ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু, ৮০ বছর পরও জনপ্রিয় নিউ শাহী দিল্লীর হালুয়া-লুচি!
১৯৪২ সালের ঢাকা। ভারতবর্ষের অবিভক্ত বাংলার অন্যতম নগরীর ব্যস্ততম রাস্তা পাটুয়াটুলী রোড। দুই ভাই, বাবু মিয়া আর হাবিব আহমেদ মিলে সদরঘাটের পাশে সেই রোডে শুরু করেছিলেন এক মিষ্টির দোকান। আগে থেকেই মিষ্টি বানানোয় দক্ষ ছিলেন দুজনেই। তৎকালীন অবিভক্ত ভারতের রাজধানীর নামে দোকানের নাম দিয়েছিলেন 'নিউ শাহী দিল্লী সুইটমিট'। এলাকার ব্যবসায়ী, ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে অল্প সময়ের মধ্যেই তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল সেখানকার মিষ্টি হালুয়া, জিলাপি আর বরফি।
অবিভক্ত ভারতবর্ষের ভাগ হলো, পাকিস্তানীদের হটিয়ে দেশ স্বাধীন হলো, মাঝে কেটে গেলো ৮০ বছর। এই পুরো সময় জুড়ে শাহী দিল্লী তার খাবারের শাহী স্বাদ বজায় রেখে ঢাকাবাসীর প্রিয় খাবারের দোকানের তালিকায় স্থায়ী হয়ে রইলো।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের রাস্তায় পাটুয়াটুলীর দিকে এগিয়ে গিয়ে হাতের ডান দিকে দেখা মিললো আট দশকের পুরোনো সেই নিউ শাহী দিল্লী সুইটমিটের। নিচতলায় ছোট্ট মিষ্টির দোকান। সেখানে কাঁচের শেলফে সাজানো রঙ-বেরঙের বরফি, কালোজাম, চমচম, লালমোহন আর রসমালাই। দোকানে বসা লোকটি জানালো নাস্তা খেতে চাইলে দু কদম সামনে এগিয়ে বেজমেন্টের রেস্টুরেন্টে চলে যেতে। সরু সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে ঢুকলাম রেস্টুরেন্টটিতে।
নামে শাহী দিল্লী হলেও বেশভূষায় সাধারণ বাংলা হোটেলের ছাপ স্পষ্ট। ছোট্ট রেস্টুরেন্টটিতে ৪টি টেবিলে ৬ জন করে ২৪ জনের মতো বসার জায়গা। সামনের ক্যাশের পাশেই সারি সারি সাজানো জিলাপি, হালুয়া, লাড্ডু, সিংগারা, লুচি। সাড়ে ১১টার দিকেও সকালের নাস্তার জন্য নানা বয়সী কাস্টমারের ভিড় প্রতিটি টেবিলেই। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে এক বয়স্ক দম্পতির সাথে টেবিল শেয়ার করেই বসলাম। খাবারের জন্য অপেক্ষা করতে করতে আলাপ হলো তাদের সাথে।
কেরানীগঞ্জ থেকে নাতিকে স্কুলে দিতে এসেছেন গোপাল সরকার ও স্বর্ণলতা সরকার। গোপাল বাবুর পছন্দ এখানকার গাজরের হালুয়া, পাতলা ভাজি আর সাথে লুচি। তার স্ত্রী স্বর্ণলতার আবার ঝাল খাবারই পছন্দ। টক দই-পুদিনার চাটনি দিয়ে এখানকার সিংগারা বড় প্রিয় তার। নাতিকে স্কুলে আনা নেওয়ার পথে প্রায়ই নাস্তা করা হয় এখানে। খাবারের টাটকা স্বাদের পাশাপাশি দামও অল্প। তাই গোপাল সরকারের কাছে পুরান ঢাকার প্রিয় হোটেলের তালিকায় শাহী দিল্লী অন্যতম।
সরকার দম্পতির সাথে গল্প করতে করতেই চলে এলো আমাদের অর্ডার করা নাস্তা। গাজরের হালুয়া, বুটের ডালের হালুয়ার সাথে লুচি, পরোটা আর সবজি। ডাল শেষ হয়ে গেছে আগেই। গরম গরম সবজি, লুচির স্বাদ অনবদ্য। এখানকার গাজরের হালুয়ার নাম-ডাক বেশি হলেও আমাদের কাছে বুটের ডালের হালুয়াই বেশি ভালো লাগলো। শাহী দিল্লীর রঙ-বেরঙের নানা পদের মিষ্টির স্বাদ চেখে দেখতে অর্ডার করলাম মাওয়া লাড্ডু, জিলাপি আর বুন্দিয়া। এদের সব আইটেমেই মিষ্টি পরিমিত। খুব কড়া মিষ্টি পছন্দ নয় বলে সবগুলোই মন জয় করে নিলো আমার।
