বাইডেন কেন রিয়াদের দিকে ছুটছেন?
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জুলাইয়ে মধ্যপ্রাচ্য সফরে যাচ্ছেন জানিয়ে সম্প্রতি নিজেদের পরিকল্পনা সামনে আনে হোয়াইট হাউজ। এই সফরের অংশ হিসেবে প্রথমে তিনি ইসরায়েল হয়ে পরে যোগ দিবেন গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল (জিসিসি) এর সম্মেলনে, স্থান সৌদি আরব।
প্রতিদিন যে হারে নতুন নতুন খবর সৃষ্টি হচ্ছে সে দৃষ্টিতে বলা যায় যারা আন্তর্জাতিক রাজনীতির টুকটাক খবর রাখেন তাদের কাছে গণমাধ্যমের কল্যাণে এই সংবাদ এখন একরকম পুরনো জিনিস। তবে এতো নতুন-পুরনোর ভীড়ে এখন অবধি যা কৌতূহলোদ্দীপক হয়ে আছে তা হল বাইডেনের রিয়াদ যাত্রার মোড়কে মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথে সাক্ষাৎ!
রাষ্ট্রের কর্তারা একে অপরের সাথে সময়ে সময়ে দেখা সাক্ষাৎ করেন, এটাও তার বাইরে বিশেষ কিছু নয় এমন ভাবলে আপনি ভুল করছেন অন্তত গত কয়েক বছর ধরে জামাল খাসোগি হত্যার পর থেকে রাজপরিবারের সাথে ওয়াশিংটনের সম্পর্ক একপ্রকার উত্থান-পতনের আবর্তে কেটেছে।
তবে সবচেয়ে চমক জাগানিয়া বিষয় হল প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সাথে যুবরাজের ব্যাক্তিগত সম্পর্ক মোটেই ভাল যাচ্ছে না বলা যায়, কারণ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বাইডেন প্রায় সময়ই এমবিএসের বিরুদ্ধে মতামত দিয়েছেন এরপর এমবিএস এর ভরা মজলিশে বাইডেনকে এড়িয়ে চলা থেকে ফোনকল বিতর্কের প্রেক্ষাপটে দুজনের নতুন করে এক সাথে হওয়া কল্পনা করাই দুরূহ ছিলো।
তবে বাইডেন রিয়াদে গিয়ে এমবিএসের সাথে বৈঠক করবেন কি না সেই জল্পনা এখনো কাটেনি, বাইডেন যদিও এই সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন তবে হোয়াইট হাউজের প্রেস সেক্রেটারি জেন সাকির উদ্ধৃতি মতে জিসিসি সম্মেলনের সময় অন্যান্য আন্তর্জাতিক নেতৃবৃন্দের মত বিন সালমানের সাথেও হয়ত বৈঠক হতে পারে, তবে তার সাথে আলাদা ভাবে বসার কোন পরিকল্পনা নেই, আসলে এই কথার মধ্যেই লুকিয়ে আছে কূটনৈতিক মারপ্যাচ। বাইডেন যতই এমবিএসকে বাদ দিয়ে তার বাবার দিকে মনযোগী হন না কেন দিনশেষে ডি-ফ্যাক্টো লিডার তো এমবিএসই, তাই যতই শাক দিয়ে মাছ ঢাকাঢাকি চলুক বাইডেন রথ দেখতে এসে কলা বেচবেন না তা কি করে হয়!
এখন কথা হল, আমেরিকার 'জিওপলিটিকাল ইন্টারেস্টে' ইদানিং সবচে বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে ইন্দো প্যাসিফিক তাহলে তাদের হটাৎ কেন আবার মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে হন্তদন্ত হওয়া লাগছে? এটা অজানা নয় মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানি তেলই তাদের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা, আর সৌদি আরব এখানে আছে সামনের কাতারে, একই সাথে তারা ওপেক প্লাসেও অগ্রগণ্য।
এমন পরিস্থিতিতে সৌদির সাথে তিক্ত সম্পর্ক তাদের জন্যই অমঙ্গল বয়ে আনবে, যা ইতোমধ্যে তারা টেরও পাচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই। রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবরোধ যুক্তরাষ্ট্রের জন্যই কাল হয়ে দাড়িয়েছে, জ্বালানি সংকটের প্রভাব গিয়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে, গত চার দশকের ইতিহাসে মুদ্রাস্ফীতি এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে, এসবের প্রভাব ঠেকাতে ফেডারেল রিজার্ভকে বাড়াতে হয়েছে সুদহার, যা ১৯৯৪ এর পর সর্বাধিক। পাশাপাশি তাদের রাশিয়ার বাইরে বিকল্প জ্বালানি উৎস খুজতে হচ্ছে মিত্রদের জন্যও। এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র বারবার সৌদি আরবকে তেলের উৎপাদন বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে আসছে, কিন্তু সৌদি আরব ওপেক প্লাসের সিদ্ধান্তের সাথে চলতে চাচ্ছে, যে জোটে আছে রাশিয়াও।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বকে এনে দাঁড় করিয়েছে নতুন এক বাস্তবতার মুখোমুখি, যা হুমকির মুখে ফেলবে এক মেরুকেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থাকে। সৌদি আরব এই পরিবর্তনে এক বড় ফ্যাক্টর, ওয়াশিংটন চায় না তাদের পুরনো মিত্ররা অন্যদিকে চলে যাক আর রাশিয়া-চীন জানে সৌদি আরবকে পাশে পেলে তারা কি দুঃসাধ্য সাধন করতে পারবে। এর নজির আমরা দেখেছি ইউক্রেন সংকটের শুরুর দিকে, ডলারের সুবিধা কাজে লাগিয়ে পশ্চিমা অবরোধের ক্ষমতা খর্ব করতে আলাপ চালিয়েছিল রাশিয়া-চীন, যেখানে কথা উঠেছিলো নতুন চীনা মুদ্রায় সৌদির কাছ থেকে তেল কিনবে চীন।
