টাঙ্গুয়ারের মানুষ এমন বন্যা কখনো দেখেনি
গত রাতে ডালিম কল দিয়েছিল, টাঙ্গুয়ার হাওরে টুরিস্ট বোট অপারেটর হিসেবে কাজ করে ও। "স্যার, আমি ডালিম। মনে আছে আমাকে? গত বছর হাওর ঘুরতে আমার নৌকা ভাড়া নিয়েছিলেন," বললো ডালিম।
ভালোভাবেই ডালিমকে মনে আছে আমার। অন্তত দুই ডজন মানুষের ধারণক্ষমতা সম্পন্ন তার টুরিস্ট বোটটি, রাতের বেলায় সংখ্যাটি ১ ডজনের কিছু বেশি। সাদামাটা বিছানা আর পরিষ্কার টয়লেটের একটি বোট।
আমি সাথেসাথেই বুঝতে পারি কেন আমাকে কল দিয়েছে। সিলেটে বন্যার প্রকোপ, হয়তো চূড়ান্ত বিপদে পড়েছে সে, সাহায্যের দরকার।
হাওরের মধ্যে প্রায় ১০০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের ছোট ছোট দ্বীপে বাস ডালিম ও তার মতো আরও অনেকের। বছরের বেশিরভাগ সময় এই মানুষগুলোর যে কোনো ছোটখাটো কাজেও নৌকার দরকার পড়ে। শীতকালে পানি নেমে গেলে তারা কিছু ফসল ফলাতে পারে। অন্য সময়, শুধু মাছ ধরে বা পার্শ্ববর্তী সীমান্তের কাছে বালুর খনিতে কাজ করে কিংবা টুরিস্ট বোট চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে তারা।
যে ভয় পাচ্ছিলাম, তাই হলো, ডালিম বললো, "দুইদিন আগে বন্যায় আমার ঘর ভেসে গেছে। খাবার, কাপড়-চোপড় কিছুই নাই। বাড়িতে যা টাকা রাখা ছিল তাও আনতে পারিনি। এতো বাজে অবস্থায় না থাকলে আপনাকে কল দিতাম না"।
ডালিমের মতো মানুষরা এ পানির রাজ্যে ১৫০ বছরের বেশি সময় ধরে বাস করে। যদিও পানিকে সঙ্গী করেই তাদের দিন-যাপন, ও জানালো তাদের গ্রামের সবচেয়ে বৃদ্ধ মানুষটিও আগে কখনো এমন সর্বনাশা বন্যা দেখেনি।
"রাতারাতি পানির স্তর বাড়লো, এতো তাড়াতাড়ি যে কোনোমতে নিজেরা বেঁচে আসছি", বললো ডালিম।
গবাদি পশু, মুরগী, হাঁস আর কুকুর- গ্রামীণ জীবনের নিত্যদিনের অংশ-কী হচ্ছে তারা বুঝে ওঠার আগে সবই ভাসিয়ে নিয়েছে বন্যা।
"আমাদের টিনের ছাদ পর্যন্ত পানি উঠে গেছে", বললো ডালিম।
তার আশেপাশের তিনটি দ্বীপ গ্রামে ১২০টি পরিবারের বাস, বন্যার পানির বাড়ার সঙ্গেসঙ্গে তারা সবাই নৌকায় আশ্রয় নেয়। বসে বসে নিজেদের টিন শেডের বাড়ি পানির নিচে তলিয়ে যেতে দেখতে হয় তাদের।
গ্রামবাসীরা 'হাওর বিলাস' নামের একটি টুরিস্ট রিসোর্ট বানিয়েছিল। রিসোর্টটি ইটের তৈরি, ছাদ টিনের, নির্মাণে কিছুটা আধুনিকতার ছোঁয়াও আছে। এটিও ডুবে গেছে। রিসোর্টটির কাঠামো টিকে আছে, তবে দরজা-জানালা কিছুই নেই।
এরপর গ্রামবাসী পার্শ্ববর্তী স্কুল, মসজিদ আর সীমান্তবর্তী পাহাড়ে আশ্রয় নেয়।
কিন্তু তাদের বেশিরভাগের কাছেই ছিল না কোনো কাপড় বা টাকা।
গত রাতে তাৎক্ষণিকভাবে ডালিমের জন্য সাহায্যের ব্যবস্থা করি আমি। আজ সকালে তার কী অবস্থা জানতে কল দিলাম।
তখন বাজারে ছিল সে, পরিবারের জন্য খাবার কিনছিল। "পানি কমছে এখন। কিন্তু এখনো বৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের বাড়ি-ঘর এখনো পানির নিচে, কবে যেতে পারবো তাও জানিনা", জানালো ডালিম।
মানুষ এখন একজন আরেকজনের সঙ্গে খাবার ভাগাভাগি করে নিচ্ছে, অপেক্ষায় আছে কখন সাহায্য পৌঁছাবে। সবকিছুরই অভাব এখন সেখানে।
ডালিমের কাছ থেকে তিনটি গ্রামের দুর্দশার কথা জানলাম আমি। কিন্তু বিশাল হাওড়ে গ্রাম আছে ৪৬টি। আপনি কখনো সেখানে গেলে সহজেই বুঝতে পারবেন, এসব কোনো গ্রামই বন্যার করাল গ্রাস থেকে রেহাই পায়নি।
লেখাটি ইংরেজিতে পড়ুন: Tanguar Haor people never saw a flood like this