জলবায়ু পরিবর্তন: আর্কটিকে কমছে স্লেজ কুকুরের সংখ্যা, পেশা বদলাচ্ছেন শিকারীরা
আয়তনে প্রায় দুই কোটি বর্গ কিলোমিটারের আর্কটিক সার্কেল উত্তর মহাসাগর, গ্রিনল্যান্ড, রাশিয়া, নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরাংশ নিয়ে গঠিত, বছরের বেশিরভাগ সময়ে বরফাবৃত থাকে এ অঞ্চল।
পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তের মতোই আর্কটিক সার্কেলও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে হুমকির মুখে। এ অঞ্চলের বেশিরভাগ অংশ সমুদ্র, বছরের সিংহভাগ সময় হিমায়িত থাকে এ জলভাগ।
বৈশ্বিক উষ্ণতার দরুণ দিন দিন এখানকার বরফ গলার হারও বাড়ছে।
আর্কটিক সার্কেলের পশ্চিম গ্রিনল্যান্ডের উপকূলীয় টাউন ইল্যুসাট একটি ব্যস্ত বন্দরনগরী। এখানকার এক বাসিন্দা কালিরাক ম্যাথ্যাউসেন। বয়স যখন ১৪, তখন থেকেই এখানকার সাগরে মাছ ধরেন তিনি। ফিশিং রড দিয়ে হালিবাট মাছ ধরতে ধরতে চোখে পড়ে শহরের ব্লকের চেয়েও বড় হিমশৈল (আইসবার্গ)।
তবে দুঃখের বিষয় হলো ইল্যুলিসাটের মতো আর্কটিক সার্কেলের সব অংশ আর আগের মতো নেই। অন্যান্য অধিবাসীর মতো কালিরাকেরও চোখে পড়ে অঞ্চলটির পরিবর্তনগুলো। কালিরাকের অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের এক প্রতিবেদনে
কালিরাক জানিয়েছেন, প্রত্যেকটি ঋতু আর আগেরবারের মতো থাকে না। এখানকার জলবায়ু আগের চেয়ে এখন আরও বেশি ঝড়ো, আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
শীতের সময় আর্কটিক অঞ্চলের সমুদ্র জমে যায়। তখন বরফের ওপর দিয়ে স্লেজে চড়ে খুব সহজেই যাতায়াত করা যায়। কালিরাক আগে তার কুকুরগুলোর টানা স্লেজে করে বিভিন্ন জায়গায় যেতেন। কিন্তু এখন সমুদ্রের পানি আর আগের মত হিমায়িত হয় না।
জলবায়ুর এহেন পরিবর্তন দেখে বেশ শঙ্কিত কালিরাক। তিনি বলেন, '২০০১ সাল থেকে লক্ষ্য করছি ডিস্কো উপসাগরে আগের মতো আর বরফ হয়না। বরফের বেড়গুলো আগের চেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে।'
স্লেজ দিয়ে যাওয়া অনিশ্চিত এবং অনেক বিপজ্জনক বলে এখন তাকে নৌকায় যেতে হয়।
বহু শতাব্দী ধরে উত্তর গ্রিনল্যান্ডের অধিবাসীরা বিশ্বের সবচেয়ে শীতল পরিবেশে বাস করেন। কিন্তু পৃথিবীর অন্য অঞ্চলের তুলনায় এখানকার তাপমাত্রা বাড়ছে অনেক দ্রুতগতিতে। আর জলবায়ু পরিবর্তনের এই প্রভাব পড়ছে স্থানীয়দের জীবনযাত্রার ধরনে।
গ্রিনল্যান্ডের উত্তর এবং পূর্বের অঞ্চলগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে ডগ-স্লেজিং প্রথা চলে আসছে। কিন্তু বরফগলার কারণে স্লেজে চড়ে যাতায়াত করার সংখ্যা অনেক কমে গেছে। সাথে সাথে কমছে পালিত কুকুর সংখ্যাও।
ইল্যুলিসাটের উপকণ্ঠে অবস্থিত অ্যাপার্টমেন্ট ব্লক থেকে একটি মাঠ চোখে পড়ে। মাঠটিকে ডজন ডজন কুকুরের বাড়ি বলা চলে। দুই দশক আগেও শুধু ইল্যুলিসাটেই পাঁচ হাজার কুকুর ছিল। সেখানে বর্তমানে রয়েছে মাত্র এক হাজার আটশ'টি।
