শুধু ভারত নয়, কোভিডের নয়া সংক্রমণ স্রোতে ভুগছে উন্নয়নশীল দেশগুলো
একা ভারত নয়, কোভিডের নতুন ও তীব্র সংক্রমণ স্রোতে বিশ্বজুড়ে উন্নয়নশীল অন্যান্য দেশও পড়েছে। যেকারণে প্রচণ্ড চাপের শিকার হচ্ছে তাদের স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থা, প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলায় তারা সাহায্যের অনুরোধও জানাচ্ছে।
বিগত কয়েক সপ্তাহ থেকেই দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার লাওস ও থাইল্যান্ড থেকে শুরু করে ভারতের প্রতিবেশী নেপাল ও ভুটানে দেখা যাচ্ছে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় সংক্রমণ বৃদ্ধির ঘটনা। ভাইরাসের নতুন ও অতি-সংক্রামক ধরনই আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির প্রধান কারণ। তার সঙ্গে অবশ্য, সরকারের নিজস্ব পদক্ষেপ নিয়ে আত্মতুষ্টি ও ভাইরাসের বিস্তার রোধে দরকারি সম্পদের ঘাটতিকেও অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে।
গেল সপ্তাহে চিকিৎসা সরঞ্জাম, ওষুধ ও যন্ত্রপাতি সাহায্য পাঠানোর আহবান জানান লাওসের স্বাস্থ্যমন্ত্রী। গত এক মাসে সেখানে শনাক্তের সংখ্যা ২০০ গুণ বেড়েছে। নেপালেও দ্রুত রোগীর ভিড়ে ভরে যাচ্ছে হাসপাতালগুলো, অক্সিজেন সরবরাহও চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে।
থাইল্যান্ডে ভাইরাসের আরেকটি অতি-সংক্রামক স্ট্রেইন নতুন করে আক্রান্তদের ৯৮ শতাংশকে সংক্রমিত করেছে। এতদিন প্রাদুর্ভাব মুক্ত থাকা প্রশান্ত মহাসাগরীয় অনেক দ্বীপরাষ্ট্রও প্রথমবারের মতো কোভিড-১৯ এর কবলে পড়েছে।
উন্নয়নশীল কোনো দেশের জনসংখ্যাই ভারতের মতো বিশাল নয় এবং সংক্রমণ বৃদ্ধির ঘটনাও ভারতের সমান না হলেও- কিছু দেশে সংক্রমণের আনুষ্ঠানিক হার লেখচিত্রে খাড়া ও ঊর্ধ্বমুখী, যা অনিয়ন্ত্রিতভাবে ভাইরাস বিস্তারের সম্ভাব্য বিপদের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
এমনকি গেল বছর মহামারিতে খুবই কম প্রভাবিত অনেক দেশে, এবার প্রথমবারের মতো বড় আকারে দুর্যোগের হুমকি সৃষ্টি করেছে ভাইরাসের এ পুনরুত্থান। একইসঙ্গে, বাড়িয়েছে দরিদ্র ও অপেক্ষাকৃত কম প্রভাবশালী দেশে দ্রুততার সাথে ভ্যাকসিন সরবরাহের গুরুত্ব। একমাত্র এ উপায়েই প্রলম্বিত মহামারির ঝুঁকি কমানো সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
"ভারতের পরিস্থিতি যে কোনও জায়গায় ঘটতে পারে, এবং তা সময় থাকতে অনুধাবন করা খুব গুরুত্বপূর্ণ," বলেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইউরোপ শাখার পরিচালক হান্স ক্লুগে। গত সপ্তাহে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে তিনি একথা বলেছেন। "উন্নয়নশীল দেশে সংক্রমণ প্রতিরোধ এবং টিকা সরবরাহ সুনিশ্চিত করাও একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ," বলে উল্লেখ করেন তিনি।
গত মাসে তার আগের মাসের তুলনায় সংক্রমণ বৃদ্ধির নাটকীয় বিশ্বরেকর্ড হয় লাওসে, যা ২২,০০০ শতাংশ। তারপরেই আছে নেপাল ও থাইল্যান্ড; উভয় দেশেই মাসওয়ারি তুলনায় কেস সংখ্যা ১,০০০ শতাংশ হারে উচ্চগতি লক্ষ্য করে।
