রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি কতটা নিরাপদ এবং কার্যকরী?
করোনাভাইরাসের নতুন প্রজাতি সার্স-কোভ-২ (SARS-CoV-2, Severe Acute Respiratory Syndrome Coronovirus-2)-এর আঘাতে টালমাটাল সারা বিশ্ব। আজ পর্যন্ত (২৭ এপ্রিল ২০২১) সারা বিশ্বে সার্স-কোভ-২ ভাইরাসে প্রায় ১৪ কোটি ৮৭ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে এবং এর মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছে ৩১ লক্ষ মানুষ। শুধু যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যু হয়েছে পাঁচ লাখ ৭০ হাজার মানুষের। এর পরে রয়েছে ব্রাজিল, মেক্সিকো, ভারত, যুক্তরাজ্য, ইতালি, রাশিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন এবং অন্যান্য দেশ। উইকিপিডিয়ার তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় মোট মৃত্যুর তিন ভাগের দুই ভাগের (বিশ লাখ) মৃত্যু হয়েছে এই দশটি দেশে, যার মধ্যে ব্রাজিল, মেক্সিকো ও ভারত বাদে সবগুলো দেশ উন্নত।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলো করোনা দিয়ে যেমন বিপর্যস্ত, তেমনি করোনার ভ্যাকসিন আবিস্কার এবং প্রয়োগেও তারা এগিয়ে। সার্স-কোভ-২ শনাক্তের মাত্র চার মাসের মাথায় এসব দেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করে এবং বেশ ভালো ফলও পায়। যুক্তরাজ্য বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে ফাইজার-বায়োএনটেক টিকা জনসাধারণের উপর প্রয়োগের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী সারা বিশ্বে সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত ১৩ টি ভ্যাকসিন জনসাধারণের উপর প্রয়োগ শুরু হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মডার্না, যুক্তরাজ্য ও সুইডেনের অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা, যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির ফাইজার-বায়োএনটেক, রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি, যুক্তরাষ্ট্র ও নেদারল্যান্ডসের জনসন অ্যান্ড জনসন, চীনের ক্যানসিনো বায়োলজিকস-এর অ্যাড৫-এন-কোভ, সিনোভ্যাক কোম্পানির করোনাভ্যাক ও সিনোফার্ম কোম্পানির বিবিআইপি-করভি এবং ইন্ডিয়ান কোম্পানি ভারত বায়োটেকের কোভ্যাকসিন বা বিবিভি ১৫২। এছাড়াও বিভিন্ন দেশের আরও ৭০টি টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলমান। গত ২৫ এপ্রিল ২০২১ বাংলাদেশের গ্লোব বায়োটেকের বঙ্গভ্যাক্স ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমতি পেয়েছে (সূত্র: প্রথম আলো)।
বাংলাদেশে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে যুক্তরাজ্য ও সুইডেনের আবিষ্কৃত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা দেয়া হচ্ছে। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট কর্তৃক প্রস্তুতকৃত এ ভ্যাকসিনটির গত ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় ৫৮ লাখ মানুষ এ টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন এবং দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন প্রায় সাড়ে ২১ লাখ। কিন্তু, ভারত করোনাভাইরাসের টিকা রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পর বাংলাদেশের টিকাদান কর্মসূচীতে সংকট সৃষ্টি হয়েছে এবং সঙ্কট কাটাতে গত ২৬শে এপ্রিল থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত প্রথম ডোজ টিকা প্রদান সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। সকলের জন্য ভ্যাকসিন নিশ্চিত করতে সরকার তাই বাধ্য হয়ে ভ্যাকসিনের বিকল্প উৎস খুঁজছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বরাত দিয়ে বিভিন্ন মিডিয়া বলছে রাশিয়া তাদের স্পুটনিক-ভি টিকা বাংলাদেশে তৈরির ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। প্রস্তাব অনুযায়ী রাশিয়া প্রযুক্তিগত সহায়তা দেবে আর বাংলাদেশি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো স্পুটনিক ভি টিকা উৎপাদন করবে। এটা নিঃসন্দেহে একটা সুখবর।