প্রত্যাশিত হারে ব্যয় করতে না পারায় কমেছে বাজেট ঘাটতি
করোনার অভিঘাত থেকে অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে সরকারের দিক থেকে বিপুল বিনিয়োগ চাহিদার প্রেক্ষিতে বাজেট ঘাটতি বেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসের তথ্য বলছে উল্টো কথা।
করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত থাকা গত অর্থবছরের মতোই গতানুগতিক ধারায় বাজেট বাস্তবায়নের কারণে বাজেট ঘাটতি না বেড়ে জুলাই থেকে নভেম্বর সময়ে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৮% কমে গেছে বলে অর্থবিভাগের এক প্রতিবেদেনে উঠে এসেছে।
বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বাজেট মনিটরিং এন্ড রিসোর্স কমিটির সভায় উপস্থাপন করা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় মাত্র ৮ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা বেশি ব্যয় করেছে। এই ব্যয় এই সময়ে রাজস্ব আয়ের তুলনায় ৯ হাজার ৩২০ কোটি টাকা বেশি।
আগের বছরের একই সময়ে সরকারের ব্যয় ও রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি ছিল ১২ হাজার ৯৫৩ কোটি টাকা। এ হিসাবে চলতি বছরে বাজেট ঘাটতি কমেছে 3 হাজার 633 কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের আগেই অর্থনীতিবিদরা ঘাটতি বাড়িয়ে হলেও সরকারের বিনিয়োগ বাড়ানোর উপর গুরুত্ব দিয়ে আসছিলেন। অর্থমন্ত্রণালয় বাজেটের আকার ১০% এর বেশি বাড়িয়ে খরচ করার পরিকল্পনা করেছে। কিন্তু টাকার অংকে গতবারের তুলনায় এবারের পাঁচ মাসে সরকারের ব্যয় বেড়েছে মাত্র ৭%। এই হারে ব্যয় বাড়লে প্রকৃত ব্যয় ঋণাত্বক হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
তারা বলছেন, করোনায় অর্থনীতির ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে সরকারের পক্ষ থেকে অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর বিকল্প নেই। করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট মোকাবেলায় স্বাস্থ্য খাতের সক্ষমতা বৃদ্ধি, শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া আর দরিদ্রদের জীবন জীবিকা রক্ষায় প্রত্যাশিত হারে ব্যয় করতে পারছে না সরকার।
বাজেট ঘাটতির বিষয়টি উপেক্ষা করে হলেও দ্রুত সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
অর্থবিভাগের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত বছরের প্রথম পাঁচ মাসে সরকার যে পরিমাণ রাজস্ব আদায় করেছিল, চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তার ১১ শতাংশ বেশি আদায় করেছে।
গত অর্থবছরের বেশিরভাগ সময় জুড়েই করোনার প্রকোপ ছিল, ঘন ঘন লকডাউনে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নসহ সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। ওই পরিস্থিতিতে গত অর্থবছরের পাঁচ মাসে সরকার বাজেটের ২১.৮৩% ব্যয় করেছিল।
চলতি অর্থবছরের শুরুতে দু'দফায় ২৪ দিনের লকডাউন শেষে করোনার প্রকোপ কমে গেছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডসহ যান ও জন চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে। এই সময়ে বাড়তি ব্যয়ের সুযোগ থাকলেও এবছর একই সময়ে সরকারের ব্যয় মোট বাজেটের ২২.০১%। আর টাকার অংকে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় এবার জুলাই-নভেম্বরে ব্যয় বেড়েছে মাত্র ৭%।
কাঙ্ক্ষিত ব্যয় করতে না পারার সময়ই চলতি অর্থবছরের বাজেট সংশোধনের কাজ শুরু করেছে অর্থমন্ত্রণালয়। বাজেট সংশোধনের মধ্য দিয়েও ব্যয় বাড়ানোর কোন পরিকল্পনা নেই অর্থমন্ত্রণালয়ের। এজন্য ইতোমধ্যে জারি করা পরিপত্রে মন্ত্রণালয়গুলোকে কোনভাবেই মূল বাজেটে বরাদ্দ করা অর্থের অতিরিক্ত দাবি করা যাবে না বলে সতর্ক করে দিয়েছে অর্থবিভাগ।
