বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৭.২ বিলিয়ন ডলার বাড়িয়ে বলা হয়েছে: আইএমএফ
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলছে, সংশ্লিষ্ট ঝুঁকিকে অবমূল্যায়ন করে, রিজার্ভ-বহির্ভূত সম্পদ অন্তর্ভুক্ত করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৭ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার বাড়িয়ে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
২০২১ সালের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সুরক্ষা মূল্যায়নের একটি খসড়া প্রতিবেদনে আইএমএফ বিদেশি সম্পদের ভুল শ্রেণিবিভাগ চিহ্নিত করেছে। এই ভুল শ্রেণিকরণের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক রিজার্ভের আকার বড় হয়েছে।
আইএমএফের হিসাব অনুসারে, চলতি বছরের জুনের শেষ দিকে ৪৬ বিলিয়ন ডলারের যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকার কথা বলা হয়েছিল, তা আসলে ১৫ শতাংশ বাড়িয়ে বলা হয়েছে। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, প্রকৃতপক্ষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হবে ৩৯ বিলিয়ন ডলার।
এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বৈশ্বিক ঋণদাতা সংস্থাটি বলেছে যে, রিজার্ভের একটি অংশ অর্থায়ন, রেসিডেন্ট ব্যাংকগুলোতে আমানত, নন-ইনভেস্টমেন্ট গ্রেড বন্ডে বিনিয়োগ এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক বোর্ড ও এর বিনিয়োগ কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শ্রীলঙ্কাকে ঋণ দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।
তবু কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব রিজার্ভ-বহির্ভূত সম্পদকে বৈদেশিক রিজার্ভের পারফর্ম্যান্স ও ঝুঁকি বিশ্লেষণে অন্তর্ভুক্ত করে চলেছে।
আইএমএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে এরকম অতিরঞ্জন করলে রিজার্ভের পরিমাণ সম্পর্কে ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়।' প্রতিবেদনে আরও হয়েছে যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের দক্ষতা এবং আইটি সক্ষমতা দুটোই সীমিত পর্যায়ের।
আইএমএফ সুপারিশ করেছে যে, বৈদেশিক মুদ্রার তারল্য ও সংশ্লিষ্ট ঝুঁকির অবমূল্যায়ন এড়ানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত রিজার্ভ-বহির্ভূত সম্পদ থেকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে আলাদা রাখা এবং স্বচ্ছতা বজায় রেখে রিপোর্ট করা।
এ বিষয়ে জানার জন্য ফরেক্স রিজার্ভ এন্ড ট্রেজারী ম্যানেজমেন্ট বিভাগের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর কাজী সায়েদুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়িয়ে বলার যে দাবি আইএমএফ করেছে, সে ব্যাপারে কোনো ব্যাখ্যা দিতে তিনি অস্বীকৃতি জানান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, সংশ্লিষ্ট বিভাগ এ বিষয়ে আইএমএফের জন্য লিখিত জবাব প্রস্তুত করছে।
শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বৈদেশিক মুদ্রা সহায়তা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ২৫০ মিলিয়ন ডলার দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে আইএমএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই স্বল্পমেয়াদি অর্থায়নের বিপরীতে গ্যারান্টি হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকে সমপরিমাণ শ্রীলঙ্কান রুপি ডিপোজিট করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ দিলে তার জামিন হিসেবে ওই একই মুদ্রায় লেনদেন করা উচিত।
আইএমএফ যেসব রিজার্ভ-বহির্ভূত সম্পদ চিহ্নিত করেছে সেগুলো হলো—স্থানীয় ব্যাংকগুলোকে বৈদেশিক মুদ্রায় দেওয়া ঋণ, ৬ হাজার ১৯৮ মিলিয়ন ডলার; স্থানীয় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে ডিপোজিট, ৬৫১ মিলিয়ন ডলার; আইটিএফসিতে (আইডিবি গ্রুপ) ডিপোজিট, ২৮৮ মিলিয়ন ডলার; এবং বিনিয়োগ গ্রেডের নিচে ফিক্সড ইনকাম সিকিউরিটিজ, ৬০ মিলিয়ন ডলার।
পায়রা বন্দরসহ সরকারের অগ্রাধিকারমূলক অবকাঠামো প্রকল্পের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ২ বিলিয়ন ডলার ব্যবহারের বিষয়েও আপত্তি তুলেছে আইএমএফ।
প্রতিবেদনে আইএমএফ বলেছে, অপর্যাপ্ত ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার কারণে বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্পগুলোকে প্রায়শই ভুগতে হয়ে এবং তাৎক্ষনিক ক্ষতির ভার সাধারণত অর্থপ্রদানকারীই বহন করে। ফলে বৈদেশিক রিজার্ভ কমে যাওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক ক্ষতিরও আশঙ্কা রয়েছে।
প্রতিবেদনে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, পেমেন্ট ব্যালেন্সের চাপ এবং রেমিট্যান্স ও বাণিজ্যের অস্থিতিশীলতার কথা বিবেচনা করে অবকাঠামো প্রকল্পে অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার আগে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কোন পর্যায়ে আছে, তা যেন নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বন্দর এবং বিদ্যুৎ খাতের অবকাঠামো প্রকল্পের অর্থায়নের জন্য সরকারের গঠন করা বাংলাদেশ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ফান্ডে (বিআইডিএফ) বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ২ বিলিয়ন ডলার প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ক্রমবর্ধমান আমদানি ব্যয় এবং পরবর্তী সময়ে রেমিট্যান্স প্রবাহের ধীরগতির কারণে বৈদেশিক মুদ্রার বাজার চাপে পড়ে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে চলতি হিসাবের ব্যালেন্স ঋণাত্মক ১ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলারে পরিণত হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে যা ৩ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্ত ছিল।
চাহিদা বাড়তে থাকায় গত মাস থেকে ডলারের দাম ঊর্ধ্বমুখী ছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, অক্টোবরে প্রতি ডলারের আন্তঃব্যাংক বিনিময় হার বেড়ে ৮৫.৬৫ টাকায় দাঁড়ায়, যা গত মাসে ছিল ৮৫.২০ টাকা।
ডলার সংকটের কারণে বাজার স্থিতিশীল রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক বাধ্য হয়ে ডলার কেনা বন্ধ করে অন্য ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করতে শুরু করেছে।
কম আমদানি এবং রেমিট্যান্সের উচ্চ প্রবাহের মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক রেকর্ড 8 বিলিয়ন মার্কিন ডলার কিনেছে।
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ব্যাংকগুলোর কাছে এ বছরের আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক ৩০৫ মিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে।