বহুপাক্ষিক ঋণদাতারা উচ্চমূল্যের ঋণ নিয়ে ভাবছে
মাথাপিছু জাতীয় আয় বৃদ্ধি এবং ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিসরে প্রবেশ করায় স্বল্পমূল্যের (নমনীয়) বৈদেশিক ঋণ বাংলাদেশের জন্য অতীতের বিষয় হতে চলেছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন অংশীদার– বিশ্বব্যাংক থেকে শুরু করে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাইকা এবং এআইআইবি– তাদের দেওয়া ঋণের শর্তাবলী সংশোধনের কথা ভাবতে শুরু করেছে।
সূত্রগুলি জানিয়েছে, বিশ্বব্যাংক এরমধ্যেই অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সাথে এনিয়ে আলোচনাও শুরু করেছে। খুব শিগগির তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে এডিবি।
অতিরিক্ত সচিব এবং ইআরডির উইং প্রধান ড. পেয়ার মোহাম্মদ জানান, এডিবি ঋণের শর্তাদি পরিবর্তন করতে এবং নমনীয় ঋণের পরিমাণ কমাতে আগে থেকে প্রস্তুত ছিল, একইসাথে বাড়াচ্ছে সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেট (এসওএফআর) ঋণ।
তিনি বলেন, হিসাব অনুযায়ী, এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে বাংলাদেশের জন্য নমনীয় ঋণ কমে আসবে, কিন্তু এডিবি গ্র্যাজুয়েশনের আগেই তা করতে চায়।
নমনীয় ঋণ, ধার করা অর্থের পরিমাণ বাড়ানো/ কমানো বা পরিশোধের শর্ত পরিবর্তনের সুযোগ দেয়। অন্যদিকে, এসওএফআর ঋণ ব্যাংকগুলির মধ্যে মার্কিন ট্রেজারি বন্ড পুনঃক্রয়ের উপর ভিত্তি করে অর্থায়নের হার নির্ধারণ করে।
এই পটভূমিতে, বিশেষজ্ঞরা দ্রুত অর্থনৈতিক সুবিধা আনতে পারে এমন প্রকল্পগুলির জন্য নমনীয় ঋণ পাওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন। তবে প্রস্তুতির অভাবের কারণে বাংলাদেশ বেশ কয়েকটি প্রকল্পের জন্য এ ধরনের ঋণ পায়নি।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, এখন সহজ শর্তে যেসব ঋণ পাওয়া যাচ্ছে- তা চিরকাল স্থায়ী হবে না।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ একবার এলডিসি দেশ থেকে স্নাতক হয়ে গেলে, ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (আইডিএ বা আইডা) ঋণের সহজ 'অ্যাক্সেস' পাবে না, যা সুদমুক্ত। পরিবর্তে, ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক ফর রিকনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইবিআরডি) থেকে ঋণ পাওয়ার দিকে নজর দেবে।
বাংলাদেশ একটি আইডা-মিশ্রিত দেশ হবে। যেসব দেশ মাথাপিছু আয়ের স্তরের উপর ভিত্তি করে আইডিএ যোগ্য এবং একইসাথে কিছু আইবিআরডি ঋণ পাওয়ার যোগ্য- তাদেরকে আইডা-মিশ্রিত দেশ বলা হয়। যেমন প্রতিবেশী ভারত একটি আইডা-মিশ্রিত দেশ।
তবে ড. জাহিদ সতর্ক করে বলেন, আমরা যদি ভালো প্রকল্প তৈরি করে নমনীয় ঋণ সংগ্রহ করতে না পারি, তাহলে টেকসই ঋণ অর্থায়ন হারাতে হবে।
নাম না প্রকাশের শর্তে, ইআরডির এক কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশের জাতীয় আয় এখন মাথাপিছু ২,০০০ ডলারের উপরে। বিশ্বব্যাংক এখন বাংলাদেশকে আইডা-মিশ্রিত দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চায়, এরমধ্যেই কয়েকটি বৈঠকে প্রসঙ্গটি তুলেছে দাতা-সংস্থাটি। বাংলাদেশের প্রতি এর নীতিমালা অনুসারে আবেদন করতেও বলেছে।
