সাগরের অলিম্পিক যাত্রা: চা বিক্রেতা মায়ের কঠিন সংগ্রাম
রাজশাহীর ছোট বনগ্রাম এলাকার বাসিন্দা সেলিনা। নগরীর চন্দ্রিমা আবাসিক এলাকার বঙ্গবন্ধু কলেজ মোড়ে তার একটি চায়ের দোকান রয়েছে, সেটি চালিয়েই জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি। তা হঠাৎ সেলিনার কথা বলা হচ্ছে কেন? কারণ, সেলিনার ছেলে সাগর ইসলাম যে খেলতে যাচ্ছেন প্যারিস অলিম্পিকে! বাংলাদেশের এই আর্চার সরাসরি সুযোগ পেয়েছেন দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ খ্যাত এই প্রতিযোগিতায়। সাগরের সম্পর্কে জানতেই তাই তার বাড়িতে যাওয়া, আর সেখানেই দেখা মিলল তার মা সেলিনার।
আমরা যখন সেলিনার চায়ের দোকান খুঁজে সেখানে পৌঁছালাম তখন আকাশ কালো মেঘে ভরে উঠেছে, চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছিল ক্রমশ। একটু পরেই নামল ঝুম বৃষ্টি। ঠিক যেন সেলিনার জীবনের গল্পের মতোই। ১৫ বছর আগে, ২০০৯ সালে তার জীবনেও নেমে এসেছিল অন্ধকার, কালো মেঘে ছেয়ে গেছিল সেলিনা ও তার চার সন্তানের ভবিষ্যত। সেলিনার স্বামী মারা যান ২০০৯ সালে, তিনিই ছিলেন পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস। সেই নির্ভরতার জায়গাকে হারিয়ে অকুল পাথারে পড়েন সেলিনা।
কিন্তু চার ছেলেমেয়েকে নিয়ে বাঁচতে তো হবে। সেলিনা নামলেন জীবনযুদ্ধে। পলিথিনে মোড়ানো এক দোকান দিয়ে শুরু করলেন চা-বিস্কুট বিক্রি। আজ সেখানে পলিথিনের জায়গায় টিনের বেড়া দেয়া। তবে সেটি করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে সেলিনাকে, 'সাগরের বাবার মৃত্যুর পর রাস্তার পাশে ফুটপাতে চায়ের দোকান করি। ভোর পাঁচটায় দোকান খুলে রাত ১১টায় ফিরতাম। আগে ওপরে পলিথিন টানানো ছিল। এখন ওপরে টিন দিয়ে আর চারপাশে বেড়া দিয়েছি।'
এই জায়গায় আসতে কত সংগ্রাম করতে হয়েছে সেই গল্পও শোনালেন সেলিনা, 'আশেপাশের লোকজন প্রথম প্রথম অনেক অত্যাচার করেছে। আমার দোকান ভেঙে দিয়েছে, কাপ চুরি করে নিয়ে গেছে। আমি মহিলা মানুষ বলে অনেক কটু কথাও শুনিয়েছে, কিন্তু আমি হাল ছেড়ে দিইনি।' সব মিলিয়ে সাতবার সেলিনার দোকান নষ্ট করেছেন এলাকার লোকজন, প্রতিবারই তিনি আগের চেয়েও প্রবল উদ্যমে শুরু করেছেন নিজের ছেলেমেয়ের দিকে তাকিয়ে। সেলিনার অদম্য স্পৃহা দেখেই হয়তো, এরপর আর তেমন বাধা দেয়নি কেউ।
এরপর এলো সাগর প্রসঙ্গ, এত এত খেলা থাকতে কীভাবে আর্চারিতে সাগরের আসা সেই গল্প শোনালেন তার মা, 'ছোট থেকে সাগরের খেলার প্রতি খুব আগ্রহ। আমাদের বাড়ির পাশেই একটা আর্চারি ক্লাব আছে, নাম এসবি ক্লাব। সেখানে খেলা শেখায় বাচ্চু নামের এক কোচ। তাকে গিয়ে বললাম, বাবা আমার ছেলেটাকে নাও, খেলা শিখাও। ওরা নিল। ওখানে অনুশীলন করল। মাসে ৫০০ টাকা দিতে হতো।'
সাগর অলিম্পিকে সুযোগ পাওয়ায় সেলিনার খুশি মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। সেই উচ্ছ্বাস তার কণ্ঠে ধরা পড়ে, 'সাগরের সাফল্যে খুব ভালো লাগছে। আমার ছেলে অলিম্পিকে খেলবে, সারা দুনিয়ার মানুষ সাগরকে দেখবে। দেশের মানুষ তো এখন ওকে চেনেই। আল্লাহ আমার ছেলেকে এত দূর পৌঁছে দিয়েছেন। দোয়া করি সে যেন আরও বড় হয়। তবে এখানেই ওর শেষ না, সাগর আরও ভালো করবে বলে আমার বিশ্বাস।'
২০১৭ সালে এসবি ক্লাবে ভর্তি হন সাগর। তার দুই বছর পর ২০১৯ সালে বিকেএসপি থেকে ডাক আসে এই আর্চারের। বাংলাদেশের খেলোয়াড় বানানোর এই বিখ্যাত কারখানায় সাগরকে ভর্তি করে দেন সেলিনা। প্রশ্ন জাগে, বিকেএসপিতে পড়ার খরচ জুগিয়েছেন কীভাবে? তখন সেলিনা জানান, 'বিকেএসপি কর্তৃপক্ষকে আমার আর্থিক অবস্থার কথা বলি। তখন তারা সবকিছু দেখেশুনে আমার সাগরের বেতন মওকুফ করে দেয়। বছরে মাত্র তিন হাজার টাকা দিতে হতো তাদেরকে। আর ওর পড়ার জন্য কিছু বেতন। বাকি সব বিকেএসপি থেকেই করেছে।'