কালরিকের এখনও ৩০টির বেশি কুকুর আছে। তাদের সাহায্যে আগে বিভিন্ন জায়গায় যাতায়াত করতেন। আর এখন কুকুরগুলোকে রেখেছেন শুধু তার কিশোর ছেলের জন্য। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, 'আগেকার জীবনের কথা এখনো খুব মনে পড়ে। কিন্তু কী আর করার! এখন এভাবেই চলতে হবে।'
ইল্যুলিসাটে স্বামী ফ্লেমিং লরিটজেনের সাথে একটি ডগ-স্লেজিং ট্যুর বিজিনেস চালান অ্যানে সোফি। তাদের সংস্কৃতি থেকে এভাবে কুকুরের বিলীন হয়ে যাওয়াতে তিনি মোটেও খুশি নন। তারা স্পষ্টত অনুভব করতে পারছেন শীতকাল ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। আশেপাশের হিমবাহগুলো কীভাবে সময়ের সাথে সাথে গলে যাচ্ছে তার প্রত্যক্ষ সাক্ষী তারা।
জাকোবশাভন হিমবাহের মানচিত্রটি দেখিয়ে ফ্লেমিং জানান, 'এই সব বরফ এখন আর নেই।'
বড়রা তো তাদের মোটামুটি দীর্ঘ জীবনে দেখছেনই, তরুণরাও তাদের সংক্ষিপ্ত জীবনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রত্যক্ষ করছেন। এমন একজন তরুণ হলেন ট্যুর বোট চালক জর্জ জোনাথানসেন। তিনি বলেন, 'ছোট থাকতে জলবায়ু এমন অনিশ্চিত ছিল না। শীত কালটা কেমন হবে এখন তা আর আগে থেকে বলা যায় না। আমার মতে এই বছরটি অন্যগুলোর চেয়ে আলাদা ছিল। এবারের গ্রীষ্ম ছিল ঠান্ডা। গ্রিনল্যান্ডের অনেক জায়গায় রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে।'
গ্রিনল্যান্ডের হিমবাহ থেকে প্রতি বছর ৩৫ হাজার কিউবিক মিটার বরফ ভেঙে পড়ে।
আভান্নাটা জেলার স্থানীয় মেয়র প্যালে জেরিমিয়াসেন জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিবিসিকে বলেন, 'আমরা এটি প্রতিদিন অনুভব করছি, প্রতিদিন দেখতে পাচ্ছি। স্থানীয় শিকারীদের ওপর এর বড় প্রভাব পড়ছে। তারা অনেক দীর্ঘ সময়ের শিকারে যেতে অভ্যস্ত। কিন্তু তারা এখন আর সেটা করতে পারছেন না। যার ফলে তাদের জীবিকা পরিবর্তন করতে হচ্ছে।'
তিনি আরও বলেন, 'এসব নেতিবাচক দিকের পাশাপাশি অনেক ইতিবাচক দিকও আছে।'
কিছু কিছু ক্ষেত্রে জীবন সহজ হয়েছে। শীতের তীব্রতা কমে যাওয়াতে অনেক নতুন সুযোগ সুবিধা উদ্ভূত হয়েছে। নতুনভাবে বিকশিত হচ্ছে ইল্যুলিসাট।
হিমবাহ গলে সৃষ্ট পানিতে থাকা পরিপোষক উপাদানের কারণে সামুদ্রিক জীবনে সমৃদ্ধি আসছে। যার ফলে এখন সারা বছর জুড়ে বোটে করে মাছ ধরা যাচ্ছে যা আগে সম্ভব ছিল না। এছাড়া হালিবাট মাছের দামও চড়া। যার দরুণ কালিরাকের মতো জেলেরা আগের চেয়ে অনেক ভালো অবস্থায় আছেন।
হালিবাট গ্রিনল্যান্ড নামক স্থানীয় জেলেদের একটি কোম্পানির প্রধান এরিক সিভার্টসেন বলেন, 'ডগ-স্লেজ ব্যবহারকারীর সংখ্যা কমলেও জলযান ব্যবহার করা জেলেদের সংখ্যা বেড়েছে। আমাদের স্থানীয় জেলেদের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন এই সুযোগটা করে দিয়েছে।'