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের কমপক্ষে তিনটি কোম্পানির টিকা উৎপাদনের সক্ষমতা আছে। কোম্পানিগুলো হল ইনসেপটা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালস ও হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস। প্রযুক্তিগত সহায়তা পেলে এ কোম্পানীগুলো দুই-তিন মাসের মধ্যেই টিকা উৎপাদনে যেতে পারবে বলে জানিয়েছে (সূত্রঃ প্রথম আলো, ২৪ এপ্রিল)। আজ ২৭শে এপ্রিল ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর বাংলাদেশে স্পুটনিক ভি টিকা জরুরী ব্যাবহারের অনুমোদন দিয়েছে। এতে করে এই টিকা আমদানি ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে এখন আর কোন আইনগত বাধা থাকল না।
কিন্তু, স্পুটনিক ভি টিকা কেমন কার্যকরী? নিরাপদ কিনা? অন্যান্য টিকা যেমন অক্সফোর্ড-এস্ট্রাজেনেকা, মডার্না, ফাইজার-বায়ো-এন-টেক ইত্যাদির তুলনার এর কার্যকারিতা কেমন? এসব বিষয় নিয়ে আমাদের দেশের মিডিয়ায় খুব একটা প্রচার পায়নি। এসব বিষয় নিয়েই আলোচনা করব এ লেখায়। স্পুটনিক ভি টিকাটি আবিষ্কার করেছে রাশিয়ার গ্যামেলিয়া রিসার্চ ইন্সটিটিউট অব এপিডেমিওলোজি ও মাইক্রোবায়োলজি নামক একটি প্রতিষ্ঠান। অক্সফোর্ড-এস্ট্রাজেনেকা, জনসন অ্যান্ড জনসন এবং চীনের ক্যানসিনো বায়োলজিকস-এর অ্যাড৫-এন-কোভ- এর মত এ ভ্যাকসিনটি এক প্রকারের ভেক্টর ভ্যাকসিন। এতে অনুলিপি তৈরি করতে সক্ষম নয় এরকম রিকম্বিনেন্ট অ্যাডিনোভাইরাসকে ভেক্টর হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। অ্যাডিনোভাইরাসকে ব্যবহার করে এর আগেও অন্যান্য রোগের জন্য ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়েছে এবং নিরাপদ বলে প্রমাণিত হয়েছে। জেনেটিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে অ্যাডিনোভাইরাস ভেক্টরের মধ্যে করোনাভাইরাসের সার্স-কোভ-২ প্রজাতিটির পূর্ণ-দৈর্ঘের স্পাইক প্রোটিন জিনটি প্রবেশ করিয়ে বানানো হয়েছে স্পুটনিক ভি টিকাটি। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা, জনসন অ্যান্ড জনসন এবং চীনের ক্যানসিনো বায়োলজিকস-এর অ্যাড৫-এন-কোভ কাছাকাছি প্রযুক্তিতে তৈরি। যেমন-অক্সফোর্ড-এস্ট্রাজেনেকা ব্যবহার করেছে শিম্পাঞ্জি অ্যাডিনোভাইরাস, জনসন অ্যান্ড জনসন ব্যবহার করেছে অ্যাডিনোভাইরাস টাইপ ২৬, চীনের ক্যানসিনো বায়োলজিকস ব্যবহার করেছে অ্যাডিনোভাইরাস টাইপ ৫। ভিন্ন অ্যাডিনোভাইরাস ভেক্টর ব্যবহার করা হলেও স্পুটনিক ভিসহ এ চারটি ভ্যাকসিনেই ব্যবহার করা হয়েছে করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের জিন। উল্লেখিত তিনটি সমগোত্রীয় ভ্যাকসিনের সঙ্গে স্পুটনিক ভি এর পার্থক্য হল, এর প্রথম ডোজের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে রিকম্বিনেন্ট অ্যাডিনোভাইরাস টাইপ ২৬ ও দ্বিতীয় ডোজে ব্যবহার করা হয়েছে রিকম্বিনেন্ট অ্যাডিনোভাইরাস টাইপ ৫ ভেক্টর। দুই ডোজের ব্যবধান ২১ দিন।
গত ২ ফেব্রুয়ারি প্রভাবশালী মেডিক্যাল জার্নাল ল্যানসেটে স্পুটনিক ভি টিকার তৃতীয় ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রাথমিক ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে (Safety and efficacy of an rAd26 and rAd5 vector-based heterologous prime-boost COVID-19 vaccine: an interim analysis of a randomised controlled phase 3 trial in Russia. Lancet, 2 February 2021)। সাধারণত তৃতীয় ধাপের ফলাফলের উপর ভিত্তি করেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং অন্যান্য রেগুলেটরি অথরিটি টিকা বা অন্য যেকোন পরীক্ষাধীন ওষুধ ব্যবহারের প্রাথমিক অনুমোদন দিয়ে থাকে। কি এক অদ্ভুত কারণে স্পুটনিক ভি টিকার তৃতীয় ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল ল্যানসেটের মতো প্রভাবশালী জার্নালে প্রকাশিত হলেও পাশ্চাত্য মিডিয়াসহ আমাদের দেশীয় মিডিয়ায় তেমন প্রচার পায় নি। রাশিয়ার বিভিন্ন হাসপাতালে ১৮ বছরের বেশী ২১,৯৭৭ জন ব্যক্তির উপর পরিচালিত