বিশ্বব্যাংক তারপর একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করবে এবং ২০২৬ সালের শেষে বাংলাদেশ একটি আইডা-মিশ্রিত দেশে পরিণত হবে। তখন আইডিএ নমনীয় ঋণের পরিমাণ কমাবে।
মিশ্র দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে বাজার ভিত্তিক উচ্চ সুদে বা এসওএফআর ভিত্তিক ঋণ নিতে হবে। এই ধরনের ঋণে সুদ হার, বিভিন্ন চার্জসহ, ৩ থেকে ৪ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে৷
তবে এই হারগুলি আবার বাজারের অবস্থা এবং ঋণের মেয়াদের উপর নির্ভর করে। এই ধরনের ঋণ ২৫-৩০ বছরের মধ্যে ৪-৫ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ পরিশোধ করতে হবে।
বর্তমানে বাংলাদেশ আইডিএ ঋণের জন্য ১.২৫ শতাংশ সুদহার প্রদান করে। এছাড়া এসব ঋণে সার্ভিস চার্জ ০.৭৫ শতাংশ, যা পাঁচ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ৩০ বছরের মধ্যে ঋণ পরিশোধ করতে হয়।
বর্তমানে, ৬৪টি মধ্য আয়ের দেশ আইআরবিডি সদস্য, যারা আইডাভুক্ত দেশগুলির তুলনায় উচ্চ সুদ হারে ঋণ নিচ্ছে।
২০১৫ সালের ১৫ জুলাইয়ের আগে নিম্ন আয়ের দেশ হিসেবে বিশ্বব্যাংক থেকে ০.৭৫ শতাংশ সুদে ঋণ পেতো বাংলাদেশ। ওই ঋণ ছয় বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ৩৬ বছরে পরিশোধের সুযোগ পেতো।
অন্যান্য ঋণও প্রভাবিত হবে:
নিম্ন-আয়ের দেশ হিসেবে, বাংলাদেশ জাপান থেকে ৪০-বছরের পরিশোধের সময়কাল এবং ১০-বছরের ছাড় সহ সর্বনিম্ন ০.১ শতাংশ হারে ঋণ নিতে পেত। এরপর জাপানি ঋণের সুদ হার বৃদ্ধি সত্ত্বেও, সেটি এখনও ১ শতাংশের নিচে। তবে, ঋণ পরিশোধের সময়কাল ১০ বছর কমেছে, যার অর্থ ৩০ বছরের মধ্যে ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
বর্তমানে ধারণা করা হয়, যখন বিশ্বব্যাংকের সুদের হার বাড়বে, তখন জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) থেকে নেওয়া ঋণেও সুদ হারও বাড়বে।
এদিকে, এডিবি বাংলাদেশকে দেওয়া ঋণের শর্তাবলীতে এখনও কোনো পরিবর্তন করেনি।
এডিবি বর্তমানে ২ শতাংশ সুদ হারে বা লন্ডন ইন্টারব্যাংক অফারড রেট (লিবর)-এর ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশকে ঋণ দিচ্ছে– একটি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত সুদ হারের মূল বেঞ্চমার্ক– যা ব্যাংকগুলির মধ্যে ঋণ নেওয়ার খরচ নির্দেশ করে নির্ধারিত হয়।
এসব ঋণ ২৫ বছরের মধ্যে পরিশোধ করতে হয়, থাকে পাঁচ বছরের গ্রেস পিরিয়ড।
ইআরডি অবশ্য বর্তমান সুদ হারেই নমনীয় ঋণ পাবার চেষ্টা করছে।
সুযোগের সদ্ব্যবহার:
ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, প্রস্তুতির অভাবে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের আইডিএ-১৯ প্যাকেজ থেকে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি নমনীয় ঋণ থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
বাংলাদেশ তহবিল থেকে ৪.২ বিলিয়ন ডলার ঋণ পাবার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। গত দুই বছরে, ২.১ বিলিয়ন ডলার হয় অঙ্গীকার করা হয়েছে বা ১১টি প্রকল্পের জন্য একটি ঋণ চুক্তি হয়েছে। এছাড়া পাঁচটি প্রকল্পের ঋণ প্রক্রিয়ার সব আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে।
