স্পুটনিক ফাইভ: রাশিয়ার ভ্যাকসিন যেভাবে ইউরোপের রাজনীতিতে ভাঙন সৃষ্টি করেছে
সোভিয়েত প্রেরিত প্রথম যুগান্তকারী কৃত্রিম স্যাটেলাইট স্পুটনিকের নামে রাশিয়ার কোভিড ভ্যাকসিনের নামকরণের বিষয়টি মোটেই কাকতালীয় নয়। ১৯৫৭ সালে বিশ্ববাসী প্রথমবারের মতো রাশিয়ান শব্দ স্পুটনিকের অর্থ জানতে পারে। রাশিয়ান ভাষায় স্যাটেলাইটকে বলা হয় স্পুটনিক।
স্নায়ু যুদ্ধ চলার চরম পর্যায়ে মস্কোর স্পুটনিক-১ নিক্ষেপ পশ্চিমা শক্তিকে বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছিল। পশ্চিমা পরাশক্তির ধারণা ছিল প্রযুক্তিগত দিক থেকে তারা সোভিয়েতের তুলনায় এগিয়ে আছে। কিন্তু, স্পুটনিং তাদের চোখে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দিয়েছিল যে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতায় মস্কোর অবস্থান এখন শীর্ষে।
গত বছর আগস্টের শেষ নাগাদ খানিকটা তাড়াহুড়ো করেই কোভিড ভ্যাকসিন স্পুটনিক ফাইভের রেগুলেটরি অনুমোদন প্রদান করে মস্কো। পুতিন প্রশাসনের সমালোচকরা তখন ভ্যাকসিনটির কার্যকারিতার বিষয়ে সন্দিহান ছিলেন।
তবে, সময়ের সাথে ক্রমশ সেই সন্দেহের অবসান ঘটে। আর সেই সাথে, রাশিয়ার বিজ্ঞানীরা দ্বিতীয়বারের মতো চমকে দেন পশ্চিমা বিশ্বকে।
রাশিয়ার 'কোমল শক্তির হাতিয়ার'
রাশিয়াকে বর্তমানে পরিষ্কার রূপে হুমকি হিসেবে দেখে এমন একটি দেশের পূর্ব ইউরোপিয় একজন কূটনীতিক বিষয়টি এভাবে তুলে ধরেন : "২০২০ সালে ভ্যাকসিনের অনুসন্ধান পঞ্চাশের দশকে মহাকাশ যাত্রা নিয়ে প্রতিযোগিতার অনুরূপ ছিল। বহিরাগত অনেকে আবারও রাশিয়াকে গ্রাহ্য করেনি। কিন্তু, বিষয়টি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মস্কোর সবথেকে শক্তিশালী ও সম্ভাবনাময় সফট বা কোমল শক্তির হাতিয়ার।"
"সম্ভাবনাময়" শব্দটি এখানে বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
এখন পর্যন্ত স্পুটনিক ফাইভকে অনুমোদন প্রদান করেনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের মেডিসিন সংস্থা ইউরোপিয়ান মেডিসিনস এজেন্সি (ইএমএ)। অথচ, আর্জেন্টিনা, মেক্সিকো থেকে শুরু করে ইসরায়েল ও ফিলিপাইন পর্যন্ত বিভিন্ন দেশ ইতোমধ্যে ভ্যাকসিনটি কেনার জন্য রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি সম্পন্ন করেছে। রাশিয়ার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা দক্ষিণ কোরিয়া এবং ভারতে ভ্যাকসিনটি উৎপাদনের চুক্তিও স্বাক্ষর করেছে।
তবে ভ্যাকসিন বিতরণে আরেক বিপত্তি আছে।
আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট আলবার্টো ফার্নান্দেজ জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারিতে দুই ডোজ স্পুটনিক টিকা গ্রহণের পরও এপ্রিলে কোভিড আক্রান্ত হন। বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেয় যে, গামালেয়া ইন্সটিটিউটের দাবি অনুযায়ী ভ্যাকসিনের ৯১.৬ শতাংশ কার্যকারিতা সত্য হলেও, টিকাগ্রহণকারীদের একটি অংশ পুরোপুরি আশঙ্কামুক্ত নন।
তবে ইউরোপে স্পুটনিক ফাইভ যে সমস্যার সৃষ্টি করেছে তা মহামারি কেন্দ্রিক নয়, বরং রাজনৈতিক।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার সাথে মিলিতভাবে বিশ্বাসযোগ্য কন্ঠে কথা বলতে হিমশিম খাচ্ছে।
