‘শুধু একবার বাসার মানুষের গলার আওয়াজ শুনতে প্রতি মিনিটে কল দিচ্ছে’
একটা দেশের জেলা শহর, যে জেলাতে প্রায়ই ফ্ল্যাশ ফ্লাড হয়, সেখানে কার্যকর একটা ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট টিম নাই৷ সুনামগঞ্জে এই মৌসুমে প্রায়ই নিচু অঞ্চলে একটু পানি উঠে, আবার নেমেও যায়। এ কারণে এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য কেউ মানসিকভাবেও প্রস্তুত ছিলো না৷ একটা ভার্চুয়াল ওয়েদার রিসার্চ সেন্টার পর্যন্ত তাদের বিজ্ঞপ্তিতে দুইবার জানান দিয়েছে এই বন্যার সতর্কবার্তা, কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে কোনো পূর্বাভাসই দেওয়া হয়নি, আর স্থানীয় পর্যায়ে সেটার এক্সকিউশন তো দূরের কথা।
কোনো ধরনের পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া, মানসিক প্রস্তুতি ছাড়া শুধু কয়েক ঘণ্টার নোটিসে আমাদের সবার সবকিছু পানির নিচে তলিয়ে যেতে দেখতে হলো, তারপরও প্রশাসনের কোনো ভ্রুক্ষেপ নাই।
গত পরশু দুপুর থেকে ভোররাতের মাঝে এতো দ্রুত পানি বাড়ছে, এতো আকস্মিকভাবে বাড়ছে, এমন হবে কল্পনাই করিনি কখনও। গত পরশু দুপুরেও শুনলাম আমাদের বাসার খালি পুকুরঘাট পর্যন্ত পানি উঠেছে, সন্ধ্যায় শুনলাম সিঁড়িতেও, আর রাত আটটার দিকে ঘরের মধ্যে। রাতের বেলা মা-বাবা বিছানার ওপর চেয়ার তুলে সেই চেয়ারে ছিল। রাত তিনটার দিকে শুনলাম ঘরে কোমর পানি, দরজা পর্যন্ত নৌকা নিয়ে আসছে। ভোর পাঁচটার দিকে শুনি নৌকা কোথায় যেন আটকে গেছে, বাবা-মা ঘরের মাঝে আটক, নৌকা আর আসছে না।
এই অবস্থায় নেটওয়ার্ক চলে গেছে। সারা সুনামগঞ্জে কোনো মোবাইল নেটওয়ার্ক নাই, ইলেক্ট্রিসিটি নাই। কী অবস্থায় যে ওই কয়টা ঘন্টা পার করছি! নিঃশ্বাস বন্ধ করে প্রতিটা মিনিট ধরে ধরে গুনেছি আমি, আর চিন্তা করেছি শুধু কী হতে পারে! প্রতি মিনিটে কল দিয়েছি কাউকে না কাউকে, নেটওয়ার্ক নাই, চার্জ নাই, কেউ কোনো খবর দিতে পারে না।
এই ভোরটা আমার জীবনের ভয়াবহতম ভোর। সুনামগঞ্জের আমরা যারা বাইরে আছি, সবার তখন একই ভয়াবহ অবস্থা। কেউ নিজেদের পরিবারের খোঁজ জানে না, কী অবস্থা কোথায় আছে কোনো খবর নাই। তারপর আস্তে আস্তে যারা পারলো, একটু একটু করে খবর দেওয়া শুরু করলো। মা সকাল সাতটার দিকে কল দিয়ে জানালো সেফ আছে, কিন্তু বাবা বাসায় একা। এরপর পাগলের মতো সবাইকে জিজ্ঞেস করলাম বাবার কোনো খবর জানে কিনা, কেউ কিচ্ছু বলতে পারে না, যোগাযোগও করা যায় না। তখন আমি কীভাবে যে দাঁড়িয় ছিলাম, কীভাবে যে মানুষের সাথে কথা বলছি, জানি না। আমার মাথা জাস্ট কাজ করা বন্ধ করে দিছে।