কথা হয় সাগরের কোচ বাচ্চুর সঙ্গে, যার কাছে হাতেখড়ি হয়ে আজ অলিম্পিকের মঞ্চে চলে গেছে সাগর। বাচ্চুর কাছে জানতে চাওয়া হয়, এত এত খেলোয়াড় অনুশীলন করে, সেখানে সাগরের মধ্যে আলাদা কিছু ছিল কিনা, 'সাগর যখন থেকে অনুশীলন শুরু করে তখনই আমি বুঝেছি ও বাকিদের মতো না। আমি যা যা বলতাম সে খুবই মনোযোগ দিয়ে শুনত আর ওভাবেই সব করার চেষ্টা করত।' সাগরের অর্জনের এখন বাচ্চু বুক ফুলিয়ে বলতে পারেন, তার ছাত্র অলিম্পিকে খেলতে যাচ্ছে, বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে তার হাত ধরে আরও খেলোয়াড় বড় মঞ্চে দেশের হয়ে লড়বে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন রাজশাহীর এই আর্চারি কোচ।
ছোটবেলা থেকে সাগরকে মানুষ করতে বেশ লড়তে হয়েছে সেলিনার। চঞ্চল হওয়ার কারণে স্কুলে সাগরকে পড়ানো ছিল কঠিন কাজ। সাগরের শিক্ষক সেলিনাকে আলটিমেটাম দিয়েছিলেন- হয় ক্লাসের সময় সেলিনাকে সাগরের পাশে বসে থাকতে হবে নয়তো তাকে স্কুল থেকে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু বসে থাকলে ব্যবসার ক্ষতি হবে বিধায় মাঝেমাঝে সাগরকে নিয়ে দোকানে চলে আসতেন সেলিনা, 'এমন কতদিন হয়েছে আমি সাগরকে এনে ওই সামনের বেঞ্চে শুইয়ে রাখতাম। আমার ছোট্ট সাগর ওখানেই ঘুমিয়ে যেতো। দোকানের কাজ শেষ করে আমি কোলে করে ওকে বাড়িতে নিয়ে যেতাম।'
নিজের জীবন সংগ্রামের গল্প করে যেতে থাকেন সেলিনা, আমরা মুগ্ধ হয়ে তা শুনে যেতে থাকি। চা বিক্রি করে দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। বড় মেয়ের স্বামী বিএ পাস করেছেন তবে কোনো চাকরি পাননি। ছোট মেয়ের স্বামী ঢাকায় এক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন মাস্টাররোলে। বড় ছেলে অনার্স পর্যন্ত পড়ে কোনো চাকরি পাননি। তিনি এখন পুকুরে মাছের ব্যবসা করেন। ছোট মেয়েটা অনার্স পড়ছেন। সেলিনা বলে ওঠেন, 'খুব কষ্ট করে সংসার চালিয়েছি। সংসার চালাতে ভীষণ কষ্ট। এটা যে করে, শুধু সে-ই জানে।'
এক সময় সেলিনার দোকান ছিল এলাকার লোকের চক্ষুশূলের কারণ। আজ সেই দোকান দাঁড়িয়ে আছে সগর্বে। টিনের দেয়াল যেন স্বাক্ষ্য দিচ্ছে সেলিনার সংগ্রামের গল্পের। জীবনের প্রতিটা পদে পদে তার যুদ্ধ করার চিহ্ন বহন করছে এই দোকানটি। এখন লোকজন শুধু চা-বিস্কুট খেতেই আসে না, সাগরের অর্জন নিয়েও শুনতে আসে। সেলিনার জীবন যে রাতারাতি বদলে গেছে তা নয়, এখনও চা বিক্রি করা থামাতে চান না। কারণ সেলিনারা থামতে জানেন না, সেলিনারা সেই কিংবদন্তি যাদের গল্প শুনে অনুপ্রেরিত হবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। ধ্বংস্তূপ থেকে একজন সেলিনা উঠে এসে নিজের সন্তানকে যদি অলিম্পিকে পৌঁছে দিতে পারেন, তাহলে অসম্ভব বলে কী আসলেই কিছু আছে?
সেলিনার আরও বড় কৃর্তিত্ব যে স্বামী মারা যাওয়ার পরও ছেলেদের কাজে পাঠিয়ে দেননি তিনি। পড়াশোনা করিয়েছেন, খেলাধুলায়ও উৎসাহ দিয়েছেন। বাংলাদেশের কয়টা পরিবারের অভিভাবকরা এই সাহসটি করবেন তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। সাগর ইসলাম খেলবেন অলিম্পিকে, তিনি এখন গোটা দেশের পরিচিত মুখ। কিন্তু একজন সাগরের উঠে আসার পেছনে যে একজন সেলিনাও থাকেন, সেই গল্প জানে কজন! আমরা সেলিনাকে সাগরের মা হিসেবে নয়, বরং সাগরকেই সেলিনার গর্বিত সন্তান হিসেবে চিনি, তাতেই আমাদের সার্থকতা।