মূল্যস্ফীতি কমাতে প্রস্তাবিত বাজেটে পদক্ষেপ অপর্যাপ্ত: সিপিডি
প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতির বিষয়টি অনেকবার উঠে এলেও, তা কমিয়ে আনতে যে পদক্ষেপগুলোর কথা বলা হয়েছে সেগুলো যথেষ্ট নয় বলে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।
এছাড়াও বিদেশ থেকে টাকা আনার ব্যাপারে বিভিন্ন ধরনের কর ছাড়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে এই বাজেটে। এটা একবারেই অনৈতিক বলে উল্লেখ করেছে সিপিডি।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে প্রতিক্রিয়া দিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, 'সামগ্রিক বিচারে আমরা এই প্রস্তাবিত বাজেটকে যেভাবে বলতে চাই, সেটি হলো, যে লক্ষ্যে এই বাজেটটি তৈরি করা হয়েছে, সেই লক্ষ্যগুলো হয়তো ঠিক রয়েছে—কিন্তু সেই লক্ষ্যগুলোর প্রেক্ষিতে যে পদক্ষেপগুলো নেওয়ার কথা বলা হয়েছে সেগুলো অপরিপূর্ণ। এবং নীতিকৌশলের পথনির্দেশনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে সেগুলো অসম্পূর্ণ। বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় অপর্যাপ্ত।'
তিনি বলেন, 'এই বছরের বাজেটটি এমন এক সময় উপস্থাপিত হলো, যখন সারা বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটে নিমজ্জিত। কোভিড প্রতিঘাত থেকে বের হতে না হতেই যুদ্ধের অভিঘাত সারা বিশ্বে রয়েছে। তার ফলে উৎপাদন এবং সরবরাহের মধ্যে যে একটা বাধা সৃষ্টি হয়েছে, তার ফলে চাহিদা মেটানো খুব সংকটময় ও সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে।
'এ প্রেক্ষিতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা আগামী অর্থবছর এবং চলতি অর্থবছরে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখতে পাচ্ছে। কোনো কোনো অর্থনীতিতে রিসেশন কিংবা স্ট্যাগফ্লেশনের মতো সমস্যাও তারা অশঙ্কা করেছেন।
'বাংলাদেশের অবস্থাও এর থেকে খুব একটা ভিন্ন নয়। আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি এখানো মূল্যস্ফীতির হার অত্যন্ত বেশি। তার পাশাপাশি বৈদেশিক খাতে এক ধরনের চাপ তৈরি হয়েছে। তার পাশাপাশি আমাদের প্রকল্প বাস্তবায়ন, আমাদের অভ্যন্তরীণ সম্পদ সঞ্চালন ইত্যাদি ক্ষেত্রে আমাদের অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যেগুলো মোকাবিলা করতে হবে।'
ফাহমিদা খাতুন বলেন, 'এই প্রেক্ষিতে আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়ন করা আসলেই অত্যন্ত দুরূহ কাজ ছিল এবং আমাদের অর্থমন্ত্রী সেই চ্যালেঞ্জগুলোকে মাথায় রেখেই এই বাজেটটি প্রণয়ন করেছেন। বাজেটের শুরুতে ছয়টি মূল উদ্দেশ্য তিনি ব্যক্ত করেছেন। প্রধান প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোকে তিনি আইডেনটিফাই করেছেন।
'সেগুলোর মধ্যে একটি রয়েছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা এবং অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা। দ্বিতীয়ত, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারের মূল্যবৃদ্ধিজনিত বর্ধিত ভর্তুকির জন্য অর্থের সংস্থান করা। তৃতীয়ত বৈদেশিক সহায়তার অর্থের ব্যবহার এবং মন্ত্রণালয়, বিভাগের উচ্চ অধিকারসম্পন্ন প্রকল্পগুলো নির্ধারিত সময়ে শেষ করা। চতুর্থত, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে প্রকল্প যথাসময়ে বাস্তবায়ন। পঞ্চমত, অভ্যন্তরীণ মূল্য সংযোজন কর সংগ্রহের পরিমাণ এবং ব্যক্তি আয় করদাতাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করা। ষষ্ঠত, টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল করা এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সন্তোষজনক পর্যায়ে রাখা।
'এখন যদি আমরা এই ছয়টি বিষয়কে মাথায় রেখে খুব সংক্ষেপে দেখি যে, এই উদ্দেশ্যগুলোর সঙ্গে চ্যালেঞ্জগুলোকে মোকাবিলার জন্য কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বাজেটের মধ্যে। সারা বাজেটজুড়ে মূল্যস্ফীতির বিষয়টি বহুবার এসেছে। কিন্তু আমাদের কাছে মনে হয়েছে, মূল্যস্ফীতি-সংক্রান্ত যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া হয়েছে, সেগুলো একেবারেই পর্যাপ্ত নয়।'
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, 'কর কাঠামোর বিষয়ে আমরা কিছুদিন আগে আমাদের বাজেট প্রস্তাবনায় বলেছিলাম, নিত্যপ্রয়োজনীয় পন্য যেগুলো আছে সেগুলোর বিভিন্ন ধরনের যে কর আছে সেগুলো উঠিয়ে দেওয়া হোক। কিছু কিছু পণ্যের ওপর কর উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু সেগুলো পর্যাপ্ত নয়। কারণ তার বাইরেও মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ভোগ করতে হয়। আমরা এই বাজেটের মধ্যে দেখলাম গম ছাড়া আর কোনো পণ্য দেখা যাচ্ছে না। আমরা বলেছিলাম চাল, চিনিসহ অন্যান্য পণ্যের ওপর কর ছাড় দিতে।'
