ট্যানারি: প্রথমে মেরেছে বুড়িগঙ্গাকে, তারপর ধলেশ্বরী, এখন কালীগঙ্গাকে
ভরদুপুর। কাঠফাটা রোদ। কালীগঙ্গা নদীর ধারে পারাগ্রামের ৫৫ বছর বয়সি জেলে বিধু হালদার ও তার ২৪ বছর বয়সি ছেলে আরাধন হালদার স্যানিটারি পণ্যের জন্য স্টিলের রড কাটছেন।
'আগে নদীতে মাছ ধরে পেট চালাতাম। কিন্তু পানি এখন এত বেশি দূষিত যে নদীতে আর কোনো মাছ নাই। তাই দিনমজুরের কাজ করে পেট চালাতে হচ্ছে,' জানালেন বিধু হালদার। ছেলের ধরে থাকা রড কাটারের ওপর সজোরে নেমে এল তার হাতুড়ি।
কয়েকবছর আগেও পারাগ্রামের মতো আরও অনেক গ্রামের নদীর দুধারে ছিল গাছপালা আর ঘরবাড়ির সমারোহ। নদীতে গোসল, হাড়িপাতিল, জামাকাপড় ধোয়ার মতো নিত্যদিনের কাজ সারত গ্রামবাসী। ছবির মতো সুন্দর এ গ্রামগুলোর জেলেদের জীবন চলত নদীতে মাছ ধরে।
কিন্তু সেই দিন আর নেই।
সাভার ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেটের দূষিত পানি কালীগঙ্গা নদীর তীরস্থিত পারাগ্রামের এ অংশে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে ফেলা হয় নিয়মিত। এর ফলে এ অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য ও গ্রামবাসীদের জীবনযাপন মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়ে গেছে।
ধলেশ্বরী ও বুড়িগঙ্গার পর এখন কালীগঙ্গা নদীকে ধ্বংস করছে ট্যানারি এস্টেট।
নদীর দিকে তাকালে মন খারাপ হয়ে যায় বিধু হালদারের।
'আমরা অসহায়। নদীর জল কুচকুচে কালো আর লালচে হয়ে গেছে। কটু গন্ধ বেরোয়। এ দুর্গন্ধের কারণে আপনি নদীর পাড়ে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়েও থাকতে পারবেন না,' বলেন বিধু।
দূষিত নদী বদলে দিয়েছে ৩৫ বছর বয়সি জেলে রতন ব্যাপারির জীবনও। ১০ বছর বয়সে বাবার সঙ্গে নদীতে মাছ ধরা শুরু করেন রতন। কিন্তু নদীর এ অবস্থার কারণে তিনিও এখন পেশা বদলাতে বাধ্য হয়েছেন। এখন এলাকায় রিকশা-ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি।
৭২ বছর বয়সি মোহাম্মদ সিরাজের জন্ম, বেড়ে ওঠা—সবই পারাগ্রামে। নদীতে গোসল করা তার অভ্যাস। শুকনো মৌসুমে টিউবওয়েলের পানি দিয়ে তাকে গোসলের কাজ সারতে হয়।
'শুকনার সময়ে নদীর দিকে তাকাতেই পারবেন না। একবার গায়ে ওই পানি লাগলে সারা শরীর চুলকাতে শুরু করে,' জানান সিরাজ।
একসময় নদীর ধারের গ্রামগুলোর বাসিন্দাদের মাছ কিনে খেতে হতো না। এখন সেসব দিনের ঠাঁই হয়েছে স্মৃতির পাতায়। নদী ধ্বংসের জন্য তারা সবাই ট্যানারির দিকেই আঙুল তুলছেন। তবে বিধু হালদার খানিকটা খুশি। কেননা নদীতে নতুন পানি আসতে শুরু করেছে। তার মনে ক্ষীণ আশা, আরেকটা শুকনা মৌসুম শুরু হওয়ার আগে অল্প কিছুদিনের জন্য তিনি ও তার মতো অন্য জেলেরা নদী থেকে মাছ ধরার সুযোগ পাবেন।
যেভাবে শুরু
২০০৩ সালে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) বুড়িগঙ্গাকে বাঁচানোর জন্য হাজারিবাগের সব ট্যানারি সাভারে সরিয়ে নেওয়ার প্রকল্প হাতে নেয়।