একটি গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে ল্যানসেটের উক্ত গবেষণাপত্রটিতে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে র্যানডমাইজড, ডাবল ব্লাইন্ড পদ্ধতিতে ট্রায়ালে অংশগ্রহণকারীদের ভ্যাকসিন এবং প্লাসেবো এই দুই গ্রুপে ৩:১ অনুপাতে ভাগ করা হয়। এর মধ্যে ভ্যাকসিন গ্রুপের ১৬,৫০১ জনকে স্পুটনিক ভি ও ৫,৪৭৬ জনকে প্লাসিবো (ভ্যাকসিনের মত দেখতে অন্য কিছু) দেয়া হয়। ২১ দিন পর ২য় ডোজ দেয়া হয়। ২য় ডোজ দেয়ার দিন রোগীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয় এবং পিসিআর টেস্টের মাধ্যমে কভিড-১৯ টেস্ট করা হয়। পিসিআর টেস্টের ফলাফলে দেখা যায় ভ্যাকসিন গ্রুপের ১৪,৯৬৪ জনের মধ্যে ১৬ জনের কভিড-১৯ ধরা পড়ে, যা শতকরা হিসেবে ০.১ শতাংশ। অন্যদিকে প্লাসিবো গ্রুপের ৪,৯০২ জনের মধ্যে ৬২ জনের কভিড-১৯ ধরা পড়ে যা শতকরা হিসেবে ১.৩ শতাংশ। তার মানে স্পুটনিক ভি টিকার কার্যকারিতার ৯১.৬ শতাংশ, যা অক্সফোর্ড-এস্ট্রাজেনেকার টিকা থেকে ১৫.৬ শতাংশ বেশী। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল বলছে স্পুটনিক ভি সাধারণভাবে নিরাপদ, কিন্তু অন্যান্য টিকার মতো স্পুটনিক ভি টিকারও সাধারণ কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। এর মধ্যে ছিল ফ্লুর মত উপসর্গ (জ্বর, গা ব্যথা), ইনজেকশনর স্থলে লাল হয়ে যাওয়া, মাথা ব্যথা ও শারীরিক দুর্বলতা। গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ভ্যাকসিন গ্রুপের মধ্য থেকে তিনজন এবং প্লাসিবো গ্রুপের একজন মৃত্যুবরণ করে এবং গবেষণাপত্রে দাবি করা হয়েছে এসব মৃত্যুর সাথে ভ্যাকসিন গ্রহণের কোন সম্পর্ক ছিল না। তবে, করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন যেমন ইউকে ভ্যারিয়েন্ট (বি ১.১.৭) এবং সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট (বি ১.৩৫১), ব্রাজিলিয়ান ভ্যারিয়েন্ট (পি ১) এবং ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের (বি ১.৬২৭) বিরুদ্ধে স্পুটনিক ভি কার্যকর কিনা তা এখনও পরিষ্কারভাবে জানা যায়নি।
স্পুটনিক ভি টিকার সংরক্ষণ পদ্ধতিও কিছুটা সহজ। বিজ্ঞানীরা এর দুটি ফর্মুলেশন বের করেছেন। একটি লিকুইড বা তরল এবং অন্যটি শুষ্ক (ফ্রিজ-ড্রাইড)। লিকুইড ফর্মুলেশনটি -১৮ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় (বাসায় ব্যবহারের ফ্রিজের ফ্রিজার অংশের তাপমাত্রা) সংরক্ষণ করতে হবে এবং ফ্রিজ-ড্রাইড ফর্মুলেশনটি ২-৮ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যাবে। তাই, ফ্রিজ-ড্রাইড ফর্মুলেশনটি আমদানি-রপ্তানি উপযোগী।
স্পুটনিক ভি-এর ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল বেশ আশাব্যঞ্জক। ভ্যাকসিন নিয়ে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে সরকার এ টিকা ব্যবহারের অনুমোদন দেয়ার সিধান্তকে সাধুবাদ জানাই। আমদানির পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে প্রস্তুত করার যে প্রস্তাব রাশিয়া দিয়েছে সেটাকে কাজে লাগাতে হবে। এতে আমাদের ভ্যাকসিন তৈরির সক্ষমতা পুনরায় অর্জিত হবে। প্রসঙ্গত, মহাখালিতে অবস্থিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট একসময় ছয় ধরনের টিকা উৎপাদন করত এবং অন্যান্য দেশে রপ্তানিও করত। প্রযুক্তির সাথে খাপ খাওয়াতে না পেরে ২০১১ সালে তাদের টিকা উৎপাদন একবারে বন্ধ হয়ে যায়। জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের টিকা উৎপাদনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে হবে এবং গ্লোবের মত দেশীয় কামাপ্নিগুলোকে প্রণোদনা দিয়ে আমাদের স্থানীয়ভাবে টিকা তৈরির সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। আর তা হলে অন্যান্য অনেক ওষুধের মত দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে আমরাও আমাদের তৈরিকৃত ভ্যাকসিন রপ্তানি করতে সক্ষম হব।
- লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ এবং প্রশাসক, জনসংযোগ দপ্তর, রাবি
- ইমেইল: [email protected]