‘কমিটির চাপে যখন তদন্ত দিশেহারা’
সিনিয়র সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল ফেসবুকে এই শিরোনামে একটি পোস্ট দিয়েছেন, যেখানে তিনি লিখেছেন: চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনা তদন্তে মোট ছয়টি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। বেসরকারি এই ডিপো কর্তৃপক্ষ নিজেরাই একটি তদন্ত কমিটি করেছে। অন্য তদন্ত কমিটিগুলো গঠন করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ, ফায়ার সার্ভিস, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশন, জেলা প্রশাসন ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। নিরাপত্তা ও যন্ত্রপাতির শর্ত পূরণ না করার কারণে ২০১৭ সালে 'বিএম কনটেইনার ডিপো'র লাইসেন্স নবায়ন বন্ধ রেখেছিল কাস্টম কর্তৃপক্ষ। কিন্তু পরে নবায়নের সুযোগ পেলেও নিরাপত্তা ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করা হয়নি। বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিনির্বাপণের জন্য ব্যবহৃত 'ফায়ার ডিস্টিনগুইসারের' মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে। জনাব বুলবুলের প্রশ্ন, এই দুটি কাজ দেখভালের দায়িত্ব ছিল কোন কর্তৃপক্ষের? এখন তৎপর জেলা প্রশাসন এতদিন কোথায় ছিলেন?
তাঁর এই স্ট্যাটাসের নিচে কিছু লোক রসিকতাপূর্ণ মন্তব্যও করেছেন। যেমন আশরাফুল হাবিব নামে একজন লিখেছেন: 'এটা তো আমার কাছে পজিটিভ মনে হয় স্যার। ক্রসম্যাচ করে ফাইনালাইজ করা যাবে।' শাহীন বাবু লিখেছেন, 'সব তদন্ত কমিটি মিলিয়ে একটা ফেডারেশন গঠনের প্রস্তাব করছি।' ওয়াদি মার মন্তব্য: 'এখন তদন্ত কমিটি সুপারভাইস করতে একটি কমিটি শুধু বাকি আছে বলে মনে হয়।'
মানুষের এই রসিকতার পেছনে আছে মূলত ক্ষোভ এবং বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা, প্রতিষ্ঠানের নির্লিপ্ততা, অতীতের তদন্ত কমিটিসমূহের সুপারিশমালা বাস্তবায়ন না হওয়াসহ নানা কারণ।
পুরান ঢাকার নিমতলীতে ভয়াবহ আগুন, এরপর চকবাজারের চুড়িহাট্টা ও মগবাজারের বিস্ফোরণে প্রাণহানির কথা মানুষ ভুলে যায়নি। স্মরণ করা যেতে পারে, ওইসব ঘটনায়ও একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। বস্তুত প্রতিটি ঘটনার পরই এরকম তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় এবং এর মধ্যে কোনো কোনোটির নাম দেয়া হয় উচ্চপদস্থ তদন্ত কমিটি। কমিটির লোকজন সংশ্লিষ্টদের সাক্ষাৎকার নেন। তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। কখনও বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটিও হয়। কিন্তু অধিকাংশ সময়ই এসব তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আলোর মুখ দেখে না।
অনেক সময় সেই রিপোর্ট সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জমা দেয়া হলেও গণমাধ্যমকে জানানো হয় না। আবার এ-জাতীয় ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না হয়, সে জন্য রিপোর্টে কিছু সুপারিশও থাকে। কিন্তু অধিকাংশ সময়ই এসব সুপারিশ বাস্তবায়িত হয় না বা করা হয় না। বস্তিতে আগুন লাগলেও কমিটি হয়। কিন্তু পরের বছর সেই বস্তিতে আবার আগুন লাগে। লঞ্চ ডুবে প্রাণহানির পরে তদন্ত কমিটি হয়। কিন্তু ওই নদীতে পরের বছর আবার লঞ্চ ডোবে। অর্থাৎ ঘটনার মতো ঘটনা ঘটে যায়। আর কথিত তদন্তের জন্য কমিটির মতো কমিটি হয়, যাতে অনেক সময় কমিটির চাপে খোদ তদন্তই 'দিশেহারা' হয়; যার সবশেষ উদাহরণ- চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড।
