলো জন্মহার ও বাল্যবিবাহ দুই-ই উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়েছে।
প্রত্যাশিত গড় আয়ু, গর্ভধারণ ও শিশু পুষ্টির মতো অন্যান্য মানব উন্নয়ন সূচকেও ভারতের চেয়ে ভালো করেছে বাংলাদেশ। ভারতের অসম বিতরণের তুলনায়, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উত্থানের সুফল জনগণের মধ্যে অনেক বেশি বিস্তৃত হয়েছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক এই বিকাশ জীবনযাপনের মান উঁচু করেছে, যার ফলে আরও ভালো শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা সৃষ্টি হয়েছে।
অন্যদিকে, মানব উন্নয়ন সূচকগুলোয় ভারতের পারফরম্যান্স সন্তোষজনক হয়নি- বিশেষত দেশটির অর্থনৈতিকভাবে অংগ্রসর প্রদেশগুলোয় তার প্রভাব বেশ স্পষ্ট। যেমন- বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, গত বছর ভারতে কর্মস্থলে নারীর অংশগ্রহণের হার ছিল মাত্র ১৯ শতাংশ। সে তুলনায় বাংলাদেশে ছিল ৩৫ শতাংশ।
ভারতের হিন্দি ভাষাভাষী অধ্যুষিত অঞ্চলগুলো বাল্যবিবাহ ও অপরিণত বয়সে গর্ভধারণ মোকাবিলায় যুঝছে। বিহার রাজ্যে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে প্রতি এক হাজার নারীর ৪৭ জন মারা যাচ্ছেন। সমাজের বড় অংশের কল্যাণ-বঞ্চিত হওয়ার নির্দেশক এই সংখ্যা।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্যের মূলে রয়েছে- নারী শিক্ষা ও ক্ষমতায়নে বিনিয়োগের মাধ্যমে গর্ভধারণ সমস্যা দূরীকরণের উদ্যোগ।
ভারতের পিছিয়ে পড়ার কারণ আরও বহুবিধ। ২০১৬ সালে দেশটিতে হঠাৎ করেই কালোটাকা দূর করতে নোট বাতিলের উদ্যোগ নেওয়া হয়- এতে কয়েক বছরের জন্য পিছিয়ে যায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। এতে শুধু ডিজিটাল মাধ্যমে লেনদেনই বেড়েছে। কিন্তু, ৫০০ ও ১০০০ রুপির ব্যাংকনোট চটজলদি বাতিলের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় অর্থনীতি। কারণ, দেশটির ৯৪ শতাংশ শ্রমশক্তি ছিল অসংগঠিত ও নগদ অর্থের ওপর নির্ভরশীল, অনেকের কাছে ব্যাংকিং সেবার সুবিধাও ছিল না।
নগদ অর্থের ঘাটতিতে তাদের দৈনন্দিন খাবার ও জ্বালানি ক্রয় কমে; এর তীব্র নেতিবাচক প্রভাব পড়ে বাণিজ্য ও প্রস্তুতকারক শিল্পে। ধীরেসুস্থে না করে, মানুষের হাতে থাকা নগদ অর্থের ৮৬ শতাংশ রাতারাতি উঠিয়ে নেওয়ায় অর্থনীতিও দুর্বল হয়।
পক্ষান্তরে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার কারণে স্থানীয় মুদ্রার হিসাবে- গত ৫০ বছরে ২৭০ গুণ বিকশিত হয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। একই সময় বাজেট ঘাটতি হয়েছে জিডিপির ৫ শতাংশ বা তার চেয়েও কম। রপ্তানি-নির্ভর শিল্পায়ন ভিত্তিক উন্নয়ন কৌশলের সুবাদে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ পোশাক রপ্তানিকারক।
বস্তুত শ্রমঘন টেক্সটাইল, গার্মেন্টস ও পাদুকা শিল্পে অদক্ষ ও আধা-দক্ষ শ্রমশক্তির কর্মসংস্থান হয়, এই খাতগুলি এখন বাংলাদেশের সিংহভাগ রপ্তানিতে অবদান রাখছে। মুক্ত বাণিজ্যে দেশটির সুবিধাপ্রাপ্ত অবস্থান, উদ্ভাবন ও স্বল্প মজুরির কারণে ভারতের অনেক বায়ার বিশ্ববাজারে প্রতিযোগী সক্ষমতা ধরে রাখতে বাংলাদেশে চলে এসেছে।
বাংলাদেশ ভারতের ষষ্ঠ বৃহৎ বাণিজ্য অংশীদার, ২০২০-২১ অর্থবছরে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১০.৮ বিলিয়ন ডলার। ভারতের সাথে প্রস্তাবিত কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট (এসইপি বা সেপা) চুক্তি উভয় দেশের মধ্যেকার বাণিজ্যকে শক্তিশালী করবে। তবে এর পূর্ণ সুফল মিলবে উন্নত পরিবহন সংযোগ স্থাপিত হলে।
দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় করার সাম্প্রতিক এ উদ্যোগের আওতায় রয়েছে পণ্য, সেবা, জ্বালানি, অবকাঠামো উন্নয়ন বৃদ্ধি এবং আন্তঃসীমান্ত বিনিয়োগ উৎসাহিতকরণ।
ভারতের ছোট এই প্রতিবেশীটি এগিয়ে চললেও, অনেক অর্থনৈতিক সম্ভাবনা এখনও কাজে লাগানো বাকি। এবং নিঃসন্দেহে সেদিকে একনিষ্ঠ মনোযোগ দিতেই হবে। তবে বাংলাদেশ আপাতত দক্ষিণ এশিয়ায় অর্থনৈতিক তারকাখ্যাতির পথচলা উপভোগ করছে।
- লেখক: সৈয়দ মুনির খসরু আন্তর্জাতিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক দ্য ইনস্টিটিউট ফর পলিসি, অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্সের চেয়ারম্যান। তার এ মতামতটি গত ২৯ মে হংকং-ভিত্তিক গণমাধ্যম সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টে প্রকাশিত হয়।