কোভিড মহামারি পরিস্থিতি মোকাবেলা ও সরকারের কৃচ্ছ্রসাধন নীতির অংশ হিসেবে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে গাড়ি কেনা ও ভ্রমণখাতে বরাদ্দের ৫০% ব্যয় করার সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছিল অর্থবিভাগ। এই সীমার অতিরিক্ত ব্যয় না করার নির্দেশনা দিয়ে অর্থবিভাগ বলেছে, এ দুই খাতের অব্যয়িত অর্থ কোনভাবেই অন্যখাতে ব্যয় করা যাবে না।
অর্থ মন্ত্রণালয় বলেছে, অননুমোদিত কোন স্কিমের জন্য সংশোধিত বাজেটে অর্থ বরাদ্দের প্রস্তাব করা যাবে না। সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে প্রকল্প সংখ্যা সীমিত রাখতে হবে। সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্প অন্তর্ভূক্ত করার জন্য প্রয়োজনে অন্যান্য কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাদ দিতে হবে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো প্রফেসর মুস্তাফিজুর রহমান এ বিষয়ে বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে আয় বৃদ্ধির হারের চাইতে ব্যয় বেশি হারে বাড়ানোর বিকল্প নেই।
তিনি বলেন, টাকার অঙ্কে জিডিপির আকার ১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। এ অবস্থায় বাজেট বাস্তবায়নে ৭ শতাংশ ব্যয় বৃদ্ধি হলে, প্রকৃত ব্যয় কমে আসবে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর ব্যর্থতার কারণে বাজেট বাস্তবায়নের লক্ষ্য পূরণ হচ্ছে না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, করোনার অভিঘাত থেকে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের বিকল্প নেই। আর এর জন্যে প্রয়োজন সরকারের পক্ষ থেকে অবকাঠামো উন্নয়ন। অর্থবছরের পাঁচ মাসে এডিপি বরাদ্দের ১৯ শতাংশের কম ব্যয় করায় তিনি হতাশা প্রকাশ করেন।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, করোনার অভিঘাতে গত অর্থবছর অর্থনীতিতে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, তা কাটাতে এবছর সরকারি ব্যয়ে গতি বাড়ানো প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তা হচ্ছে না।
'সরকার বাজেটে যে রাজস্ব লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করেছে, পাঁচ মাসে অর্জন তার ২০% কম। রাজস্ব ঘাটতি থাকার কারণেই সরকার এখনও ব্যয় সংকোচন নীতির মধ্যেই রয়েছে। ফলে প্রত্যাশা অনুযায়ী অর্থনীতির দ্রুত রিকভার বাধাগ্রস্ত হবে'- যোগ করেন তিনি।
'সরকারের একটা জিনিসই ভালো, তারা ফিসক্যাল পলিসির মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করছে।'
আহসান এইচ মনসুর বলেন, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি হলেও বিভিন্ন মন্ত্রণালয় পুরনো অভ্যাস নিয়েই পড়ে আছে। স্বাস্থ্যখাতের প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে অর্থের কোনো অভাব না থাকলেও অব্যবস্থাপনা, টেন্ডারিংয়ে দুর্নীতিসহ বিভিন্ন কারণে বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মূখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, চলতি অর্থবছরে ফিসক্যাল ডাটাগুলোর মধ্যে ইতিবাচক দিক হলো রাজস্ব আদায় কিছুটা বেড়েছে। এর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ব্যয় বৃদ্ধি না পাওয়ায় ঘাটতির পরিমাণ কমেছে।
তিনি বলেন,আগামী দিনে সরকারের বাজেট বাস্তবায়নে বিপুল পরিমাণ ব্যয় করতে হবে। এ লক্ষ্য পূরণে রাজস্ব আদায় ও ব্যয়ের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। তাছাড়া, অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, মানব সম্পদ উন্নয়ন তথা অগ্রাধিকার খাতে ব্যয় করতে গিয়ে বাজেট ঘাটতি বাড়লেও তেমন সমস্যা হবে না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।