আগামী জুনের মধ্যে এই প্রকল্পগুলির জন্য বিশ্বব্যাংকের সাথে ১.২ বিলিয়ন ডলারের ঋণ চুক্তিতে পৌঁছানো যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এই হিসাবে, আইডিএ-১৯ তহবিল থেকে মোট ৩.৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ প্রতিশ্রুতি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, বাংলাদেশ প্রস্তুত থাকলে আরও বেশি ঋণ নিতে পারত। কারণ, ঋণদাতাটির আইডিএ-১৯ ঋণ প্যাকেজের মেয়াদ আগামী ৩০ জুন শেষ হবে।
বিশ্বব্যাংক সাধারণত তিন বছরের প্যাকেজে ঋণ দেয়, কিন্তু মহামারির কারণে, আইডিএ-১৯ এর সময়কাল আইডা দেশগুলির মধ্যে ঋণ প্রবাহ বাড়ানোর জন্য এক বছর কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আইডিএ-তে অ্যাক্সেস রয়েছে এমন দেশগুলির মধ্যে প্রথম তিন বছরে ৮২ বিলিয়ন ডলার বিতরণের লক্ষ্য ছিল। এখন একই পরিমাণ অর্থ দুই বছরে বিতরণ করা হবে।
প্রাথমিকভাবে, আইডিএ-১৯ প্যাকেজটি ২০২০ সালের জুলাই থেকে শুরু হয়ে চলবে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত। এর আগে আইডিএ-১৮ (জুলাই ২০১৭- জুন ২০২০) এর সময় ভালো প্রস্তুতির কারণে বাংলাদেশ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ঋণ পেয়েছিল।
আইডিএ-১৭ এর অধীনে, বাংলাদেশ ৪.৫ বিলিয়ন ডলার নমনীয় ঋণ পেয়েছে। প্রকল্পের ঋণ প্রক্রিয়ার প্রস্তুতির কারণে প্রথম দুই বছরেই প্রায় সম্পূর্ণ প্রতিশ্রুত ঋণ পেতে সক্ষম হয়েছিল।
ইতোমধ্যে, আইডিএ-২০ পরবর্তী তিন বছরের জন্য একটি ৯৩ বিলিয়ন ডলারের প্যাকেজ ঘোষণা করেছে (জুলাই ১, ২০২০ - ৩০ জুন, ২০২৫)।
জাহিদ হোসেন বলেন, আইডিএ ঋণের সুদ হার বাজার হারের চেয়ে কম, যার ২৫ বছরের পরিশোধের সময়কাল এবং ৫ বছরের গ্রেস পিরিয়ড রয়েছে।
তিনি বলেন, "আমরা যদি এত সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা নিতে না পারি, তাহলে এটা আমাদের জন্য বড় ক্ষতি হবে। একই সময়ে, যদি আপনি পাইপলাইনে অনুমোদিত ঋণ ব্যবহার করতে না পারেন, তাহলে তা পরিশোধ করতে হবে। সুতরাং, ঋণ চুক্তির আগে প্রকল্পের প্রস্তুতি এবং এর দক্ষ বাস্তবায়ন উভয় বিষয়েই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।"
তিনি আরও বলেন, লক্ষ্য হওয়া উচিত আগের চেয়ে আরও বেশি আইডিএ ঋণ পাওয়া।
"যেহেতু অনেক দেশ ঋণ ব্যবহার করতে পারে না, সেগুলি বিশ্বব্যাংক পুনঃঅর্থায়ন করে। যদি আমরা আমাদের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের শতভাগ ব্যবহার করতে পারি, তবে আমরা অন্যান্য দেশের অব্যবহৃত অর্থ থেকে ধার নিতে পারব, যা আমরা আইডিএ-১৬ এর সময় করতে পারতাম।"
ইআরডি এর সাবেক সচিব কাজী শফিকুল আযম বলেন, বিশ্বব্যাংক বা জাইকার মতো সহজ শর্তে ঋণ অন্য কোথাও পাওয়া যায় না।
"আমাদের লক্ষ্য ৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণ প্রতিশ্রুতি পাওয়ার হলে, আমাদের ৮ বিলিয়ন ডলারের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। শ্রীলঙ্কার মতো নয়, আমাদের এমন প্রকল্প নিতে হবে, যা অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হবে"-যোগ করেন তিনি।