অবশেষে ২০১৭ সালে, হাজারিবাগের সব ট্যানারি সাভারে স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু ট্যানারিগুলো ততদিনে ধলেশ্বরী নদীকে প্রায় ধ্বংস করে ফেলেছে। এখন যমুনা থেকে ধলেশ্বরী নদীতে প্রবাহিত শাখানদী কালীগঙ্গা নষ্ট হচ্ছে ট্যানারির বর্জ্যে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ট্যানারি এস্টেট এখনও নদীকে দূষিত করছে। ট্যানারি এস্টেট কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি ট্যানারদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিচ্ছে অধিদপ্তর, কিন্তু নদীদূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি।
২০২০ সালে পরিবেশ দূষণের দায়ে সাভার ট্যানারি এস্টেটের আটটি ট্যানারিকে ২১ লাখ টাকা জরিমানা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। একই বছর নদীদূষণের দায়ে বিসিককেও ৬ কোটি টাকার বেশি জরিমানা করে। গত মার্চে অপরিশোধিত তরল বর্জ্য ফেলে ধলেশ্বরী নদীকে দূষিত করার জন্য সাতটি ট্যানারির কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় অধিদপ্তর।
গত বছরের ২৩ আগস্ট পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ট্যানারদের উৎপাদন করা সমস্ত তরল বর্জ্য পরিশোধনের জন্য পর্যাপ্ত শোধনাগার না থাকায় হেমায়েতপুরের সাভার ট্যানারি শিল্প এস্টেট বন্ধ করে দেওয়ার সুপারিশ করে।
সমস্যা: অপরিশোধিত তরল বর্জ্য নিষ্কাশন
পরিবেশ অধিদপ্তরের ঢাকা জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক জহিরুল ইসলাম তালুকদার বলেন, কমন এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (সিইপিটি) বা সাধারণ বর্জ্য শোধনাগার কার্যকরভাবে পরিচালনাই মূল চাবিকাঠি। সিইটিপি যখন অপরিশোধিত তরল বর্জ্য ছেড়ে দেয়, তখনই আসল দূষণটা ঘটে।
'পানির গুণমান মাপার কিছু প্যারামিটার আছে আমাদের। প্রতি মাসেই আমরা পানি পরীক্ষা করি। আমাদের সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী নিষ্কাশিত পানি প্যারামিটারের মধ্যে পড়ে না। অর্থাৎ সিইটিপি যে পানি-বর্জ্য ছাড়ছে, তা নদীর পানিকে দূষিত করছে,' বলেন জহিরুল ইসলাম তালুকদার।
তিনি জানান, সিইটিপির ছাড়া পানির মান যাতে প্যারামিটারের মধ্যে থাকে, সেজন্য বিসিককে হাইকোর্টের নির্দেশ মেনে চলতে এবং সঠিকভাবে সিইপিটি পরিচালনা করতে বলেছে অধিদপ্তর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অভ লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির পরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, সিইটিপি আধুনিক প্রযুক্তিতে স্থাপন করা হয়নি।
তিনি বলেন, 'বিসিক দাবি করেছে, সাধারণ বর্জ্য শোধনাগারটির প্রতিদিন ২৫ হাজার ঘনমিটার তরল হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু [শোধনাগারটির] প্রতিদিনের তরল বর্জ্য হ্যান্ডলিংয়ের প্রকৃত সক্ষমতা প্রায় ১৪ হাজার ঘনমিটার।'
তিনি আরও বলেন, শোধনাগারটি ৫-৬ হাজার ঘনমিটার তরল বর্জ্য পরিশোধন করলে তখন নিঃসরণ-মান পরিবেশের মানদণ্ডের মধ্যে পড়ে।
পিক সিজনে ৫০ শতাংশ ট্যানারি প্রতিদিন ৩০ হাজার ঘনমিটারের বেশি তরল বর্জ্য উৎপাদন করে। শোধনাগারে বর্জ্য রাখার সময় ২৪ ঘণ্টা, কিন্তু ট্যানাররা ১২ ঘণ্টা পরই মডিউল থেকে তা সরিয়ে ফেলে বলে জানান অধ্যাপক মিজানুর রহমান।
