ভ্যাকসিন বিরোধিতা টিকা কার্যক্রমের মতোই প্রাচীন, বিরোধীরা আছেন তখন থেকেই
১৯ শতকের আগেই ইংল্যান্ডে সর্বপ্রথম টিকাদান কার্যক্রম শুরু হয়। তখন থেকেই অ্যান্টি ভ্যাক্সার বা টিকা বিরোধীদের কার্যক্রমও শুরু হয়ে যায়। সম্প্রতি এই অ্যান্টি ভ্যাক্সারদের তালিকায় নতুন নাম লিখিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির ভ্রাতুষ্পুত্র রবার্ট এফ কেনেডি জুনিয়র। গত মাসে, কোভিড-১৯ সম্পর্কিত ভ্রান্ত তথ্য ছড়ানোর অভিযোগে কেনেডি জুনিয়রকে ইনস্টাগ্রাম থেকে বহিষ্কার করা হয়।
২০১৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা "ভ্যাকসিন নিয়ে সংশয়"কে বিশ্বের অন্যতম প্রধান স্বাস্থ্য ঝুঁকি হিসেবে ঘোষণা করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক ঘোষণার পর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আঘাত হানে করোনা মহামারি। ইতোমধ্যে বহু দেশ কোভিড-১৯ টিকাদান কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করেছে।
তবে থেমে নেই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। কখনো শোনা গেছে পুরো মহামারিই নাকি বিল গেটসের চক্রান্তের অংশ। মানুষের মাঝে ন্যানো প্রযুক্তির প্রতিস্থাপনের উদ্দেশ্যেই নাকি বিল গেটস মহামারির সূচনা ঘটিয়েছেন! আবার অনেকে মহামারিকে দেখেছেন ওষুধ উৎপাদনকারী ধূর্ত প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্যিক লাভের অংশ হিসেবে।
বর্তমানে এ ধরনের হাস্যকর ষড়যন্ত্র তত্ত্বের ছড়িয়ে পড়ার পিছে মানুষ ইন্টারনেটকে দায়ী করে থাকেন। তবে, কোভিড-১৯ নিয়ে ভ্রান্ত তথ্যের ছড়াছড়ির বহু আগে ১৯৫৫ সালে পোলিও টিকা নিয়েও কম বিতর্কের সৃষ্টি হয়নি। পোলিওকে মূলত টিকার মাধ্যমেই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হলেও যেসময় গুজব ছড়ায় যে, শিশুদের বন্ধ্যাত্বের দিকে ঠেলে দিতেই পোলিও টিকা দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে, নির্দিষ্ট ধর্ম ও জাতিকে বিপর্যস্ত করতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে গুজব ছড়ানো হয়।
কেনিয়ায়, ক্যাথলিক বিশপরা এ ধরনের ভুল তথ্য ছড়াচ্ছিলেন। অন্যদিকে, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানে মুসলিম নেতারা ভ্যাকসিনকে "পশ্চিমা চাল" হিসেবে অভিহিত করেন। এ ধরনের প্রতিরোধের কারণে দেশগুলোতে পোলিওকে নির্মূল করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
ডোনাল্ড হপকিন্স তার "প্রিন্সেস অ্যান্ড পেজেন্টস: স্মলপক্স হিস্ট্রি" বইতে ১৮৯৮ সালে প্রকাশিত ভারতীয় একটি প্রবন্ধের উল্লেখ করেন। প্রবন্ধটির বক্তব্য অনুযায়ী, ভারতে বেনারসের কয়েকজন পণ্ডিত পুরনো এক ভবিষ্যদ্বাণীর কথা বলে বেড়াতেন। ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে, সাদা রক্ত বিশিষ্ট কালো এক শিশুর নেতৃত্বে ভারত থেকে ব্রিটিশদের তাড়ানো সম্ভব হবে। টিকাদানের মাধ্যমে বৃটিশরা সেই শিশুটিকে হত্যার জন্য খুঁজছে বলে দাবী করেন পণ্ডিতরা। ২০১৪ সালের আগে ভারতকে পোলিও-মুক্ত ঘোষণা করা যায়নি।
উপনিবেশ আমলে বার্মাতেও (বর্তমান মিয়ানমার) এ ধরনের গুজব ছড়ায়। তখন বলা হয়, ইংল্যান্ডের রানি স্বপ্নে দেখেছেন যে, বার্মায় এমন এক শিশু আছে যার কারণে রানির পতন হবে। যেহেতু শিশুটিকে আলাদা করে খুঁজে বের করা সম্ভব ছিল না, তাই ইংরেজরা টিকাদানের মাধ্যমে বার্মার নতুন প্রজন্মের রক্তে বিষ ছড়াতে চাচ্ছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভ্যাকসিনের মাধ্যমে বহু মহামারিকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। তবে, টিকার মাধ্যমে ভয়াবহ সব রোগ-বালাই যত নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে, অ্যান্টি ভ্যাক্সাররাও ততই সরব হয়েছেন। ৭০ এর দশকে ব্রিটেনে শিশুদের রক্ষায় ডিপথেরিয়া, টিটেনাস এবং হুপিং কাশির টিকাদান নিয়ে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয়।
১৯৯৮ সালে ব্রিটিশ চিকিৎসাবিদ অ্যান্ড্রু ওয়েকফিল্ড এক গবেষণায় অটিজমের কারণ হিসেবে হাম্প, মাম্পস এবং রুবেলার টিকাকে দায়ী করেন। বিশ্বের অন্যতম চিকিৎসা সাময়িকী দ্য ল্যানসেটে গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়। ফলস্বরূপ বিশ্বব্যাপী তুমুল বিতর্ক সৃষ্টি হয়। বৈশ্বিক টিকাদানের হার হঠাৎ করেই নেমে আসে।
ইউরোপ এবং দক্ষিণ আমেরিকাতে যেখানে দীর্ঘদিন হাম কিংবা মাম্পসের অস্তিত্ব ছিল না, সেখানে নতুন করে এসব রোগের সংক্রমণ দেখা দেয়।
বিশেষজ্ঞরা গবেষণার বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করতে শুরু করলে ল্যানসেট গবেষণা প্ত্রটি প্রত্যাহার করে নেয়। বিভিন্ন দেশে স্থাপিত স্বাধীন প্যানেল নিযুক্ত করা হলেও তারা ওয়েকফিল্ডের দাবীর কোনো সত্যতা পাননি। কিন্তু, ক্ষতি যা হবার তা ততোদিনে হয়ে গিয়েছিল। ভ্যাকসিনগুলোর পুরনো বিশ্বস্ততা ফিরে পেতে বহু বছর সময় লেগেছিল।
আজকের দিনের কথা বললে পরিস্থিতি খুব একটা বদলায়নি। শ্রীলঙ্কায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক বার্তা অনুসারে, সরকারের বিতরণকৃত কোভিড-১৯ টিকা গ্রহণ করলে, দুর্বলতার কারণে এক বছরের মধ্যে মানুষ মৃত্যুবরণ করবে। এরকম আরেক বার্তা অনুসারে, বিদেশিদের কাছে শ্রীলঙ্কাকে বেঁচে দেওয়ার ষড়যন্ত্রের অংশ হল এই টিকাদান কর্মসূচী।
লেখক: হরি কুমার, হংকংভিত্তিক সাংবাদিক । লেখাটি 'পোস্ট ম্যাগাজিনের' করোনাভাইরাস সেকশানে প্রকাশিত হয়।