পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক সম্ভাবনা: গড়ে উঠছে কলকারখানা, সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থান
পদ্মা সেতু শুধু উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থাই সৃষ্টি করছে তা নয়, সেতুকে ঘিরে এ অঞ্চলে গড়ে উঠছে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন কলকারখানা। নির্মাণ হচ্ছে শেখ হাসিনা তাঁত পল্লী, গার্মেন্টস, হিমাগার, পেট্রোল পাম্প ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক। সৃষ্টি হচ্ছে বেকারদের নতুন নতুন কর্মসংস্থান। ফলে প্রসার ঘটবে স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্যে, সুফল মিলবে জাতীয় অর্থনীতিতে।
বলা যায়, পদ্মা নদী বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোকে আর যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণেই গড়ে ওঠেনি কোন ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠান। ফেরিতে পাড়ি দিতে হয় প্রমত্তা পদ্মা। এর ফলে দিনের পর দিন ঘাটে বসে থাকা, পণ্য নষ্ট হয়ে যাওয়া, শিপমেন্ট বাতিল হওয়াসহ নানা ভোগান্তি পোহাতে হয়। সেজন্যই শিল্প মালিকদের ছিল না কোন আগ্রহ। পদ্মা সেতুর কাজের অগ্রগতি যখন দৃশ্যমান হয়, তখন বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান এ অঞলে কলকারখানা নির্মাণের জন্য জমি কিনতে শুরু করেন। এরপর সেই জমির উন্নয়ন শেষে এখন অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে।
পদ্মা সেতুর শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে নাওডোবা ও শীবচরের কুতুবপুরে ১২০ একর জমিতে গড়ে উঠছে শেখ হাসিনা তাঁতপল্লী। প্রথম পর্যায়ের ৩০৭ কোটি ৪৫ লক্ষ টাকা ব্যয়ে সীমানা প্রাচীর ও ভূমি উন্নয়ন কাজ শেষের পথে। এরপরই দ্বিতীয় পর্যায়ে শুরু হবে অবকাঠামো নির্মাণ। তাঁত শেড নির্মাণের মাধ্যমে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হবে তাঁতিদের। উদ্দেশ্য- কর্মসংস্থান, পণ্যের গুণগত মান উন্নয়ন পাশাপাশি আর্ন্তজাতিক বাজারে বস্ত্র সরবরাহ। নির্মাণ করছে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড। থাকবে স্কুল, মসজিদ, খেলার মাঠও।
রোববার তাঁতপল্লী প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা যায়, শরীয়তপুর-নাওডোবা পদ্মা সেতুর এ্যাপ্রোচ সড়কের উভয় প্রান্তে শ্রমিক-প্রকৌশলীদের কর্মযজ্ঞ চলছে। বিশাল এলাকা জুড়ে বালু ভরাট করে স্কেবেটর দিয়ে জমি সমান করা হচ্ছে, নির্মাণ করা হচ্ছে দীর্ঘ সীমানা প্রাচীর, পাইলের রড বাধাই ছাড়াও একটি ভবন নিমার্ণের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে।
খোকন কনস্ট্রাকশন এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের প্রকল্প ম্যানেজার চিন্ময় সরদার বলেন, "শেখ হাসিনা তাঁত পল্লীর বালু ভরাটের কাজ জুন মাসের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। সীমানা প্রাচীরের কাজ প্রায় ৫০ শতাংশ শেষ হয়ে গেছে। এখন কনস্ট্রাকশনের কাজ শুরু করছি। দ্রুত কাজ শেষ করার জন্য নির্দেশনা আছে। আমরা সেভাবেই কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।"
তিনি আরও বলেন, এখানে প্রথম পর্যায়ে দুই হাজার তাঁতিকে পুনর্বাসিত করা হবে। ধাপে ধাপে তাঁতির সংখ্যাবৃদ্ধির পরিকল্পনা আছে। তাদের জন্য শেড নির্মাণ করা হবে। যেখানে তাঁতিদের আবাসন ও মার্কেট থাকবে। শিশুদের জন্য স্কুল ও খেলার মাঠও থাকবে।