তিনি বলেন, 'মূল্যস্ফীতির পদক্ষেপের প্রেক্ষিতে ব্যাক্তি খাতে ন্যূন্তম করমুক্ত আয়ের সীমা সাড়ে ৩ লাখ টাকা করার কথা বলেছিলাম আমরা। কিন্ত সেটা তিন লাখেই রয়েছে। কিন্তু অন্যদিকে যদি আমরা দেখি, অন্যান্য যারা এর চাইতে ভালো অবস্থায় আছে, তাদের সুবিধার জন্য কিছু কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বিশেষ করে করের ক্ষেত্রে। যেমন বেতনের বাইরে বিভিন্ন ধরনের যে ভাটা থাকে, সুযোগ-সুবিধা যাতায়াত, বাড়িভাড়া স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদির ক্ষেত্রে করমুক্ত আয়ের সীমা সাড়ে ৫ লাখ টাকা থেকে ১০ লাখ টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। এটা তো একবারে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য করা হয়নি। এরকম আরও অনেক উদাহরণ আছে।
অর্থমন্ত্রী কৃষি খাতে ভর্তুকি বৃদ্ধির যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তাকে সাধুবাদ জানান ফাহমিদা খাতুন। কিন্তু অর্থমন্ত্রী গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য ক্রমান্বয়ে সমন্বয় করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। অর্থাৎ ভবিষ্যতে এসবের মূল্য আরও বাড়বে। কিন্তু এতে মানুষের ব্যয়ের ওপর চাপ পড়বে।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক বলেন, 'মূল্যস্ফীতিকে মাথায় রেখে অরেকটি অন্যতম পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সামাজিক সুরক্ষার পরিসর এবং পরিমাণ বাড়ানো। গত বছরের সংশোধিত বাজেটেরে চেয়ে তা কম হয়েছে। সামাজিক সুরক্ষা খাতে জিডিপির ২.৫৫ শতাংশ রাখা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে সেটা ২.৮ শতাংশ রয়েছে। এবার বাজেটের পরিমাণ হিসাবেও কমানো হয়েছে। এই খাতে অনুপাতিক হারে বরাদ্দ কমানো হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে সামাজিক সুরক্ষার পরিমাণ কমানো হয়েছে। খোলাবাজরে পণ্য বিক্রির পরিমাণ কমানো হয়েছে। অনেক ধরনের সামাজিক নিরাপত্তার প্রকল্প কমানো হয়েছে, সেটা একবারেই কাম্য নয়।
'বৈদেশিক সাহায্যের অর্থ ব্যবহার এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোনো স্পষ্ট পথনির্দেশনা নেই এই বাজেটে। মেগা প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে আমরা জানি যে বেশরিভাগ প্রকল্প এখনো বাস্তবায়নে পিছিয়ে রয়েছে। একই অবস্থা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের ক্ষেত্রে। আর প্রকল্প বাস্তবায়নে পিছিয়ে যাওয়া মানেই হলো সেখানে ব্যয় বেড়ে যাওয়া।'
কর আহরণের ক্ষেত্রে কিছু নতুন উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হলেও তেমন কোনো নতুন উদ্যোগ তারা সিপিডি দেখছে না বলে মন্তব্য করেন ফাহমিদা খাতুন। করপোরেট কর কমানোর ফলে উৎপাদন ও ব্যবসার ক্ষেত্রে তা সহায়ক হলেও, তাৎক্ষনিকভাবে তা দরিদ্র জনগণের জন্য কাজে লাগবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, 'বিদেশ থেকে টাকা আনার ব্যাপারে বিভিন্ন ধরনের কর ছাড়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে এই বাজেটে। এটা একবারেই অনৈতিক। এটা কখনো বাস্তবায়ন হয় না, বাস্তবায়ন হওয়ার মতো না। সেটির চাইতে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এ ধরনের পদক্ষেপ অনৈতিক। কারণ প্রথমেই আমরা এরকম সুযোগ করে দেব মানুষকে, বিভিন্ন অনৈতিক পথে আয় করার কিংবা অর্থ একোমুলেট করার, তারপরে আবার বিভিন্ন কর ছাড়ের মাধ্যমে তাদেরকে সুযোগ করে দেব দেশে নিয়ে আনার। অথচ দরিদ্র জনগনের জন্য কিংবা নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য কর ছাড়ের ক্ষেত্রে তেমন কিছু করব না, সেটা কিন্ত্র একবারেই সামাজিক ন্যায়বিচারের দিক থেকে গ্রহণযোগ্য নয়।'
প্রস্তাবিত বাজেটে আমদানি কমাতে আমদানি বিকল্প শিল্পকে প্রাধিকার দেওয়াকে স্বাগত জানান সিপিডির নির্বাহী পরিচালক। এই পদক্ষেপ কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়তা করবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি বলেন, 'টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল করা এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সন্তোষজনক অবস্থা রাখতে বলা হয়েছে বাজেটে। কিন্তু সেটি নিয়ে কোনো পরিষ্কার পদক্ষেপ বা নির্দেশিকা দেখছি না প্রস্তাবিত বাজেটে।
'সর্বজনীন পেনশনের কথা প্রস্তাবিত বাজেটে উল্লেখ থাকলেও কীভাবে এটি বাস্তবায়ন করবে, সেটার কোনো গাইডলাইন বা সুস্পষ্ট পদক্ষেপের কথা বলা নেই।'