কথা হচ্ছে রিয়াদ আসলে কী চায়? তারা কেন দীর্ঘদিনের মিত্র ফেলে নতুন অংশীদার খুঁজছে, যুক্তরাষ্ট্রকে ফেলে রাশিয়া-চীনের দিকে ছুটলে আখেরে তাদের কতখানি ফায়দা হবে।
তারা আসলে দুই পক্ষের এই রেষারেষিতে নিজেদের দরকষাকষি এগিয়ে নিচ্ছে, একে মোহাম্মদ বিন সালমানের পররাষ্ট্র নীতির অর্জন বলা যায়। ওয়াশিংটন থেকে তারা কতদিন দূরে থাকতে পারবে সেটা বলা যায় না তবে তারা শিক্ষা নিয়েছে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির অভাবে তাদের সার্বভৌমত্ব কতটা ঝুঁকিতে পরতে পারে। জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ড থেকে হুথি বিদ্রোহীদের আরামকোর তেল স্থাপনায় আক্রমণ, কোথাও তারা ওয়াশিংটন কে পাশে পায়নি, ক্ষেত্রবিশেষে মুখোমুখি হতে হয়েছে ওয়াশিংটনের সমালোচনার।
ওয়াশিংটনের এই দ্বিচারিতা কাটিয়ে উঠতে তারা তাই নিজেরা উদ্যোগী হয়ে গোপনে শান্তি আলোচনা চালিয়েছে তাদের চির প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানের সাথে যাদের ধরা হয় মধ্যপ্রাচ্যের প্রক্সি ওয়ারগুলোর নাটের গুরু হিসেবে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদের গত ১১ বছরে প্রথম কোন আরব দেশ হিসেবে আমিরাত সফরও এইসব ঘটনার সাথে সম্পর্কিত।
অন্যদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রেও সৌদি ও তার উপসাগরীয় মিত্ররা আগের মত নতজানু পররাষ্ট্রনীতি অবলম্বন না করে নিয়েছে স্বতন্ত্র ভূমিকা এমনকি গত ৭ এপ্রিল জাতিসংঘে রাশিয়া ইস্যুতে ভোটাভুটিতে তারা ভোটদানে বিরত থেকে নিজেদের মত দিয়েছে। এইসব ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রকে শুধু ক্রুদ্ধ বা হতাশই করেনি ফেলেছে গভীর শঙ্কায়ও।
এসব কারণেই সব ভুলে বাইডেনের এই সফর, যুক্তরাষ্ট্র বলছে এই সফরে আলোচনা হবে জ্বালানি তেলের উৎপাদন ও মূল্য নিয়ে আর পাশাপাশি ইরানের বিরুদ্ধে কিভাবে এক থাকা যায় তা নিয়ে। তবে ইরানের বিষয়টি আসলেই অনেকটা জটিল, তাদের বাড়বাড়ন্তে আদতে লাভ হয় পশ্চিমেরই, সুন্নিদেশগুলোকে নিজেদের ব্লকে রাখার মাধ্যমে।
তাই ইরান নিয়ে আসলে তাদের যতটা না চিন্তা তার চেয়ে বেশি চিন্তা চীনকে নিয়ে, চীনই এখন তাদের জন্য বড় হুমকি। পশ্চিমাদের গড়া আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে নিমিষেই নিচে নামিয়ে দিতে পারে চীনের নিরবচ্ছিন্ন উত্থান। তাই সব ফেলে চীনকে ঠেকাতেই যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজি, আর মধ্যপ্রাচ্যে আবার মনযোগ তথা পুরনো মিত্রদের সাথে রাখা এরই অংশ, আসলে কারণ যে পক্ষের পাল্লা ভাড়ি থাকবে তারাই বিজয়ী দিনশেষে ।
প্রশ্ন ওঠে চীনের কেন দরকার সৌদিকে? কারণ অনেকই আছে তবে এই মুহুর্তে চীনের জন্য বড় সংকট তাইওয়ান, ধারণা করা হচ্ছে এখানে ইউক্রেনের মত আরেকটি যুদ্ধ বেধে যেতে পারে যা হবে ওয়াশিংটনের জন্য সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং, একইসাথে মিত্রতা ধরে রাখা আবার নিজেদের ক্ষমতার পরীক্ষা।
রাশিয়া ইস্যুতে তারা যেমন সংকটে পড়ে গেছে এমন আরেকটি পরিস্থিতি আবার তৈরি হোক সেটা তারাই চায় না, তাই যে কোন মূল্যে তারা চীনকে ঠেকাবে বলা যায়। এখন সৌদি আরবের মত দেশগুলো যারা বিশ্বের জ্বালানি শক্তির বড় নিয়ামক তারা কী ভূমিকায় থাকবে সেটাও অনেককিছু ঠিক করে দিবে।
তাই রিয়াদ চীনের সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার আগেভাগেই পুরোনো সম্পর্ক জোড়া লাগিয়ে ঠিক করে নেওয়ার এই উদ্যোগ বলা যায়। এখন দেখার বিষয় বাইডেন কতটুকু গলাতে পারেন রিয়াদে জমে থাকা বরফ আর বিন সালমানের পররাষ্ট্রনীতি আসলেই কতটা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
- লেখক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী
এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।