তিনি বলেন, 'পানি সম্পূর্ণ পরিশোধন না করে নিষ্কাশন করলে তা শেষ পর্যন্ত নদী ও জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর হবে। পর্যাপ্ত সক্ষমতা নেই, এমন একটা শোধনাগারে নতুন তরল রাখার জায়গা করার জন্য তারা এটি করছে।'
শোধনাগারে অনেক কিছুর অভাব আছে। যেমন ক্রোমিয়াম পুনরুদ্ধার ইউনিটের জন্য একটি প্ল্যান্ট স্থাপন করার কথা ছিল ট্যানারি এস্টেটের। ক্রোমিয়াম পুনরুদ্ধার ও পুনর্ব্যবহার করার কথাও রয়েছে কর্তৃপক্ষের। কিন্তু কোনোটিই হয়নি।
বড় কোম্পানিগুলোর জন্য পৃথক বর্জ্য শোধনাগার স্থাপন বাধ্যতামূলক করার পরিকল্পনা করছে সরকার। এটি করলে সিইপিটির ওপর চাপ কমবে। ছোট কোম্পানিগুলো সাধারণ শোধনাগার ব্যবহার করতে পারবে।
কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য কর্তৃপক্ষ এখনও কোনো শোধনাগার স্থাপন করতে পারেনি।
তবে ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা বলছেন, নিষ্কাশনকৃত পানির গুণগত মানের উন্নতি হচ্ছে। যদিও তা এখনও সন্তোষজনক পর্যায়ে আসেনি।
অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা জানিয়েছেন, কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে তারা এখন বেশি উদ্বিগ্ন।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, গত জুলাই থেকে একটি কোম্পানি সিইপিটি পরিচালনা করছে। পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে।
কোম্পানিটি যেহেতু এটি নিয়ে কাজ করছে, তাই দুই মাসের মধ্যে পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সাখাওয়াত বলেন, 'প্রতি ফোঁটা পানি পরিশোধনের পর নদীতে যায়। যদিও এটা ঠিক যে, এটা ১০০ শতাংশ প্যারামিটার পূরণ করছে না।
'একটি বর্জ্য শোধনাগার স্থাপনের জন্য বিপুল অর্থের প্রয়োজন। কিন্তু তার জন্য কোনো বরাদ্দ নেই। কয়েকটি বড় কোম্পানিরই কেবল নিজস্ব শোধনাগার স্থাপনের আর্থিক সক্ষমতা আছে।'
কয়েকটি বড় কোম্পানি ইতিমধ্যে নিজস্ব বর্জ্য শোধনাগার স্থাপনের অনুমোদন পেয়েছে বলে জানান সাখাওয়াত।
বিসিক চেয়ারম্যান মাহবুবর রহমান বলেন, সিইটিপিতে নিয়মিত রাসায়নিক ব্যবহার করায় নদীর পানি এখন দূষিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
তিনি বলেন, নদীর পানির রং হালকা বাদামি হলেও পানি ক্ষতিকর নয়। 'পানি গ্লাসে নিলে খারাপ দেখাবে না।'
বিসিককে পরিবেশ অধিদপ্তরের জরিমানা করার বিষয়ের জানতে চাইলে তিনি বলেন, জরিমানার ঘটনার পর অনেক সংস্কার করা হয়েছে।
সিইটিপিতে এখন কোনো সমস্যা নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
মাহবুবর রহমান বলেন, 'সবকিছু ভালোভাবেই চলছে। সিইটিপি ভালোভাবে কাজ করছে।'
বছরখানেক আগে চীনা কোম্পানি সিইটিপি হস্তান্তর করেছে। সবকিছু ঠিক আছে কি না, তা দেখার জন্য এই মাসে সিইটিপি পরীক্ষা করা হবে বলে জানান তিনি।
মাহবুবর রহমান আরও বলেন, 'আমরা এখন কঠিন বর্জ্য পরিশোধন করার পরিকল্পনা করছি। দ্বিতীয় সিইটিপি স্থাপনের কোনো পরিকল্পনা আমাদের নেই।'
পরিবেশ অধিদপ্তরের গত মাসের প্রতিবেদন সম্পর্কে জানতে চাইলে বিসিক চেয়ারম্যান বলেন, অধিদপ্তর গত মাসের পানির গুণগত মান সম্পর্কে করপোরেশনকে জানায়নি।
'আমরা প্রতিবেদনটি দেখে তাদের [ট্যানারদের] নির্দেশনা দেব,' যোগ করেন তিনি।