সতীর্থদের কাঁধে চড়ে বিদায় নিলেন মহানায়ক
সতীর্থদের মনে বিষাদের সুর ছুঁয়েছিল আগেরদিন। ম্যাচের দিন প্রকৃতিও যেন বিষাদী হয়ে উঠতে চাইল মহানায়ককে বিদায় জানাতে গিয়ে। বিকাল হতেই মুখ গুমড়ো আকাশ কেঁদে ওঠে। যদিও তাতে তামিম ইকবাল ও লিটন দাসের ব্যাটকে থামানো যায়নি। দুজনই করেছেন সেঞ্চুরি, তাদের ব্যাটে লেখা হয়েছে অনেক রেকর্ড। আর শেষটায় ১২৩ রানের বিশাল এক জয়।
যে জয়ে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে হোয়াইটওয়াশ জিম্বাবুয়ে। শেষটা এর চেয়ে আর কতই ভালো হতে পারত! অধিনায়ক হিসেবে শেষ ম্যাচ খেলতে নামা মাশরাফি বিন মুর্তজার জন্যই যেন ম্যাচটা খেলতে নেমেছিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা।
জয় নিশ্চিত হতেই মাশরাফিকে কাঁধে তুলে নিলেন তামিম, হাঁটলেন কিছুটা পথ। এরপর অধিনায়কের জার্সি গায়ে তুলে নিলেন সবাই। সবার জার্সি সামনে 'থ্যাংক ইউ ক্যাপ্টেন' আর পেছনে লেখা মাশরাফির নাম ও চিরচনো ২ নম্বর। তখন মাঠভর্তি শুধু মাশরাফিই। আপ্লুত মাশরাফি সতীর্থদের ভালোবাসা কেবল গ্রহণই করে গেছেন ছলছল চোখে।
অধিনায়ক হিসেবে বিদায়ী ম্যাচে জিম্বাবুয়েকে পঞ্চমবারের মতো হোয়াইটওয়াশ করা তৃপ্তি নিয়েছেন মাশরাফি। ছুঁয়েছেন একটি মাইলফলকও। বাংলাদেশের একমাত্র অধিনায়ক হিসেবে ৫০টি ওয়ানডেতে দলকে জয়ের স্বাদ এনে দেয়ার কীর্তি গড়ে অধিনায়কত্ব অধ্যায়ের ইতি টানলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা।
শুক্রবার সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে টস হেরে আগে ব্যাটিং করতে নামা বাংলাদেশ তামিম ইকবাল ও ম্যাচ সেরা লিটন দাসের দাপুটে সেঞ্চুরিতে ৪৩ ওভারেই ৩২২ রানের বিশাল সংগ্রহ গড়ে।
বৃষ্টি হানা দেওয়ায় ডাক ওয়ার্থ লুইস পদ্ধতিতে জিম্বাবুয়ের লক্ষ্য দাঁড়ায় ৩৪২ রান। জবাবে ভালো ব্যাটিং করেও খুব বেশি পথ পাড়ি দিতে পারেনি সফরকারীরা। ১০ উইকেটে ২১৮ রানে শেষ হয় তাদের ইনিংস।
৪৩ ওভারে ৩৪২ রানের বিশাল লক্ষ্য। দেখে-শুনে ব্যাটিং করার সুযোগ ছিল না জিম্বাবুয়ের সামনে। শুরু থেকেই রান তোলার দিকে মন লাগাতে চেয়েছে জিম্বাবুয়ে। কিন্তু শুরুতেই ছন্দপতন। দলীয় ৫ রানেই ওপেনার তিনাশে কামুনহুকামুইকে ফিরিয়ে দেন মাশরাফি। কিছুক্ষণ পর ব্রেন্ডন টেলরকে থামান মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন।
রেজিস চাকাভা ও শন উইলিয়ামস মিলে চেষ্টা করেছেন কিছুক্ষণ। এই জুটি ভেঙে সেই চেষ্টা নস্যাৎ করেন আফিফ হোসেন। ৩০ রান করে বিদায় নেন উইলিয়ামস। চাকাভা ৩৪ রান করে তাইজুল ইসলামের শিকারে পরিণত হন। ওয়েসলি মাধেভেরেও চেষ্টা করেছেন। তার ব্যাট থেকে আসে ৪২ রান।
এরপর সিকান্দার রাজাই যা লড়াই করেছেন। আগের ম্যাচে ঝড় তোলা ডোনাল্ট টিরিপানো এদিন তাণ্ডব চালানোর আভাস দিলেও পারেননি। ১৫ রান করে সাজঘরে ফেরেন তিনি। সিকান্দার রাজার ব্যাটে ২১৮ রান পর্যন্ত পাড়ি দিতে সক্ষম হয় জিম্বাবুয়ে। সিকান্দার রাজা সর্বোচ্চ ৬১ রান করেন। মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন সর্বোচ্চ ৪টি উইকেট নেন। তাইজুল দুটি উইকেট নেন।
এর আগে সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে আগে ব্যাটিং করতে নেমে রেকর্ডের বন্যা বইয়ে দেন বাংলাদেশের দুই ওপেনার তামিম ইকবাল ও লিটন দাস। তামিম-লিটনের জোড়া সেঞ্চুরিতে কেবল বাংলাদেশেরই নয়, নতুন করে লেখা হলো ওয়ানডে ক্রিকেট ইতিহাসের অনেক রেকর্ডও।