২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে কেমিক্যালের গোডাউনে লাগা আগুনে ১২৪ জনের মৃত্যুর পরে যে তদন্ত কমিটি হয়েছিল, তাদের সুপারিশগুলো যে বাস্তবায়িত হয়নি, তার প্রমাণ এই ঘটনার ৯ বছরের মাথায় ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে পুরান ঢাকার চকবাজারে ভয়াবহ আগুনে প্রায় ৮০ জনের বেশি মানুষের প্রাণহানি। নিমতলীর আগুনের ঘটনায় তদন্ত রিপোর্টে আবাসিক এলাকা থেকে কেমিক্যালের গোডাউন সরিয়ে ফেলার সুপারিশ করা হয়েছিল। সেই সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে, এরকম আরেকটি ট্র্যাজেডি দেখতে হতো না।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন সরল স্বীকারোক্তি দিয়ে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, তারা অনেক চেষ্টা করেও কেমিক্যালের গোডাউন সরাতে পারেননি (দেশ রূপান্তর, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯)। এই স্বীকারোক্তির মধ্যে তার অসহায়ত্ব যেমন ছিল, তেমনি ছিল রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সাহসিকতার অভাব। তাছাড়া কেমিক্যাল গোডাউনের মালিকরাই যদি এ বিষয়ে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে থাকেন বা তারা যদি রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হন, সেক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে যায় কিংবা তাদের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়—এমন কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা মেয়রের পক্ষেও অসম্ভব।
গত বছরের জুন মাসেও রাজধানীর মগবাজারে একটি ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয়, যে ভবনেও কেমিক্যাল ও অন্যান্য দাহ্য পদার্থ ছিল বলে ধারণা করা হয়। আবার এর এক মাস না যেতেই ৮ জুলাই নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কারখানায় আগুনে পুড়ে মারা যান অর্ধ শতাধিক শ্রমিক। এ ঘটনায়ও তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এর মধ্যে জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটি তাদের যে ৪৪ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন জমা দেয়, সেখানে এই ঘটনার পেছনে কারখানার মালিকের অনিয়মসহ সরকারি সংস্থার গাফিলতির বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। এরকম ঘটনা প্রতিরোধে ২০টি সুপারিশও করা হয় (একুশে টেলিভিশন, ৯ আগস্ট ২০২১)।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই কারখানার পরিবেশ অধিদপ্তরের সদন ছিলো না, বিল্ডিং কোড ছিলো না, ফায়ার সার্ভিসের এনওসি পাওয়া যায়নি। এমনকি ফায়ার সেফটিও ছিলো না। প্রশ্ন হলো, পরিবেশ অধিদপ্তরের সদন, বিল্ডিং কোড এবং ফায়ার সেফটি ছাড়াই এত বড় একটি কারখানা রাজধানীর কাছের একটি শহরে কী করে বছরের পর বছর ধরে চললো? একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা না ঘটলে কি এই সত্যটিও বেরিয়ে আসতো? এরকম সনদ ও সেফটি ছাড়া আরও কত শত কারখানা চলছে, তা দুর্ঘটনায় প্রাণহানির পরে তদন্ত কমিটি না হলে কি আদৌ জানা যাবে? উপরন্তু যে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বরাবরই তাদের লোকবল সংকটের অজুহাত দেয়, তারাও এইসব ঘটনার দায় এড়াতে পারে কি না; জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় বেতন নিয়ে তারা দেশের কলকারাখানাগুলোর নিরাপত্তা বিধানে কেন ব্যর্থ হচ্ছে, সেই প্রশ্নও তোলা দরকার। শুধু তদন্ত কমিটি হবে, তারা সুপারিশ করবে কিন্তু পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হবে না—এভাবে চলতে পারে না।