বিষয়টি আংশিকভাবে ইতিহাস ও ভৌগোলিকভাবে সম্পর্কযুক্ত। পর্তুগাল এবং মাল্টার চেয়ে লিথুনিয়া এবং পোল্যান্ডের কাছে রাশিয়া অধিক হুমকিস্বরূপ।
এছাড়াও বহু বছর ধরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে রাশিয়ার দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহের উপর ইউরোপীয় ইউনিয়ন নির্ভরশীল। আর তাই ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে বহু কূটনৈতিক পন্থা বিবেচনায় রাখতে হয়। আলেক্সেই নাভালনিকে হত্যাচেষ্টা কিংবা ইউক্রেনের সীমানার কাছে সৈন্য বিন্যাস ইত্যাদি কারণে রাশিয়াকে শাস্তির আওতায় আনার আকাঙ্ক্ষাও ইউরোপীয় ইউনিয়ন দীর্ঘদিন ধরেই লালন করে আসছে।
এখন নতুন করে রাশিয়ার ভ্যাকসিনের উপর ইউরোপের নির্ভরতা দুই পক্ষের সম্পর্কে ভারসাম্য রক্ষার বিষয়টিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
কিন্তু, তারপরও ভ্যাকসিন কার্যক্রমে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ধীর গতির কারণে হতাশ হয়ে ইউরোপের বেশ কিছু দেশ এখন মস্কোর দিকেই ঝুঁকতে শুরু করেছে।
'নিজের স্বার্থের কথা চিন্তা করতে হবে'
হাঙ্গেরি ইতোমধ্যে বিপুল সংখ্যক স্পুটনিক ফাইভ কিনে বিতরণ শুরু করেছে। ফ্রান্স এবং জার্মানিসহ কয়েকটি দেশ ইউরোপিয়ান মেডিসিনস এজেন্সির অনুমোদনের অপেক্ষা করছে। স্বাধীন সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে হাঙ্গেরি জরুরি অনুমোদন ক্ষমতা ব্যবহার করেছে।
প্রবীণ ফ্রেঞ্চ কূটনীতিক পিয়েরে ভিমন্ত বলেন, সদস্য রাষ্ট্রগুলোর স্পুটনিক কেনার চিন্তাভাবনা যুক্তিসংগত।
"আপনি প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হলেও নিজের স্বার্থের কথা চিন্তা করতে হবে," বিবিসিকে জানান কার্নেগি ইউরোপের এই সিনিয়র ফেলো।
তিনি আরও জানান, ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনুমোদনের তোয়াক্কা না করে যেসব দেশ রাশিয়ার ভ্যাকসিন ব্যবহার শুরু করেছে, তারা কোনো ঝামেলায় পড়লে ভোটারদের বিরোধিতার কারণে রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
স্পুটনিক দ্বন্দ্বে প্রধানমন্ত্রীর পতন
স্লোভাকিয়ার ঘটনা অন্যদের জন্য সতর্কবার্তা বহন করছে।
দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইগর মাতোভিচ গোপনে দুই লাখ ডোজ রাশিয়ার ভ্যাকসিন আমদানির ব্যবস্থা করেন। জোট সহযোগীদের সাথে পরামর্শে ব্যর্থতার দায়ে গত মাসের শেষে তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়।
অন্যদিকে, দেশটির বিজ্ঞানীরা জানান, অন্যান্য জায়গায় পাঠানো স্যাম্পলের তুলনায় ব্রাতিস্লাভায় পাঠানো ভ্যাকসিনগুলো ভিন্ন। রাশিয়ানরা এই দাবিকে মিথ্যা সংবাদ বলে নিন্দা জানিয়েছে। একই সাথে চালানটি ফেরত পাঠানোর দাবিও তুলেছে তারা। স্লোভাকিয়ার তরফ থেকে অনুমোদনের জন্য হাঙ্গেরির একটি প্রস্তাব বিষয়টিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
রাশিয়াকে সাধারণত ইউরোপ জুড়ে দ্বন্দ্ব ও অনিশ্চয়তা ছড়াতে কম্পিউটার হ্যাকিং ও মিথ্যা সংবাদ প্রচারে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়। অথচ ভ্যাকসিনগুলো কোনো অর্থের অপচয় ছাড়াই রাশিয়ার সেই স্বার্থসিদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে!