এক মাসের ব্যবধানে সংক্রমণ বৃদ্ধির এ তলিকায় শীর্ষেস্থানে থাকা অন্যান্য দেশ হলো; ভুটান, ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগো, সুরিনাম, কম্বোডিয়া ও ফিজি। ক্ষুদ্র জনসংখ্যার এসব দেশে তিন সংখ্যার গতিতে প্রাদুর্ভাব ছড়াচ্ছে। জনসংখ্যা অনুপাতে যা মোটেই তুচ্ছ করার মতো পরিস্থিতি নয়, বরং রীতিমতো আতঙ্কজনক।
লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিকাল মেডিসিনের সংক্রামক রোগ ও মহামারিবিদ্যার অধ্যাপক ডেভিড হেইম্যান বলেন, "সমস্ত দেশই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারি 'এন্ডেমিক' বা শেষ পর্যায়ে আছে বলে মনে হলেও, অনাগত ভবিষ্যতে এটি বিশ্বের সকল দেশের জন্য ঝুঁকির কারণ হিসেবে থেকে যাবে।"
গত ১ মে নাগাদ তার আগের ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ৪,০১,৯৯৩ জন কোভিড রোগীকে শনাক্ত হয় ভারতে। তারপরের দিন মৃত্যুর সংখ্যা ৩,৬৮৯- এ পৌঁছে নতুন উচ্চতা স্পর্শ করে। হাসপাতালগুলো যেমন অসুস্থদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে, ঠিক তেমনি শ্মাশানে মৃতদের সৎকার করতে করতে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত দাহকারী কর্মীরা। পরিস্থিতির জটিলতা বহুগুণে বাড়িয়েছে মেডিকেল অক্সিজেনের সঙ্কট, অনেক রোগীকেই একারণে চিকিৎসা দেওয়া যাচ্ছে না, অনেকে হাসপাতালের দোরগোঁড়ায় এসেও শ্বাসকষ্টে প্রাণত্যাগ করছেন।
গেল বছর মহামারি শুরুর পর থেকে গত এপ্রিলের আগে লাওসে মাত্র ৬০ জন সংক্রমিত শনাক্ত হয়, এই সময়ে কোনো মৃত্যুর কথা জানানো হয়নি সরকারি তথ্যে। তারপর প্রাদুর্ভাবের সাম্প্রতিক নজিরবিহীন বিস্তারের ঘটনা স্থলসীমানা বেষ্টিত দেশটির সামনে উপস্থিত বিশাল চ্যালেঞ্জের ইঙ্গিত দেয়। সরকার যোগাযোগ নিষেধাজ্ঞা দিলেও, প্রতিবেশীদের সঙ্গে দুর্গম সীমান্ত দিয়ে অবৈধ অনুপ্রবেশ বন্ধের সক্ষমতা নেই দেশটির।
সমাজতন্ত্রী দল শাসিত লাওস রাজধানী ভিয়েনতিনে লকডাউন জারির পাশাপাশি, রাজধানীর সঙ্গে অন্যান্য প্রদেশের যোগাযোগও নিষিদ্ধ করেছে। সংক্রমিতদের প্রাণরক্ষাকারী চিকিৎসা সামগ্রী চেয়ে প্রতিবেশী ভিয়েতনামের সাহায্য প্রার্থনা করেছেন লাওসের স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
প্রবাসী কর্মীদের ফিরে আসার কারণে নেপাল ও ভুটানেও কেস সংখ্যার বিস্ফোরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই নেপালে শনাক্ত হয়েছে ভারতের নতুন ভ্যারিয়ান্ট, এত সংক্রামক ধরন মোকাবিলার মতো যথেষ্ট সামর্থ্য ও সম্পদ দেশটির নেই। 'হিমালয় কন্যা' খ্যাত দেশটির সরকার জানিয়েছে, তারা বেশিরভাগ ফ্লাইট চলাচল স্থগিত রাখাসহ বেশিরভাগ বড় হাসপাতালকে শুধুমাত্র কোভিড চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত রাখছে।
'অত্যন্ত সঙ্গিন':
জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য কৌশল বিশেষজ্ঞ আলি মোকদাদের মতে, "পরিস্থিতি অত্যন্ত সঙ্গিন, কারণ নতুন ধরনগুলি মোকাবিলায় নতুন টিকা আবিষ্কার বা ইতোমধ্যেই টিকা প্রাপ্তদের বুস্টার ডোজ দিতে হবে, যা মহামারির নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাকেও পিছিয়ে দেবে।"
মোকদাদ জানান, দরিদ্র দেশের অর্থনৈতিক সংগ্রাম ও অসচ্ছলতা এই যুদ্ধকে আরও কঠিন করে তুলবে।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