ইনিংস উদ্বোধন করতে নেমে একের পর এক কাব্যগাথা লিখে গেছেন তামিম-লিটন। দেখে-শুনে শুরু করলেও ক্রমেই বিধ্বংসী হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের এই দুই ওপেনার। উদ্বোধনী জুটিতেই ২৯২ রান যোগ করেন তামিম-লিটন। এটা যেকোনো উইকেটে বাংলাদেশের সেরা জুটি।
জুটিটি কেবল বাংলাদেশের ক্রিকেটেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। উদ্বোধনী জুটির রেকর্ডে অনেক কিংবদন্তি জুটিকেও ছাড়িয়ে গেছেন তামিম-লিটন। তামিম-লিটনের জুটিটি ওয়ানডে ক্রিকেট ইতিহাসের তৃতীয় সেরা। তাদের সামনে কেবল দুটি জুটি।
গত বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজের জন ক্যাম্পবেল ও শাই হোপের করা ৩৬৫ রানের জুটিটি ওয়ানডে ক্রিকেটের সেরা উদ্বোধনী জুটি। ২০১৮ সালে ইমাম উল হক ও ফকর জামানের গড়া ৩০৪ রানের জুটিটি দুই নম্বরে। ওই ম্যাচে পাকিস্তানের প্রতিপক্ষ ছিল এই জিম্বাবুয়েই।
যেকোনো উইকেট জুটিতেও তামিম-লিটনের ২৯২ রান জায়গা করে নিয়েছে সেরা দশের তালিকায়। ওয়ানডে ইতিহাসে যেকোনো উইকেট জুটির হিসেবে তামিম-লিটনের জুটিটি জায়গা করে নিয়েছে ছয় নম্বরে।
তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে টানা ৩০০ রান করার দিক থেকেও রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। এবারই প্রথম তিন ম্যাচের কোনো সিরিজের প্রতিটি ম্যাচে ৩০০'র বেশি সংগ্রহ গড়েছে বাংলাদেশ।
এত রেকর্ড গড়ার দিনে তামিম ও লিটন দুজনই সেঞ্চুরি করেছেন। বৃষ্টি নামার আগেই সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন লিটন। তামিম তখন ৭৯ রানে অপরাজিত। বৃষ্টির পর খেলা শুরু হতেই সিলেটের উইকেটে ঝড় বইয়ে দেন লিটন। ডানহাতি এই ব্যাটসম্যানের সামনে জিম্বাবুয়ের ব্যাটসম্যানরা রীতিমতো গলির বোলারে পরিণত হন।
তার ব্যাটিংয়েই শেষ ৯.২ ওভারে ১৪০ রান পায় বাংলাদেশ। ১১৪ বলে ১৩ট চারে সেঞ্চুরি পূর্ণ করা লিটনই শেষ পর্যন্ত খেলেন ১৪৩ বলে ১৬টি চার ও ৮টি ছক্কায় ১৭৬ রানের মহাকব্যিক এক ইনিংস। এই ইনিংস দিয়ে অনেক রেকর্ড নিজের করে নেন লিটন।
তামিম ইকবালের করা সর্বোচ্চ রানের ইনিংস ১৫৮ রান ছাড়িয়ে লিটন এখন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংসের মালিক। এক ইনিংসে তামিমের সর্বোচ্চ ৭টি ছক্কা মারার রেকর্ডটিও ছাড়িয়ে গেছেন তিনি। লিটনের ঝড় তোলার দিনে তামিমও খেলেছেন মন মাতানো ইনিংস। ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ১৩তম সেঞ্চুরি তুলে নেওয়া তামিম ১০৯ বলে ৭টি চার ও ৬টি ছক্কায় ১২৮ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেন।
লিটন আউট হওয়ার পর মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, আফিফ হোসেনরা বাকি বলগুলো সেভাবে কাজে লাগাতে পারেননি। যা করার, অপরাজিত থেকে যাওয়া তামিমই করেছেন। বাংলাদেশের ৩টি উইকেটই নেন জিম্বাবুয়ের পেসার কার্ল মুম্বা।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ: ৪৩ ওভারে ৩২২/৩ (তামিম ১২৮*, লিটন ১৭৬, মাহমুদউল্লাহ ৩, আফিফ ৭; মুম্বা ৩/৬৯)।
জিম্বাবুয়ে: ৩৭.৩ ওভারে ২১৮/১০ (শন উইলিয়ামস ৩০, মাধেভেরে ৪১, সিকান্দার রাজা ৬১; সাইফউদ্দিন ৪/৪১, তাইজুল ২/৩৮, মাশরাফি ১/৪৭)।
ফল: বাংলাদেশ রানে ১২৩ জয়ী।
সিরিজ: তিন ম্যাচের সিরিজে বাংলাদেশ ৩-০ ব্যবধানে জয়ী।
ম্যাচসেরা: লিটন দাস।
ম্যান অব দ্য সিরিজ: লিটন দাস ও তামিম ইকবাল।