মার্কিন প্রেসিডেন্টদের আত্মজীবনীমূলক বইয়ের ইতিকথা
আগামী ১৭ নভেম্বর ২৫টি ভাষায় প্রকাশিত হতে যাচ্ছে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার স্মৃতিকথামূলক বই 'আ প্রমিজড ল্যান্ডের' প্রথম খন্ড। ইতোপূর্বেও তার দুটি স্মৃতিকথামূলক বই প্রকাশিত হয়েছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীদের বই প্রকাশ বর্তমানে নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে ইতিহাসবিদদের মতে এই রীতি নতুন গড়ে উঠেছে। রাটগারস ইউনিভার্সিটির ইতিহাসবিদ ডেভিড গ্রিনবার্গ জানান, প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে ওবামার প্রকাশিত বইটি একটি প্রকৃত স্মৃতিকথামূলক বই ছিল।
১৯৯৫ সালে প্রকাশিত ওবামার 'ড্রিম ফ্রম মাই ফাদার' বইটি সাহিত্যগুণের জন্যই জনসমাদৃত হয়। ২০০৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রস্তুতির সময় তিনি 'দ্য অডাসিটি অব হোপ' বইটি প্রকাশ করেন।
গ্রিনবার্গ এই বইটির ব্যাপার বলেন, 'বইটি মূলত প্রচারণামূলক বই, প্রচারণার জন্যই উপযুক্ত। এধরণের বই এখন প্রায়ই দেখা যায়।'
'অথর ইন চিফ: দ্য আনটোল্ড স্টোরি অব আওয়ার প্রেসিডেন্টস অ্যান্ড দ্য বুকস দে রোট' (Author in Chief: The Untold Story of Our Presidents and the Books They Wrote) বইয়ের লেখক ইতিহাসবিদ ক্রেইগ ফেরম্যান জানান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের প্রথমদিকের প্রেসিডেন্টরা তাদের জীবদ্দশায় আত্মজীবনী প্রকাশের কথা চিন্তাই করেননি।
ফেহরম্যান জানান, যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম পাঁচজন প্রেসিডেন্টের চারজনই বই লেখার চেষ্টা করেছেন, তবে তাদের মৃত্যুর পর প্রকাশিত হবে ধরেই তারা বই লেখার কাজ চালিয়ে যান। যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসনের লেখা নিয়ে পরবর্তীতে স্মৃতিকথামূলক বই ও চিঠি প্রকাশিত হয়।
'বইটি তৎকালীন বেস্ট সেলার বই ছিল। সেসময় দশ হাজার বই বিক্রি হওয়াই অনেক বড় ব্যাপার ছিল।'
নিজের জীবদ্দশায় আত্মজীবনী প্রকাশ করা প্রথম প্রেসিডেন্ট জেমস বুখানান। দাস প্রথার ব্যাপারে তার ভূমিকাসহ বিভিন্ন কারণে প্রেসিডেন্ট হিসেবেই তিনি বেশ সমালোচিত। তার বইয়ের সমালোচনা করে ফেরম্যান জানান, 'আমি যত প্রেসিডেন্টের স্মৃতিকথামূলক বই পড়েছি, এরমধ্যে সবচেয়ে বাজে বইটি বুখানানের।'
বইটিতে যুদ্ধ ও যুদ্ধ পরবর্তী প্রভাবের কারণে তিনি নিজেকে ছাড়া সকলকে দোষারোপ করেছেন। তবে ঠিকই সেসময় বইটির বিক্রি ভালো হয়। গৃহযুদ্ধের পর দেশের নীতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার জন্যই সেসময় বইটি কেনার হিড়িক পড়ে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের ১৮তম প্রেসিডেন্ট উলিসেস এস গ্রান্টের লেখা 'পার্সোনাল মেমোয়েরস অব উলিসেস এস গ্রান্ট' বইটিও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। উলিসেস এই বইটিতে তার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বকালীন সময়ের কথা লেখেননি, গৃহযুদ্ধের সময়ের বিভিন্ন ঘটনা নিয়েই দুই খণ্ডের এই বইটি প্রকাশ করেন। 'গৃহযুদ্ধের পর মানুষের সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণ বাড়তে থাকে, তখনই গ্রান্টের বইটি পাঠকরা লুফে নেয়।'
১৮৭৭ সালে তার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর লেখক হওয়ার কোনো পরিকল্পনাই ছিলনা গ্রান্টের। তবে পরবর্তীতে ব্যবসায়িক ক্ষতির কারণে লেখালেখির সিদ্ধান্ত নেন তিনি। সেসময়ই গ্রান্ট বুঝতে পারেন তিনি লিখতে ভালবাসেন। তার প্রকাশক মার্ক টোয়াইন তাকে একটি বই লেখার জন্যও রাজি করিয়ে ফেলেন। বইটি লেখার সময় ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন তিনি। সেসময় তার বইয়ের ব্যাপারে নিয়মিত সংবাদ প্রকাশিত হতো, জাতীয় আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে গিয়েছিল বিষয়টি। ১৮৮৫ সালে গ্রান্টের মৃত্যুর এক বছর পরেই বইটি প্রকাশিত হয়। বইতে নিজের যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতা বর্ণনা ও ভুলের স্বীকারোক্তির কারণে ব্যাপক পাঠক সমাদৃত হয় বইটি।