তবে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই -বিষয়টি এমন নয়। এরিক জোর দিয়ে বলছেন, কিছু সুবিধা আসলেও বিষয়টি এখনও উদ্বেগজনক। হিমবাহগুলো এতটাই কমে গেছে যে আইসবার্গও আগের সমান বড় নেই। আপনার কাছে হয়তো বড় মনে হতে পারে, তবে আমরা ছোট থাকতে যেরকম দেখে এসেছি আর সেরকম নেই।'
বরফ গলে উত্তরের দিকে নতুন আরও জলযান চলাচলের পথ সৃষ্টি হবে। খনিজ সম্পদ খোঁজের প্রত্যাশায় খনি অনুসন্ধান সংস্থাগুলি গ্রীনল্যন্ডের দিকে আকৃষ্ট হয়েছে।
এদিকে হিমবাহ গলে যাওয়ার দরুণ উপকূলের বড় এলাকা জুড়ে বালির অঞ্চল সৃষ্টি হয়েছে। একটি জরিপে দেখা যায় এলাকাটির তিন-চতুর্থাংশ বাসিন্দাও বালি উত্তোলন ও রপ্তানি করাকে সমর্থন করেন।
কোপেনহেগেন এবং গ্রিনল্যান্ডের কতিপয় বিশ্ববিদ্যালয় করোনা মহামারির আগে গবেষণা চালিয়েছিল। সেখানে দেখা যায় ৯০ শতাংশ গ্রিনল্যান্ডবাসী মনে করেন জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে। এর মধ্যে তিন-চতুর্থাংশ মনে করেন, তারা এর প্রভাব অনুভব করতে পেরেছেন এবং তাদের সিংহভাগের কাছে ব্যক্তিগতভাবে এটি একটি গুরুতর ইস্যু।
এসব ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ ছাড়াও বিজ্ঞানীরাও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কথা অনেক আগে থেকেই বলে আসছেন। গ্রিনল্যান্ডের বরফ পাতের ওপর বৈশ্বিক উষ্ণতার কী প্রভাব পড়বে তার কঠিন সতর্ক বার্তা দিয়েছেন তারা।
বর্তমানে সমুদ্রে বার্ষিক ১.৫ মিলিমিটার বরফগলিত পানি যুক্ত হচ্ছে। একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা পুর্বানুমান করেন, কার্বন নিঃসরণ কমাতে পদক্ষেপ নিলেও সমুদ্রের পানির ২৭ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি অপরিহার্য। যদি বরফ পাতগুলো পুরোপুরি গলে যায় এ বৃদ্ধি হবে সাত মিটারের (২৩ ফুট) চেয়ে বেশি।
নরওয়ের আর্কটিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লেশিওলজিস্ট অ্যালান হাবার্ড বলে, '৯০এর দশকে ভারসাম্য বজায় ছিল। কিন্তু এখন ঘাটতির সিস্টেম তৈরি হয়েছে। যত হিমবাহ গলছে ততটা তুষার পড়ছে না।'
'গত এক দশক ধরে এখানকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বুঝলাম সত্যি সত্যি অনেক আকস্মিক পরিবর্তন ঘটছে।'
গ্রিনল্যান্ডবাসীদের কাছে এই প্রাকৃতিক পরিবর্তনগুলো যেন নিত্যদিনের সঙ্গী। ২১ বছর বয়সী ছাত্রী এবং অ্যাক্টিভিস্ট ইল্যুনা সোয়ারেনসেন বলেন, 'গ্রিনল্যান্ডবাসীরা প্রকৃতির সাথে এতটাই সম্পৃক্ত যে প্রতিটা পরিবর্তন তাদের চোখে পড়ে।'
'প্রবীণরা জীবন ও জীবিকা সম্পর্কে নানা দক্ষতা এবং জ্ঞান পরবর্তী প্রজন্মকে শিখিয়ে যান। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের দরুণ সেই জ্ঞান যদি আর সঠিক না হয়, আর যদি কাজে না আসে, তাহলে এটা অনেক দুশ্চিন্তার বিষয়। ভবিষ্যৎ অনেক বেশি পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে বলে তারা অনেক ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ছে। কিন্তু বর্তমানটিও যে পরিবর্তিত হচ্ছে!'