চট্টগ্রামে বেড়েছে চার্জার ফ্যান-আইপিএস বিক্রি, লাফিয়ে বাড়ছে দামও
চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ এলাকার গৃহিণী সানোয়ারা বেগম দশ মাস বয়সী কন্যাসন্তানকে নিয়ে চট্টগ্রাম নগরের রাইফেল ক্লাব মার্কেটে এসেছেন চার্জার ফ্যান কিনতে। বেলা ১১টার দিকে দোকানে দোকানে ঘুরে চার্জার ফ্যান দেখছিলেন তিনি। কিন্তু পছন্দসই দামে পাচ্ছিলেন না। শিশুসন্তানের জন্য কোন ধরনের চার্জার ফ্যান কিনলে ভালো হবে, তা নিয়েও দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলেন এই গৃহিণী।
সানোয়ারা বেগম বলেন, 'দিনের অধিকাংশ সময় কারেন্ট থাকছেনা। বিশেষ করে রাতের বেলা এই সমস্যা ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে। লোডশেডিংয়ের কষ্ট বড়রা সহ্য করতে পারলেও ছোট বাচ্চাকে নিয়ে সমস্যায় পড়েছি। তার জন্যই বাধ্য হয়ে চার্জার ফ্যান কিনতে এলাম। কিন্তু দোকানিরা যে দাম বলছে, তা আমাদের সাধ্যের বাইরে।'
চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বইছে তাপদাহ। এর মাঝেই হুটহাট চলে যাচ্ছে বিদ্যুৎ। একবার গেলে ফিরে আসে অন্তত এক থেকে দুই ঘণ্টা পর। চট্টগ্রামে সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাতে লোডশেডিং হচ্ছে বেশি। ফলে গরম থেকে রেহাই পেতে নগরবাসী ছুটছেন ইলেক্ট্রনিক পণ্যের দোকানগুলোতে। চাহিদা বেড়েছে চার্জার ফ্যান ও আইপিএসের। চাহিদার কারণে এসব পণ্যের দাম আগের চেয়ে বেড়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে পিক আওয়ারে ১৪০০ থেকে ১৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা থাকে। কিন্তু জাতীয় গ্রিড থেকে পাওয়া যাচ্ছে ১১০০ মেগাওয়াটের কাছাকাছি। ফলে ৩০০ থেকে ৩৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ঘাটতি থাকছে প্রায় প্রতিদিন।
গত মঙ্গলবার নগরের রাইফেল ক্লাব মার্কেটে, শাহ আমানত মার্কেট, রিয়াজউদ্দিন বাজার, চকবাজার, গোলাম রসুল মার্কেট, বহদ্দারহাট ও নিউমার্কেট এলাকায় ইলেকট্রনিক পণ্যের বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ব্যবসায়ীরা চার্জার ফ্যান ও আইপিএসের মতো পণ্যের বেচাকেনায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। নতুন করে লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীদের এখন যেন দম ফেলারও ফুরসত নেই। বিশেষ করে চার্জার ফ্যানের বিক্রি সবচেয়ে বেশি। চার্জার লাইট ও আইপিএস বিক্রি হচ্ছে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি।
রাইফেল ক্লাব মার্কেটের গাউছিয়া ইলেকট্রিকের স্বত্বাধিকারী নোমান আলী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'গত এক সপ্তাহ ধরে লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ায় দিনে ৪০ থেকে ৪৫টি চার্জার ফ্যান বিক্রি হচ্ছে। স্বাভাবিক সময়ে দিনে ১০টির বেশি বিক্রি হতো না। চার্জার ফ্যানের পাশাপাশি আইপিএসের ব্যবসাও ভালো হচ্ছে, দিনে তিন-চারটি আইপিএস বিক্রি হয়।'