এরপর দুপুর একটার সময় খবর পাই বাবা সেফ আছে। তাও তো আমি খবর পেলাম, যোগাযোগ হয়েছে বেশ কয়েকবার। আমার কতো বন্ধু-সিনিয়র-জুনিয়র দুইদিন ধরে বাসার কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারে নাই, কী অবস্থায় আছে কোথায় আছে কিচ্ছু জানে না। গত রাত থেকে এখনও পর্যন্ত শুধু একবার বাসার মানুষের গলার আওয়াজটা শুনবে, এজন্য আমার বন্ধুরা প্রতি মিনিটে কল দিচ্ছে, কোনো খবর পাচ্ছে না। একেকজন কল দিয়ে কাঁদছে, কেউ কারো বাসার খবর দিতে পারছে না।
এই ভয়াবহ অবস্থার পরও সুনামগঞ্জে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো উদ্ধার এবং ত্রাণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে বলে খবর পাই নাই। প্রথমে তো মিডিয়াতেই খবর যাচ্ছিলো না, কারণ স্থানীয় সাংবাদিকরা নিজেরাই তো বন্যার ভেতর, সাথে নেটওয়ার্কহীনতা। বাইরে থেকে জেলার ছেলে-মেয়েরা প্রতিটা নিউজ মিডিয়ায় মেসেজ করে করে, যোগাযোগ করে মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায় সুনামগঞ্জের খবর জানানোর চেষ্টা করেছে। শহরে-গ্রামে প্রতিটা এলাকায় মানুষ আটক, উদ্ধার করার জন্য কোনো নৌকা নাই, কোনো সাহায্য নাই।
একজন আপু গতকাল সারাদিন সবার সাথে যোগাযোগ করেও তার পরিবারকে উদ্ধার করতে পারেন নাই, এখনও জানেন না কী অবস্থা। এরকম শত শত মানুষ এই এলাকায় পানিবন্দি, সরকার থেকে এখনও পর্যন্ত কোনো উদ্ধারকার্যের ব্যবস্থা নাই। কিছু মানুষ স্বেচ্ছাসেবী হয়ে উদ্ধার করছে গতকাল সারাদিন, কিন্তু তাদেরও পর্যাপ্ত রিসোর্স নাই, লোকবল নাই।
গতকাল বলা হলো জরুরি অবস্থায় সেনাবাহিনীকে দিয়ে উদ্ধারকার্য আর ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম চালানোর কথা। সেই সেনাবাহিনী গতকাল বন্যাদুর্গত অঞ্চলে ট্রাক নিয়ে রওনা দিল এবং অর্ধেক রাস্তায় আটকে বসে আছে খবর শুনলাম। সুনামগঞ্জে এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয়ভাবে বড় পরিসরে কোনো উদ্ধার-ত্রাণ কার্যক্রম নাই, ইমারজেন্সি নেটওয়ার্ক তো দূরের কথা। গতকাল থেকে স্থানীয় প্রশাসনসহ সবাই যোগাযোগের বাইরে, এতো এতো মানুষের নিরাপদ আশ্রয়-খাবার-পানি-টয়লেটের ব্যবস্থা কিচ্ছু নাই।
এই বন্যায় যে ভয়াবহতা-দুর্বিষহতা সুনামগঞ্জবাসী দেখলো এবং টের পেলো তারা কী প্রচন্ডরকম অবহেলিত, এটা সুনামগঞ্জের মানুষ ভুলবে না। ১৬ জুন রাতের মতো ভয়াবহ রাত বাকি সবাই ভুলে গেলেও, আমাদের যাদের মুখের গ্রাস-মাথার ছাদ পানির নিচে চলে গেলো, আমরা ভুলে যাবো না। প্রতিবার প্রতি ঘটনাই বারবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে যাচ্ছে, এখন এই রাষ্ট্রের জনগণ শুধুমাত্র সংখ্যা ছাড়া আর কিচ্ছু না।
- প্রাপ্তি তাপসী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী