আগোরা কিনছে শ্রীলঙ্কার কোম্পানি
বাংলাদেশের সর্বপ্রথম ও দ্বিতীয় বৃহৎ সুপারমার্কেট চেইন আগোরা'র সম্পূর্ণ কিনে নিতে গত শুক্রবার একটি সমঝোতায় পৌঁছেছে শ্রীলঙ্কার সফটলজিকের খুচরা ব্যবসায়ের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। শ্রীলঙ্কান কোম্পানিটি এক আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় এ তথ্য জানিয়েছে।
আগোরার শতভাগ মালিকানা ধারাবাহিক লেনদেন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন হবে, যা চুক্তির শর্তাবলী এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদনের ভিত্তিতে হবে বলে কলম্বো স্টক এক্সচেঞ্জে জমা দেওয়া নথিতে উল্লেখ করেছে সফটলজিক হোল্ডিং পিএলসি।
তবে সফটলজিক বা আগোরার মালিকদের কেউই চুক্তিটির মূল্য প্রকাশ করেননি।
বিনিয়োগ ব্যাংকিং সূত্রগুলি অবশ্য আগের এমন অধিগ্রহণের ঘটনাগুলি উল্লেখ করে অনুমান করেছে, অঙ্কটি ১৮১ থেকে ২৪৯ কোটি টাকার মধ্যে হতে পারে।
ব্রুমার অ্যান্ড পার্টনার্স (বাংলাদেশ) দেশের প্রথম প্রাইভেট ইক্যুইটি ফান্ড, ফ্রন্টিয়ার ফান্ড পরিচালনা করে। তাদের হাতেই রয়েছে আগোরার ৭২ শতাংশ মালিকানা।
ব্রুমারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এবং এর প্রতিষ্ঠাতা অংশীদার খালিদ কাদির এখনই কোনো সংখ্যা প্রকাশ করতে অস্বীকার করেছেন।
তবে তিনি বলেছে, "এক দশক আগে করা আমাদের বিনিয়োগ ব্যবসাটির বিকাশে এবং বাংলাদেশে এখাতের বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে, কিন্তু আন্তর্জাতিক বেসরকারি ইক্যুইটি (সম্পদ/ শেয়ার) বিনিয়োগের গতিপ্রকৃতি অনুসারেই এখন আমাদের সরে যেতে হচ্ছে।"
অবকাশ, অটোমোবাইল, আর্থিক সেবাখাত, খুচরা ব্যবসা, স্বাস্থ্যসেবা ও আইসিটি প্রভৃতি শিল্প পরিচালনায় সফটলজিকের ট্র্যাকরেকর্ড ও দক্ষতা বেশ শক্তিশালী।
আগামীদিনে তারা রিটেইল চেইন ব্যবসাটিতে (আগোরা) উল্লেখযোগ্য মূল্য সংযোজন করবে বলে আশাপ্রকাশ করেন খালিদ কাদির।
ক্রেতা প্রতিষ্ঠান সফটলজিক রিটেইল হোল্ডিং- এর কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে ব্র্যান্ডের পোশাক, কনজ্যুমার ইলেকট্রনিক্স, মোবাইল হ্যান্ডসেট, বিতরণ, সুপারমার্কেটসহ কুইক সার্ভিস রেস্তোরাঁর মতো ব্যবসা।
আগোরা: দেশে সুপারমার্কেট ব্যবসার অগ্রদূত
রাজধানী ঢাকায় ক্রমবর্ধমান উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে ঝঞ্ঝাট মুক্ত, স্বচ্ছন্দে কেনাকাটার অভিজ্ঞতা দিতে দেশের অন্যতম পুরোনো কর্পোরেট হাউজ- রহিমআফরোজ ২০০১ সালে রাইফেলস স্কয়ার, যা এখন সীমান্ত স্কয়ার–আগোরার প্রথম আউটলেটটি চালু করে।
পরের বছর জেমকন গ্রুপ ধানমন্ডির নিকটবর্তী স্থানে তাদের প্রথম সুপার মার্কেট মীনা বাজার খোলে।
একইছাদের নিচে সব ধরনের নিত্যপণ্য কিনতে পারার সুবিধা দিতে আরও আসে- নন্দন। আলোচিতদের পাশাপাশি আরও বেশকিছু প্রতিষ্ঠান তখন শুধুমাত্র স্বচ্ছল ক্রেতাদের চাহিদা পূরণ করেছে। শুরুতে যারা এভাবে কেনাকাটার অভ্যাস করেছেন তাদের কাছে সুপারমার্কেটের প্রধান আবেদন ছিল তাকগুলোর পণ্য বৈচিত্র্য।
২০০৮ সালে, সুপারশপকে সাধারণ মানুষের গন্তব্যে পরিণত করার লক্ষ্যে এবং বড় প্রচারণা চালিয়ে এ শিল্পে প্রবেশ করে এসিআই।
নতুন নতুন দোকান বা আউটলেটে আগ্রাসীভাবে বিনিয়োগ করে এসিআই- এর সুপারমার্কেট চেইন 'স্বপ্ন' নিজস্ব মিশন পূরণে অনেকটাই সফলতা পায়। সাধারণ শহরবাসী ক্রেতারাও তাদের সেবামুখী হওয়ায় স্বপ্ন নিয়ে নেয় বাজারটির নেতৃত্ব।