পাশের টেবিলে বসে নাস্তা সারছিলেন ইসলামপুরের ব্যবসায়ী কাজী জানে আলম। চল্লিশ বছর ধরে এখানে খেতে আসেন তিনি।
"এদের ডালটা খুবই প্রিয় আমার। এমন স্বাদ আর কোথাও পাই না। সকাল সাতটার মধ্যেই ডাল শেষ হয়ে যায়। পাশেই আমার কাপড়ের দোকান। কাজের ফাঁকে সকাল, দুপুর বা বিকালে নানা সময়ে খেতে আসি এখানে। সবসময় ভিড় লেগেই থাকে," বলছিলেন জানে আলম।
বংশানুক্রমে হোটেলের দেখাশোনার ভার পেয়েছেন হাবিব আহমেদের ছেলে নাজিব আহমেদ আর তার ছোট ভাই। নিয়মিত দোকানে বসেন নাজিব আহমেদ। তিনি বলেন, "শুরুর দিকে আমার বাবা-চাচাই ছিলো মিষ্টির কারিগর। তারাই মিষ্টি বানাতো আবার বিক্রিও করতো। এখন তাদের ফর্মুলাতেই মিষ্টি বানায় অন্য কারিগর। মুন্সিগঞ্জের রামপাল থেকে আসে দুধ। ফ্রেশ মিষ্টির স্বাদ বজায় রাখতে অল্প অল্প করে রোজ মিষ্টি বানানো হয় আমাদের এখানে।"
দোকানের নামের আগে 'নিউ' থাকার কারণ জানতে চাইলে নাজিব বলেন, "আমাদের দোকান শুরুর আগে এখানে দিল্লী সুইটমিট নামে আরেকটা মিষ্টির দোকান ছিল। তাই নামের আগে 'নিউ' লাগানো হয়েছিল।"
নাজিব আহমেদ জানান আগে সুইটমিট আর রেস্টুরেন্ট দুটোই ছিল উপরে, ২২ বছর ধরে নিচে বেজমেন্টে স্থানান্তরিত হয়েছে রেস্টুরেন্টটি। শুরু থেকেই ইসলামপুরের ব্যবসায়ীরাই এখানে খেতে আসেন বেশি। তবে বিশ্ববিদ্যালয় খোলা থাকলে নাস্তার জন্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভিড় করেন নিয়মিতই। প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত খোলা থাকে নিউ শাহী দিল্লী সুইটমিট এন্ড রেস্টুরেন্ট।
বর্তমানে হোটেলটিতে কর্মচারী আছে ৩০ জনের মতো। কথা হয় তিন বছর ধরে এখানে কাজ করা কায়সার আহমেদ প্রিন্সের সাথে। বললেন, "সারাদিনই ভিড় লেগে থাকে হোটেলে। তিন বেলাই বানানো হয় সবজি-লুচি। মিষ্টি কিনে নিয়ে যাওয়ার চেয়ে হোটেলে বসেই বেশি খায় কাস্টমাররা। ব্রিটিশ আমলের পুরানো ইন্ডিয়ান ফর্মুলাতে বানানো হয় এখানকার সব মিষ্টি। তাই অন্য জায়গার চেয়ে এখানের মিষ্টির টেস্ট আলাদা।"
পরিচিত হালুয়া, মিষ্টির পাশাপাশি শাহী দিল্লী সুইটমিটে পাওয়া যায় দুধের তৈরি হালুয়াসন, নেশেস্তার হালুয়া, চকলেট বরফি, মাশকলাইয়ের আমিত্তিসহ আরও নানা চমকপ্রদ মিষ্টি। ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা কেজিতে পাওয়া যায় নিজস্ব কারখানায় বানানো সেমাই। ঈদ উপলক্ষে তৈরি হয় ঘিয়ে ভাজা স্পেশাল লাচ্ছা সেমাই। যার কেজি প্রতি দাম ১২০০ টাকা। ১০ টাকা পিস দামে পনিরের সমুচাও পাওয়া যায় এখানে। কিমা সমুচার দাম প্রতি পিস ১৫ টাকা।
প্রতি পিস লুচির দাম ৫ টাকা, পরোটা ১০ টাকা, সবজি প্রতি প্লেট ২০ টাকা, আলুর দম ১৫ টাকা, ডাল ১৫ টাকা, গাজরের হালুয়া ৩৫ টাকা, বুটের ডালের হালুয়া ৩০ টাকা। এছাড়া অন্যান্য সব মিষ্টির দামও হাতের লাগালেই।
জনপ্রিয়তা বজায় থাকলেও ব্যবসার অবস্থা ভালো নয় জানালেন নাজিব আহমেদ। "করোনাতে করুণ অবস্থা আমাদের। ইদানিং জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে দুই গুণ-তিন গুণ করে। হোটেল ব্যবসায়ী সবাই লসে চলছে এখন। এভাবে সবকিছুর দাম বাড়তে থাকলে ব্যবসা চালিয়ে নেওয়া যাবে না," বলেন নিউ শাহী দিল্লী সুইটমিটের এই সত্ত্বাধিকারী।