যশোরে গড়ে উঠেছে ১৫০ কোটি টাকার নকশি কাঁথা শিল্প
ছাত্রাবস্থায় পরিবারিক টানাপোড়েন দেখে কিছু একটা করে পরিবারের হাল ধরার চেষ্টা করেন মরিয়ম নার্গিস। হয়ে ওঠেন নকশি কাঁথা উদ্যোক্তা। বর্তমানে মাসে তার ৪-৫ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি হয়।
যশোর এমএম কলেজ থেকে মাস্টার্স শেষ করে, নিজের জমানো ১০ হাজার টাকা নিয়ে ২০১১ সালে শুরু করেন নকশি কাঁথার ব্যবসা।
যশোর সদরের এই উদ্যোক্তা এখন টুইংকেল ক্রাফ্ট অ্যান্ড যশোর নকশি ব্র্যান্ডের স্বত্ত্বাধিকারী। ৫ হাজারের অধিক কর্মী রয়েছে তার প্রতিষ্ঠানে। বছরে তার টার্নওভার প্রায় ৫০ লাখ টাকা।
"যেভাবে আমার নকশি কাঁথার ব্যবসা সুনাম কুড়াচ্ছে,আশা করি আগামী ৫ বছরে আমার ব্যবসা দুই-তিনগুন বৃদ্ধি পাবে", দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন ৩৬ বছর বয়সী এ উদ্যোক্তা।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা যশোরে সফলতার এমন গল্প অনেক আছে।
বর্তমানে যশোর জেলায় অন্তত ১০ হাজার নকশিঁ উদ্যোক্তা রয়েছে। যাদের প্রায় ১০০% নারী উদ্যোক্তা, এরমধ্যে অনেকেই বিধবা-ডিভোর্সি নারী।। বর্তমানে যশোরে কম করে হলেও বছরে ৫ লাখ পিস নকশি কাঁথা উৎপাদন হয়। বছরে প্রায় ১৫০ কোটি টাকার নকশি পণ্য বিক্রি হয়। এ খাতে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে প্রায় ৩ লাখ মানুষ জড়িত।
যশোরের নকশিকাঁথা সূচিশিল্প শত শত বছরের আলোকময় ইতিহাস। ইতিহাস খুঁজলে দেখা যায় পাঁচ-সাতশ বছর আগে থেকেই এই জনপদের মানুষ শীত নিবারণের জন্য নকশিকাঁথা গায়ে জড়িয়ে ওম নিয়েছে। পুরাতন ব্যবহৃত শাড়ির পাড়ের সুতো তুলে নানী দাদীরা বছরের পর বছর ধরে নকশিকাঁথা সেলাই করেছেন। এক সময় তুলো থেকে সুতো তৈরি করে সেই সুতো দিয়ে গৃহবধূরা নকশিকাঁথায় তাদের শিল্পনৈপুণ্য ফুটিয়ে তুলেছেন।
এসএমই ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুসারে, জেলায় ৫০০টির মতো কারখানায় প্রায় ২০-২৫ হাজার শ্রমিক কাজ করে। কয়েকশ সাব কন্ট্রাকটর রয়েছে।
করোনা মহামারির শুরুতে কয়েক মাস ক্ষতিতে থাকলেও পরবর্তীতে অনলাইনে বিক্রি বেড়ে যায় নকশি পণ্যের। জেলাটির উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, অনলাইন-অফলাইন মিলে করোনার আগের তুলনায় ৪০-৫০ শতাংশ বিক্রি বেড়েছে।
জেলার আরেক উদ্যোক্তা সোনিয়া সাকিন টিবিএসকে বলেন, "লকডাউনে সব বন্ধ থাকায় বাধ্য হয়ে অনলাইনে পণ্য বিক্রি করা শুরু করি। করোনার আগে আমার মাসিক বিক্রি ছিল ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকার মতো, বর্তমানে আমার তা বেড়ে ২ থেকে আড়াই লাখ টাকার মতো হয়।"
অনলাইন-অফলাইনে এখন বিক্রি অনেক বেড়েছে তার, মানুষ অনলাইনে পণ্য দেখে অর্ডার দিচ্ছে ,অনেকে অনলাইনে দেখে সশরীরে এসে কিনে নিচ্ছে।
যশোর নকশি কাঁথার ফোঁড়, কাঁথার পাড় ও নকশার গুণগত মান বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে ভিন্ন। এ এলাকার নকশি কাঁথার পাশাপাশি নকশি ব্যাগ, থ্রি-পিস, ফতুয়া, বেডশিট, কুশন কভার, শোবিজও ইত্যাদি তৈরি করা হয়।
সাধারণত নকশি পণ্যগুলোর দাম সর্বনিম্ন ১ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।
যশোরের শার্শা উপজেলার লেবুতলা গ্রামের সাফারম বিবি (৫৫) প্রায় ২০ বছর ধরে নকশি পণ্যের কারিগর হিসেবে কাজ করেন। তিনি বাসাবাড়ির কাজের পাশাপাশি এ কাজ করে মাসে ৩০০০ টাকার মতো আয় করেন।
তিনি টিবিএসকে বলেন, যে হারে বর্তমানে নারীরা এ পেশায় শ্রম দিচ্ছে, তারা যদি সামান্য প্রশিক্ষণ ও ব্যবসার পুজিঁ পেতেন, তাহলে তাদের বেশির ভাগই উদ্যোক্তা বনে যাবেন অনায়সে।
নকশী রং ব্র্যান্ডের মালিক ফাতিমা খাতুন বলেন, "আমাদের উদ্যোক্তাদের অনেকেই খুবই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, অনেকেই নিজেই বুনেন এবং বিক্রিও করেন। কোনো ধরনের সরকারি-বেসরকারি আর্থিক সহযোগিতা পেলে তারা ব্যবসাও বড় করতে পারতেন এবং বহু লোকের কর্মসংস্থান তৈরি করতেন।"
যশোর নকশী কাঁথা অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ইমরুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, এখানকার উদ্যোক্তাদের মূল্য সীমাবদ্ধতা হলো স্বল্প সুদে জামানতবিহীন পর্যাপ্ত ঋণ সুবিধা না পাওয়া এবং পাশাপাশি উৎপাদিত পণ্যের জন্য কোনো নির্দিষ্ট ডিসপ্লে সেন্টার না থাকা।
"কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়া এ খাত প্রায় নিজ উদ্যোগেই এ পর্যন্ত এসেছে। যদি সরকার এ খাতের দিকে নজর দেয় তাহলে আগামী ১০ বছরে এ খাতে প্রায় ৮-১০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান অনায়াসেই সম্ভব।"
এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যব স্থাপনা পরিচালক ড. মফিজুর রহমান জানান, যশোর বা ঢাকাতে একটি স্থায়ী ডিসপ্লে সেন্টার স্থপনের পরিকল্পনা আছে তাদের।
পাশাপাশি প্রশিক্ষণ কর্মসূচি আরো বাড়ানো ও উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে আরো বেশি ঋণ দেয়ার জন্য ব্যাংকগুলোকে সুপারিশ করবে সংস্থাটি।