সেসময় বই কেনার বিষয়টিও বিলাসিতা ছিল, তবে গ্রান্টের বই প্রকাশের পরবর্তী সময়ে প্রেসিডেন্টের লিখিত বইয়ের চাহিদা তৈরি হয়। ফেরম্যান গ্রান্টের ব্যাপারে বলেন, 'গ্রান্ট বেশিরভাগ মানুষের পছন্দের প্রেসিডেন্টের তালিকায় না থাকলেও তিনি একজন অসাধারণ লেখক। এখন হতো সবাই বইটির নামই ভুলে গেছে, তবে সেসময়ের সর্বাধিক জনপ্রিয় বই ছিল এটি।'
হ্যারি এস ট্রুম্যান থেকে শুরু করে পরবর্তী অনেক প্রেসিডেন্টই এ ধারা বজায় রাখেন। টেক্সাস এ অ্যান্ড এম ইউনিভার্সিটির রাজনৈতিক বিজ্ঞানী জর্জ সি. এডওয়ার্ড জানান, প্রেসিডেন্সিয়াল লাইব্রেরির প্রচলন শুরু হওয়ার পরই এই পরিবর্তন শুরু হয়। ১৯৪১ সালে ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট প্রথম প্রেসিডেন্সিয়াল লাইব্রেরি স্থাপন করেন।
'তারা পদ্ধতিগত ভাবে ইতিহাস পর্যালোচনার চিন্তা শুরু করেন। সেসময়ই ঐতিহাসিক রেকর্ড সংরক্ষণ গুরূত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে শুরু করে।'
হ্যারি এস ট্রুম্যান তার দায়িত্বকালীন বিভিন্ন ঘটনার ব্যাপারে তার বইয়ে লিখে যান। কোরিয়ান যুদ্ধের ব্যাপারে তার সিদ্ধান্ত ও চিন্তার ব্যাপারেও লিখেন বইটিতে।
সাবেক প্রেসিডেন্টদের লেখা বইগুলো ব্যাপক আলোড়নের সৃষ্টি করলেও প্রেসিডেন্টের বিষয়ে কিছু লিপিবদ্ধ করার সময় বইগুলোতে উল্লিখিত তথ্য পুণরায় পর্যালোচনার পরামর্শ দেন ইতিহাসবিদ ও রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।
এডওয়ার্ড বলেন, 'বইগুলোতে প্রেসিডেন্টরা নিজস্ব ধারণা ও বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে তাদের চিন্তার কথা লিখে যান। কথাগুলো গুরূত্বপূর্ণ হলেও শেষ কথা নয়। আপনি শুধু তাদের লেখা বইয়ের উদ্ধৃতি দিয়েই তাদের জীবনী লিখলে ব্যাপারটি বেশ অস্বাভাবিক।'
প্রেসিডেন্টদের নিজস্ব মতামতকে খুব বেশি গুরূত্ব দেয়ার ব্যাপারে সতর্ক করেন গ্রিনবার্গও। রিচার্ড নিক্সনের প্রথম বইতে তিনি দাবী করেন ১৯৬০ সালের নির্বাচনে জন এফ কেনেডির বিরুদ্ধে নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর তিনি নির্বাচনের ফলাফলকে চ্যালেঞ্জ করেননি। তবে এ দাবী সম্পূর্ণ ভুল; নির্বাচনে পরাজয়ের পর ১১টি রাজ্যে ফলাফলের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেয় রিপাবলিকান পার্টি।
'নিক্সনের অনেক জীবনীতেই তার লেখা বইয়ের উদ্ধৃতি দিয়েই অনেক লেখক ভুল তথ্য দিয়েছেন। প্রখ্যাত অনেক লেখক ও ইতিহাসবিদকেও আমি এই ভুল করতে দেখেছি।'
বইগুলো আমেরিকান পাঠকদের ব্যাপারে কী বার্তা দেয় তা-ই স্মৃতিকথামূলক বইয়ের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয়। যুক্তরাষ্ট্রে সবসময়ই নন-ফিকশন বইয়ের জনপ্রিয়তা ছিল। দাসত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া কোনো ব্যক্তির আত্মজীবনী বা দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি- প্রেসিডেন্টের জীবনী; এ ধরণের বই সবসময়ই আমেরিকায় জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ছিল। আমেরিকান জনগণ সবসময়ই নাগরিকের দৃষ্টিকোণ থেকেই প্রেসিডেন্টদের লেখা বই পড়েছেন।
'আমরা জানতে চাই তারা কী চিন্তা করেন, বিশ্বাস করেন। পরবর্তীতে ভোটার হিসেবে এসব তথ্য কাজে লাগাতে চাই।' বলেন ফেরম্যান।
সূত্র: স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিন