‘শিম গ্রাম’ থেকে শিম যাচ্ছে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া
মাগুরা সদরের লক্ষ্মীকন্দর গ্রামটি স্থানীয়ভাবে ‘শিম গ্রাম’ হিসেবে পরিচিত। চলতি মৌসুমে লক্ষ্মীকন্দর গ্রামে প্রায় ২০০ হেক্টর জমিতে শিম চাষ হয়েছে। এখানকার উৎপাদিত শিম সারাদেশে সরবরাহের পাশাপাশি সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। কিন্তু মধ্যসত্ত্বভোগী ও ব্যাপারীদের দৌরাত্মের কারণে বরাবরই এখানকার কৃষকরা তাদের উৎপাদিত শিমের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
কৃষকদের লোকসানের কথা স্বীকার করে জেলা কৃষি বিভাগ ও বাজার বিপণন কর্মকর্তারা বলছেন, জেলা প্রশাসনের সহায়তায় তারা কৃষকদের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিতে কাজ করে যাচ্ছেন।
লক্ষ্মীকন্দর গ্রামের রাস্তার দুই পাশে যে দিকে চোঁখ যায় শুধু শিম আর শিম ক্ষেত। বছরের পর বছর ধরে স্থানীয় পারনান্দুয়ালী, ঠাকুর বাড়ি, লক্ষ্মীকন্দর, কছুন্দি, রামনগর, বেলনগর, পতুরিয়া, দূর্গাপুরসহ আশপাশের ১০ গ্রামের কমপক্ষে এক হাজার কৃষক এ মাঠে শুধু শিম চাষ করে আসছেন। এখানকার উৎপাদিত স্থানীয় জাতের মোটা ও চওড়া শিম সারাদেশে ব্যাপক সমাদৃত।
শুধুমাত্র শিম চাষে অর্জিত অর্থ দিয়েই এই এলাকার কৃষকরা সারা বছর তাদের জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। তবে আড়ৎদার, ব্যাপারী ও মধ্যসত্ত্বভোগী সিন্ডিকেটের কারণে বরাবরই এখানকার চাষিরা তাদের উৎপাদিত শিমের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছেন। বর্তমানে যেখানে স্থানীয় খুচরা বাজারে প্রতি কেজি শিম ২৫ থেকে ৩০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে, সেখানে এখানকার কৃষকরা পাইকারি বাজারের নিয়োগকৃত আড়ৎদার ও ব্যাপারি সিন্ডিকেটের কাছে ৮ থেকে ১০ টাকা কেজি দরে শিম বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে কৃষকদের অনেক কষ্টে উৎপাদিত পণ্যের লাভের অধিকাংশ অর্থ চলে যাচ্ছে সিন্ডিকেটের পকেটে।
লক্ষণ মণ্ডল, নীলকান্ত মণ্ডল ও বাদল চন্দ্র বিশ্বাসসহ একাধিক কৃষকের অভিযোগ, মাগুরা পাইকাড়ি কাঁচা বাজারের নিয়োগকৃত দুই-তিনজন ব্যাপারি তাদের এলাকার সব শিম কিনে নেন। অন্য ব্যাপারিদের এলাকায় ঢুকতে না দেওয়ায় তাদের বেধে দেওয়া আট থেকে ১০ টাকা কেজি দরে কৃষকরা শিম বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। যেখানে বর্তমানে স্থানীয় খুচরা বাজারে প্রতি কেজি শিমের দাম ৩০ টাকা। এ ছাড়া তাদের উৎপাদিত শিম ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন দেশে রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে। কিন্তু লাভের সব অংশই চলে যাচ্ছে মধ্যসত্ত্বভোগীদের পকেটে।
কৃষদের অভিযোগ, একবিঘা জমিতে শিম চাষ করতে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা খরচ হয়। অন্যদিকে প্রতি কেজি শিম ক্ষেত থেকে ছিড়তে খরচ হয় দুই টাকা, এরপর রয়েছে পরিবহন ও আড়ৎদারী খরচ। প্রতি কেজি শিম বিক্রি করে বর্তমানে কৃষকের পকেটে যাচ্ছে মাত্র পাঁচ টাকা। অন্যদিকে মধ্যসত্ত্বভোগীদের পকেটে যাচ্ছে ১৫ থেকে ২০ টাকা। লক্ষ্মীকন্দর এলাকার কৃষকরা স্থানীয় প্রশাসন ও কৃষি বিভাগের কাছে তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য দাবি করেছেন।
সুকেশ বিশ্বাস নামে এক ব্যাপারি বলেন, ‘‘মাগুরা লক্ষ্মীকন্দর গ্রামের শিম খুবই মানসম্পন্ন। তাছাড়া গাছ থেকে ছিড়ে প্রক্রিয়াজাত করার পর এ শিম দীর্ঘদিন ভাল থাকায় বিদেশে রপ্তানিযোগ্য। ফলে ঢাকার আড়ৎদাররা সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে এ শিম রপ্তানি করে থাকেন।’’
তবে কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘‘কাঁচা পণ্যের ব্যবসায় অনেক ঝুঁকি রয়েছে, ফলে কৃষক পর্যায় থেকে খুচরা বাজারে দামের তারতম্য রয়েছে।’’
স্থানীয় ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা নিকুঞ্জ কুমার মণ্ডল বলেন, লক্ষ্মীকন্দর মাঠের শিম আকারে বড় ও মোটা, খেতেও অনেক সুস্বাদু। ফলে সারাদেশের পাশাপাশি বিদেশের বাজারেও এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবু তালহা বলেন, লক্ষ্মীকন্দর মাঠে প্রায় ২০০ হেক্টর জমিতে শিম চাষ হয়েছে। যে কারণে ‘শিম গ্রাম’ লক্ষ্মীকন্দরকে তারা নিরাপদ সবজি গ্রাম হিসেবে ঘোষণা করেছেন। তারা এলাকায় নিরাপদ সবজি উৎপাদন ও কৃষদের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তির জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।
জেলা মাকের্টিং অফিসার জািকর হোসেন জানান, কৃষকরা তাদের উৎপাদিত শিমের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না। কৃষক পর্যায় থেকে খুচরা বাজারের শিমের দামের অনেক বেশি। তারা জেলা প্রশাসনের সহায়তা নিয়ে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করছেন। এ ছাড়া স্থানীয়ভাবে কৃষকরা যাতে সরাসরি বিদেশে শিম রপ্তানি করতে পারেন সে বিষয়েও তারা কাজ শুরু করেছেন।