স্বপ্ন এরমধ্যেই ২০৭টি বিপণী খুলেছে, এরমধ্যে ৫৫টি বৃহৎ সুপারস্টোর এবং বাকীগুলি সারা দেশে ফ্র্যাঞ্চাইজির মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে।
শিল্পের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য, আগোরা ২০০৯ সালে তার নতুন বিনিয়োগকারী ফ্রন্টিয়ার ফান্ডকে স্বাগত জানায়। এসময় তারা কোম্পানির ৪৯ শতাংশ অংশীদারিত্ব কিনেছিল।
এরপর পর্যায়ক্রমে আরও বিনিয়োগের মাধ্যমে বেসরকারি ইক্যুইটিতে বিদেশি বিনিয়োগকারী সংস্থাটি আগোরার প্রধান শেয়ারহোল্ডারে পরিণত হয়। কিন্তু, এখন তারা সরে যাচ্ছে। তাদের বিনিয়োগ তালিকায় থাকা রানার অটোমবাইলের মতো কোম্পানি থেকেও তারা এভাবে সরে যাচ্ছে।
দেশজুড়ে এপর্যন্ত আগোরার বিভিন্ন আকারের ১৮টি সুপারস্টোর রয়েছে। এর মধ্যে ১৫টি ঢাকায়, দুটি সিলেটে এবং একটি চট্টগ্রামে।
বার্ষিক টার্নওভার প্রায় ৫০০ কোটি টাকা নিয়ে দেশের সুপারমার্কেট শিল্পের দ্বিতীয় বৃহৎ সংস্থা এখন আগোরা। আর ১৫টি সুপারস্টোর নিয়ে তাদের একেবারে ঘাড়েই নিঃশ্বাস ফেলছে মীনা বাজার।
কনভিনিয়েন্ট স্টোর মডেল নিয়ে প্রাণ-আরএফএল- এর উদ্যোগ ডেইলি শপিং এর রয়েছে ৫০টিরও বেশি ছোট বিপণী।
হাইপারমার্কেট চেইন ইউনিমার্ট, সুপারমার্কেট চেইন প্রিন্স বাজার, ল্যাভেন্ডার এবং অনেক নতুন প্রবেশকারী তাদের নিজস্ব মার্কেট বেজে অনেক কম সংখ্যক স্টোর নিয়েও বিকশিত হচ্ছে।
এব্যাপারে বাংলাদেশ সুপারমার্কেট মালিক সমিতির মহাসচিব জাকির হোসেন বলেন, তার সংগঠনের সদস্য চেইনগুলো এখন দেশজুড়ে ৩০০ এর বেশি সুপারস্টোর পরিচালনা করছে। এছাড়া, এ সমিতির সদস্য নয় এমন অনেক আধুনিক খুচরা বিপণী গড়ে উঠেছে।
স্বপ্ন- এর নির্বাহী পরিচালক সাব্বির হাসান নাসির জানান, নন-চেইন সুপারস্টোরসহ সারাদেশে এরইমধ্যে মোট সংখ্যা হয়তো এক হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
এখনও প্রারম্ভিক পর্যায়ে বাংলাদেশের রিটেইল:
সুপারমার্কেটের ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণ জানাতে গিয়ে সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন বলেন, 'এই শিল্পের আকার বড় হতে বাধ্য।'
জীবনযাত্রার ধরনে বদলে যাওয়ার ফলে প্রথাগত বাজারে গিয়ে বাজার করার ঝক্কি নিতে না চাওয়া শহুরে বাসিন্দার সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। এত ব্যস্ততার মধ্যে তারা দরকষাকষি কিংবা পণ্যের মান বারবারব যাচাই করে দেখার আগ্রহ পান না।
গত দশকের প্রথমার্ধে এই শিল্পের আকার বছরে ৩৫ শতাংশ হারে বাড়ে। কিন্তু সুপারমার্কেট থেকে কেনা প্যাকেজ করা আইটেমের ওপর বৈষম্যমূলক মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) যোগ করায় গত দশকের দ্বিতীয়ার্ধে এ শিল্পের আকার বৃদ্ধির হার গড়ে ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনে।
এর মধ্যেই সুপারমার্কেট খাতের প্রবৃদ্ধি এখন প্রায়ই এক অঙ্কের ঘরে নেমে আসছে বলে জানান তিনি। সুপারস্টোরে অতিরিক্ত ভ্যাট দিতে ইচ্ছুক নয় মধ্যবিত্তরা। ঘরের পাশের দোকানগুলোতে এই ভ্যাট দিতে হয় না তাদের।
এ অঞ্চলের অন্যান্য সমপর্যায়ের অর্থনীতিগুলোর মতো বাংলাদেশও দুই দশক আগে সুপারমার্কেট চেইনে বিনিয়োগ টানতে শুরু করে। কিন্তু এদেশে এই শিল্প এখনও প্রারম্ভিক পর্যায়ে রয়ে গেছে। অথচ শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ডে এসব আধুনিক স্টোরই বলতে গেলে রিটেইল বিক্রির সমার্থক হয়ে উঠেছে।