সরেজমিনে দেখা গেছে, বাজারে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্রতিটি চার্জার ফ্যান বিক্রি হচ্ছে সর্বনিম্ন সাড়ে তিন হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ দশ হাজার টাকায়। আর ব্যাটারির সক্ষমতা বিবেচনায় একেকটি আইপিএসের দাম ২০ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত। গত ১ মাসে প্রতিটি চার্জার ফ্যানের দাম বেড়েছে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা। বাজারে এখন ১২ ইঞ্চি মাপের একটি চার্জার ফ্যানের দাম সাড়ে ৩ হাজার টাকার বেশি।
চাহিদার কারণে ইলেকট্রনিক্সের দোকানের পাশাপাশি অন্যান্য দোকানেও এসব পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। ছোট বা মাঝারি আকারের চার্জার ফ্যান পাওয়া যাচ্ছে ফুটপাতের দোকানগুলোতেও। বাজারে ১৪, ১৬, ১৮ ইঞ্চির চার্জার ফ্যানের চাহিদা বেশি। চার্জার ফ্যানের মতো বাজারে আইপিএসেরও নানা ধরন আছে। তবে চাহিদা বেশি মাঝারি মানের ৮০০ থেকে ১২০০ ওয়াটের আইপিএসের। এসব আইপিএসের দাম ব্র্যান্ডভেদে ২২ থেকে ৩৫ হাজার টাকা।
বাঁশখালী থেকে আইপিএস কিনতে আসা রশিদ বলেন, 'গ্রামে পুরো দিনে পাঁচ ঘণ্টাও বিদ্যুৎ থাকে না। বাড়িতে বৃদ্ধ মা আর দুই সন্তানকে নিয়ে স্ত্রী থাকেন। বাচ্চারা গরম সহ্য করতে পারছে না। তাই আইপিএস কিনতে এসেছি। কিন্তু এক বছর আগে যে আইপিএস ৩২ হাজার টাকা ছিলো, তা আজ এসে দেখি সাড়ে ৪৫ হাজার টাকা!'
তিনি অভিযোগ করেন, ব্যবসায়ীরা চাহিদাকে পুঁজি করে দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে কষ্ট দিচ্ছে।
তবে রিয়াজউদ্দিন বাজারের ইলেকট্রিক ব্যবসায়ী শফিউল ইসলাম বলেন, 'দুই বছর আগেও আইপিএসের এত চাহিদা ছিলো না। বর্তমানে চাহিদা বাড়ায় দামও বেড়েছে। মূলত চীন ও ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি কমে যাওয়া ও পাইকারি বিক্রেতারা দাম বৃদ্ধি করায় বাধ্য হয়েই বেশি দাম নিতে হচ্ছে।'
তিনি জানান, লুমিনাস, রহিমা আফরোজ, এক্সট্রিম ব্র্যান্ডের আইপিএসের চাহিদা বেশি।
চকবাজারের ইলেকট্রনিক পণ্য বিক্রেতা জুনায়েদ বলেন, 'গত সপ্তাহেই আমার দোকানের সব আইপিএস বিক্রি হয়ে গেছে। মে মাসে কম করে হলেও ১০০টি আইপিএস বিক্রি করেছি, কিন্ত এখন নতুন পণ্য নেই, দোকানে ক্রেতারা এসে ফিরে যাচ্ছে।'
এদিকে আমদানি করা আইপিএসের পাশাপাশি চাহিদা বেড়েছে স্থানীয়ভাবে বানানো আইপিএসেরও। অনেকে মেকানিকের দোকানে আসছেন নষ্ট চার্জার ফ্যান ও আইপিএস সারিয়ে নিতে। এই সুযোগে বেড়েছে চার্জার ফ্যান ও আইপিএসের ব্যাটারির দাম। বাজারে চার্জার ফ্যানের ৬-ভোল্টের ব্যাটারি বিক্রি হচ্ছে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকায়, ১২-ভোল্টের ব্যাটারি বিক্রি হচ্ছে ১০০০ টাকার বেশি দামে। এক মাস আগেও এসব ব্যাটারি ৩০০ থেকে ৬০০ টাকায় পাওয়া যেতো। এছাড়া আইপিএসের ব্যাটারিও বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে।
বিক্রেতারা জানান, দেশে কন্ট্রোল ইউনিটের চেয়ে ব্যাটারির সংকটই বেশি। কন্ট্রোল ইউনিট বিদেশ থেকে আমদানি করা হলেও ব্যাটারি দেশেই উৎপাদন হয়। হঠাৎ চাহিদা বাড়ায় প্রয়োজন অনুযায়ী সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না।