পিয়েরে জানান, পুতিন প্রশাসন বিষয়টিতে আনন্দিত না হয়ে পারবে না। "আমি নিশ্চিত তারা বিষয়টি উপভোগ করছে। আমরা বুদ্ধু না হই। রাশিয়া এবং চীন ভ্যাকসিনকে সফট বা কোমল ক্ষমতার হাতিয়ার এবং কূটনৈতিক চাল হিসেবে ব্যবহার করছে। ইইউ-এর সদস্যদের পরস্পরের বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে দিতে পারাটা স্বাভাবিক ভাবেই রাশিয়ার জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ।"
রাশিয়ার জন্য একটি উল্লেখযোগ্য বিজয়
আমাদের পূর্ব ইউরোপিয় কূটনীতিকও একই ধরনের আশঙ্কার কথা জানান। তিনি মনে করেন, আলেক্সেই নাভালনিকে বিষ প্রয়োগের মতো ঘটনায় ইউরোপের ব্যবস্থা গ্রহণের ধারাটি বেশ দুর্বল।
তিনি বলেন, "ভ্যাকসিন পর্ব আমাদের যা দেখাচ্ছে তা হল, রাশিয়ানদের ছাড়াই মস্কোর সাথে চুক্তি নিয়ে আমরা নিজেদের মধ্যেই সিদ্ধান্তহীনতায় জড়িয়ে যাচ্ছি।"
রাশিয়া লাগামহীন ভাবে বিশ্বব্যাপী ভ্যাকসিনের অর্ডার সংগ্রহ করে চলেছে। দেশটিকে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য এখনও অনেক কিছু করতে হবে। এই সপ্তাহে দেশটি ঘোষণা দেয় যে তারা রাশিয়া ও বেলারুশের বাইরে ইউরোপের প্রথম দেশ হিসেবে সার্বিয়ায় ভ্যাকসিন উৎপাদন শুরু করবে।
দেশটি ভারত ছাড়াও পশ্চিম ইউরোপে উৎপাদন বিস্তারের পরিকল্পনা করছে। তবে সেক্ষেত্রেও ইএমএ-র অনুমোদনের প্রয়োজন হবে। পাশাপাশি, রাশিয়া যে প্রক্রিয়ায় তথ্য সংগ্রহ করেছে এবং তাদের সংগৃহীত তথ্যসমূহ আদৌ ইউরোপীয় ইউনিয়নের মানদণ্ডের সাথে খাপ খাবে কিনা সে প্রশ্নও থেকে যায়।
তবে, রাশিয়া যে একটি উল্লেখযোগ্য বৈজ্ঞানিক এবং রাজনৈতিক জয় নিশ্চিত করে ফেলেছে সে বিষয়ে এখন আর কোনো দ্বিধা নেই।
প্রথম স্পুটনিক-১ বিশ্বকে বদলে দিয়েছিল। স্পুটনিক-৫ সে মাত্রার অর্জন করতে না পারলেও নিশ্চিতভাবেই রাশিয়া সম্পর্কে বিশ্ববাসীর ধারণা বদলাতে ভূমিকা রাখছে।
- সূত্র: বিবিসি