সাব্বির হাসান নাসির বলেন, দেশে নন-চেইনসহ আধুনিক রিটেইল বিক্রেতারা বছরে প্রায় ৩ হাজার কোটি থেকে ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা টার্নওভার পাচ্ছে।
মীনা বাজারের সিইও শাহীন খান বলেন, আধুনিক রিটেইল এখনও মোট জাতীয় রিটেইলে ২ শতাংশের বেশি অবদান রাখতে পারেনি। অথচ এখন পর্যন্ত, শ্রীলঙ্কার সুপারস্টোরগুলো দেশটির মোট বার্ষিক রিটেইল ব্যবসায় ৪২ শতাংশের বেশি অবদান রাখছে। এই অঞ্চলে অন্যান্য সমকক্ষ অর্থনীতির দেশগুলোতে এই হার আরও বেশি।
সাব্বির হাসান নাসির বলেন, এ শিল্পকে বারবার প্রথাগত বাজারের সমান সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার অনুরোধ জানানো হলেও প্রতিবারই সে অনুরোধ উপেক্ষা করা হয়েছে। এ কারণে শিল্পটি এখনও পরিপূর্ণ সম্ভাবনা নিয়ে বিকশিত হতে পারেনি।
মীনা বাজারের শাহীন খান বলেন, বৈষম্যমূলক ভ্যাট, সুপার মার্কেটের ক্যাপিটাল মেশিনারির ওপর আরোপ করা অতিরিক্ত করকে যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে।
জাকির হোসেন বলেন, ২০১৩ সালে যখন বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা হয় এবং ২০১৫ সালে কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়, তখন বিনিয়োগকারীরা ভেবেছিলেন এটি অস্বাস্থ্যকর পশু জবাই, অন্যান্য খাদ্য সামগ্রীর অস্বাস্থ্যকর হ্যান্ডলিং নিষিদ্ধ করা ইত্যাদি পদক্ষেপ নিয়ে আধুনিক রিটেইলিংকে উৎসাহিত করবে। কিন্তু বাস্তবে কিছুই বদলায়নি।
বাংলাদেশিদের মাথাপিছু আয় যেহেতু ২ হাজার ডলার ছাড়িয়েছে, তাই আধুনিক রিটেইলিং আরও বিকশিত হওয়ার সমস্ত সম্ভাবনাই আছে বলে মন্তব্য করেন শিল্প সংশ্লিষ্ট সবাই। কেননা অনেক ক্রেতাই আধুনিক রিটেইলিংয়ের দেওয়া সুবিধা, ট্রেস করার সুযোগ, এবং নিশ্চয়তা পছন্দ করেন।
জাকির হোসেন বলেন, শ্রীলঙ্কার সফল বিনিয়োগকারী নিশ্চয় এই খাতের সম্ভাবনা বিশ্লেষণ করেছে।
আধুনিক রিটেইলিংয়ের বিকাশ চায় কি না, তা এখন সরকারের ওপরই নির্ভর করছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আগোরা-মীনা বাজার চুক্তির কী হল?
দুই বছর আগে আগোরাকে অধিগ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করে মীনা বাজার। এই অধিগ্রহণ-সংক্রান্ত চুক্তির কী হয়েছে, এ বিষয় শনিবার প্রশ্ন করা হলে হলে মীনা বাজার বা আগোরা কর্তৃপক্ষের কেউই স্পষ্টভাবে কিছু জানায়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, করোনা মহামারির আগে মীনা বাজার তাদের প্রধান প্রতিযোগীকে ২৪৯ কোটি টাকায় অধিগ্রহণের জন্য আগোরার মালিকদের সঙ্গে চুক্তি করে।
কিন্তু চুক্তির মূল্য বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক অনুমোদিত হওয়া প্রয়োজন ছিল, কারণ আগোরা পাবলিকভাবে (পুঁজিবাজারে) লেনদেন করা কোম্পানি ছিল না এবং বিক্রয় আয়ের পুরো অর্থই বিদেশে পাঠিয়ে দিত।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজস্ব মূল্যায়ন পদ্ধতিতে আগোরার শতভাগ শেয়ারের জন্য ১৮১ কোটি টাকা মূল্য অনুমোদন করে।
কিন্তু আগোরার বিনিয়োগকারীরা কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত মূল্যে সন্তুষ্ট ছিলেন না। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ এড়াতে তারা বিদেশি ক্রেতার সন্ধানে নামে।