বেসরকারি পর্যায়ে এগিয়ে এসেছেন উদ্যোক্তারা। পদ্মা সেতু ঘিরে গড়ে উঠছে একের পর এক অবকাঠামো। তৈরি হচ্ছে পোশাক কারখানা, হিমাগার, সিকদার ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, জুতা তৈরির কারখানা, ব্লক ইট তৈরির কারখানা। এছাড়াও শরীয়তপুরের কৃষিকে ভিত্তি করে কলকারখানা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান। শরীয়তপুরের টমেটো থেকে সস তৈরি, রসুন প্রক্রিয়া করে পাউডার প্যাকেটিং এবং এ অঞ্চলে কালোজিরা থেকে যে মধু উৎপাদন হয় তা প্রক্রিয়াজাত করে এসব বিদেশে রপ্তানি করারও পরিকল্পনা নিয়েছেন উদ্যোক্তারা। আর সে লক্ষ্য নিয়েই এসব প্রতিষ্ঠানের জমির উন্নয়ন কাজ শেষে তোড়জোড় চলছে অবকাঠামো নির্মাণের। তাই দিনবদলের স্বপ্ন দেখছেন পদ্মাপাড়ের মানুষ।
মাসট্রেড ইন্টারন্যাশনাল গার্মেন্টস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোবারক আলী সিকদার বলেন, "প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ তিনি পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দক্ষিণবঙ্গের মানষের জন্য অপার অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সুযোগ করে দিয়েছেন। পদ্মা সেতুর সুযোগ কাজে লাগিয়ে একটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক তৈরি করছি। যেজন্য প্রথম পর্যায়ে ৪০ বিঘা জমি নিয়ে কাজ শুরু করেছি। এখানে প্রথমত আমি গার্মেন্টস করব। বর্তমানে কমপ্লায়েন্সের উপর বায়াররা খুব জোড় দিচ্ছে। ফ্যাক্টরিগুলোকে আধুনিক করতে হবে। সমস্ত সুযোগ-সুবিধা থাকতে হবে। আগুন নির্বাপণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। যদি বড় খোলামেলা জায়গায় গার্মেন্টস করা যায়, সেক্ষেত্রে হাজার হাজার ওয়ার্কার কাজ করতে পারবে এবং তাদের জীবনের ঝুঁকি থাকবে না। সবুজ বেষ্টনীর মধ্যে ফ্যাক্টরি তৈরি হবে। বায়ারদের সমস্ত রিকোয়ারমেন্ট বিট করা যাবে। বায়াররা আকৃষ্ট হবে এবং আমার বিশ্বাস তারা প্রচুর অর্ডার নিয়ে আসবে।"
তিনি আরও বলেন, "আমি চাচ্ছি সমস্ত ইন্ডাস্ট্রিকে সেন্ট্রালাইজড (কেন্দ্রীভূত) করে ফেলা। তাতে আমার নিয়ন্ত্রণ করতে সুবিধা হবে। একই এরিয়ার মধ্যে গার্মেন্টস, জুতার ফ্যাক্টরি, অটোমেটিক ব্রিক ফিল্ড, কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ফ্যাক্টরি ছাড়াও সময়োপযোগী চাহিদা পূরণে সে জাতীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলব। এতে আশা করি ১০ থেকে ১২ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে।"
নাওডোবা এলাকার বাদল জমাদ্দার বলেন, "সেতুকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে। অনেক যানবাহন চলাচল করবে। সেই চিন্তা থেকে একটি তেলের পাম্প নির্মাণের জন্য জমি কিনেছি। এখানে এলপিজি ও সিএনজি গ্যাসেরও ব্যবস্থা থাকবে। লাইসেন্সের জন্য কাগজপত্র জমা দেয়া হয়েছে। অনুমতির পরই নির্মাণ কাজ শুরু হবে।"
নড়িয়ার আয়শা বেগম বলেন, "আমরা কাজ করে খাই। আমাগো এলাকার মাইয়া- ছেলেরা দূরে যাইয়া গার্মেন্টসে কাজ করে। অহন আমাগো ঘরের কাছেই গার্মেন্টস অইতাছে। আমাগো কাজের লিগ্যা আর দূরে যাওয়া লাগবো না।"
জাজিরার ২২ বছর বয়সী জাফর কাজী। লেখাপড়ায় প্রাথমিক গন্ডি পেরিয়ে দীর্ঘদিন ঘুরে বেড়িয়ে বিদেশ পাড়ি দেয়ার চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল তার। তিনি বলেন, "পদ্মা সেতু যেমন সুখবর, তেমনি এখানে কলকারখানা আমাদের মতো বেকারদের জন্য অনেক প্রাপ্তি। এখন বিদেশ যাওয়ার চিন্তা থেকে সরে এসেছি। নিজের বাড়িতে থেকেই কাজ করার মতো আনন্দ আর কি আছে!"