নিমতলী ট্র্যাজেডির পর কেন এ বিষয়ে সাবধানতা অবলম্বন করা হলো না? কেন কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদেরকে সরকারের সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য করা গেল না? চুড়িহাট্টার ঘটনার পর আবাসিক এলাকায় কেমিক্যালের গোডাউন নিয়ে রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায় থেকেও ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছিল। কিন্তু তারপরও গোডাউন সরানো যায়নি। এটি খুবই স্পষ্ট যে, নিমতলী, চকবাজার, চুড়িহাট্টা, লালবাগ, ইমামগঞ্জসহ পুরান ঢাকার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে যেসব কেমিক্যাল গোডাউন-কারখানা রয়েছে সেগুলো সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর বা দপ্তরসমূহের অনুমোদন ছাড়াই চলছে।
২০১০ সালে শিল্পমন্ত্রী ছিলেন দিলীপ বড়ুয়া—যিনি চুড়িহাট্টার ঘটনাস্থল পরিদর্শনের সময় সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে আগের সুপারিশ বাস্তবায়িত না হওয়ার জন্য তার উত্তরসূরি সাবেক শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুর ওপর দায় চাপিয়েছিলেন। তার অভিযোগ, 'কেমিক্যাল বিজনেস রিলোকেট করার জন্য আমি মন্ত্রী থাকাকালে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, কেমিক্যাল মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন ও বিসিক মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো, তারা ঢাকার বাইরে একটি জমিতে স্থানান্তরিত হবে, এটা আমাদের প্রতিজ্ঞা ছিল; কিন্তু ডিসক্রিট ব্যাপারের কারণে পুরো ব্যাপারটি এগোয়নি।' কিন্তু আমীর হোসেন আমু পাল্টা জবাব দিয়ে তখন বলেন, মন্ত্রী থাকা অবস্থায় পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল কারখানা সরাতে না পারার ব্যর্থতা ঢাকতেই দিলীপ বড়ুয়া আবোল-তাবোল বলছেন (দৈনিক যুগান্তর, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯)।
তার মানে এটিও আমাদের আরেকটি বাস্তবতা যে, একটির পর একটি দুর্ঘটনা ঘটবে, অগণিত মানুষ প্রাণ হারাবে, তদন্ত কমিটি হবে এবং দায়িত্বশীল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর পরস্পরের ওপরে দায় চাপাবে, কিন্তু সমস্যার কোনো সমাধান হবে না। তদন্ত কমিটি হবে, তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করবে, রিপোর্ট দেবে, সেখানে নানাবিধ সুপারিশ থাকবে, কিন্তু সেই সুপারিশ বাস্তবায়িত হবে না। ফলে কিছুদিন পরে ওই একইরকম ঘটনা আবার ঘটবে এবং তখন আবার আরেকটি তদন্ত কমিটি হবে। কমিটির ভারে তখন তদন্তই দিশেহারা হবে।
লেখক ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদের একটি মন্তব্য দিয়ে লেখাটা শেষ করা যাক। তিনি লিখেছেন: '৯৯ ভাগ তদন্ত কমিটি গঠিত হয় ক্ষুব্ধ জনগণকে শান্ত করতে বা সান্ত্বনা দিতে। বাঙালি ৫০ বছর আগে যতটা বেকুব ছিল, আজ আর তা নেই। সে সবই বোঝে, কিন্তু তার করার কিছু নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের চাঞ্চল্যকর রিজার্ভ পাচার নিয়ে সরকার সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে। যথাসময়ে তিনি প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। বোধগম্য কারণে তার সেই রিপোর্ট আজও প্রকাশ করা হয়নি। প্রতিবেদনটি প্রকাশ করলে বাংলাদেশ ব্যাংক যতটা বিব্রত হতো, সেটি গোপনে তালা মেরে রাখায় সরকার অনেক বেশি সন্দেহভাজনে পরিণত হয়েছে। প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছে (প্রথম আলো, ৩১ জুলাই ২০১৮)।'
লেখক: আমীন আল রশীদ, নেক্সাস টেলিভিশনের কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর।
এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।