বয়সের সঙ্গে সঙ্গে কণ্ঠস্বর কেন বদলে যায়?
বছরের পর বছর ধরে যদি কোনো সংগীতশিল্পীর গান শোনা হয়, তাহলে তার পেশাগত জীবনের পাশাপাশি কণ্ঠস্বরের পরিবর্তনও ধরতে পারবেন শ্রোতা । বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শরীরের শ্বসনতন্ত্রের বিভিন্ন অংশে পরিবর্তন আসে বলেই স্বরের এমন পার্থক্য দেখা দেয়।
ভোকাল কর্ডের মাধ্যমে শব্দ উৎপন্ন হয়। ভোকাল কর্ড থাকে ল্যারিংস তথা স্বরযন্ত্রে। এটি শ্বসনতন্ত্রের এমন একটি অংশ যা গলা থেকে ফুসফুসে বাতাস যেতে দেয়। বাতাস যখন ফুসফুস থেকে স্বরযন্ত্রের মধ্য দিয়ে নির্গত হয়, তখন এটি ভোকাল কর্ডগুলোকে কম্পিত করে। আর এতেই শব্দ তৈরি হয়।
ভোকাল কর্ড তিনটি প্রধান অংশ নিয়ে গঠিত: ভোকালিস পেশি, ভোকাল লিগামেন্ট এবং এগুলোকে আবৃত করে রাখা একটি শ্লেষ্মা ঝিল্লি (মিউকাস মেমব্রেন্স)। এটি পৃষ্ঠকে আর্দ্র রাখে এবং ক্ষতি থেকে রক্ষা করে।
তবে স্বরযন্ত্রে আরও অন্যান্য ১৭টি পেশি আছে, যেগুলো ভোকাল কর্ডের অবস্থান পরিবর্তন করতে পারে। এতে উৎপাদিত শব্দও পরিবর্তিত হয়।
বয়ঃসন্ধিকালের আগে নারী ও পুরুষের কণ্ঠস্বরে খুব কমই পার্থক্য থাকে। কিন্তু বয়ঃসন্ধির সময় (মেয়েদের ক্ষেত্রে ৮–১৩ বছর, ছেলেদের ৯–১৪) হরমোন তাদের প্রভাব প্রয়োগ করতে শুরু করে। এতে স্বরযন্ত্রের গঠনে পরিবর্তন আসে। এ সময় পুরুষের অ্যাডামস অ্যাপল আরও বেশি প্রত্যক্ষ হয় এবং ভোকাল কর্ডের দৈর্ঘ্য বাড়ে। বয়ঃসন্ধির পরে পুরুষের ভোকাল কর্ডের দৈর্ঘ্য হয় সাধারণত ১৬ মিলিমিটার আর নারীর হয় ১০ মিলিমিটার।
বয়ঃসন্ধির পর নারীর ভোকাল কর্ড ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত সরু হয়। এই ছোট ও সরু ভোকাল কর্ডই পুরুষের তুলনায় নারীর স্বর সাধারণভাবে উচ্চ হওয়ার কারণ।
বয়ঃসন্ধির পরও হরমোন কণ্ঠস্বরকে প্রভাবিত করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, একজন নারীর কণ্ঠস্বর তার ঋতুচক্রের বিভিন্ন পর্যায়ের ওপর নির্ভর করে ভিন্ন হতে পারে। অভিউলেটরি তথা ডিম্বাস্ফীতির পর্যায়ে কণ্ঠস্বর সবচেয়ে সুন্দর শুনায়। কারণ এই পর্বে গ্রন্থিগুলো সর্বাধিক শ্লেষ্মা (মিউকাস) তৈরি করে, যা ভোকাল কর্ডগুলোকে তাদের সর্বোত্তম কার্যকরী ক্ষমতা প্রদান করে।
গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভনিরোধক পিল গ্রহণকারী নারীদের কণ্ঠে কম বৈচিত্র্য পাওয়া যায়। কারণ পিলটি ডিম্বস্ফোটন বন্ধ করে দেয়।
অন্যদিকে, পিরিয়ডের আগে হরমোনের পরিবর্তন কণ্ঠনালীকে বাধাগ্রস্ত করে, তাদের শক্ত করে তোলে। অপেরা শিল্পীদের দিয়েই এর উদাহরণ দেওয়া যায়। ১৯৬০-এর দশকে পিরিয়ডের আগে নারীদের 'গ্রেস ডে' দেওয়া হতো, যাতে তাদের ভোকাল কর্ড অক্ষত থাকে। এবং যেহেতু নারীদের ভোকাল কর্ড সরু, তাই অতিরিক্ত ব্যবহারে তাদের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কাও বেশি হতে পারে।
শরীরের প্রায় প্রতিটি অংশের মতো, ভোকাল কর্ডেরও বয়স বাড়ে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বরযন্ত্রটি তরুণাস্থির (কাটিলিজ) চেয়ে শক্ত, অনেকটা হাড়ের মতো হয়ে যায়। পুরুষের ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন ৩০ বছরের পর ঘটতে শুরু করে। এটি ভোকাল কর্ডগুলোকে কম নমনীয় করে তোলে।
যে পেশিসমূহ ভোকাল কর্ড নড়াচড়া করতে দেয়, সেগুলোও আমাদের বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষয় হতে শুরু করে। ভোকাল কর্ডগুলোকে সচল রাখা লিগামেন্ট এবং টিস্যুগুলোও কম নমনীয় হয়ে ওঠে। কণ্ঠও ভারী হয়ে যায়। এছাড়াও ফুসফুসের পেশির কার্যকারিতা হ্রাস পায় — শব্দ তৈরি করতে ফুসফুস থেকে বের হওয়া বাতাসের শক্তি কমায়। স্বরযন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা হ্রাসের পাশাপাশি প্রতিরক্ষামূলক শ্লেষ্মা উৎপাদনকারী গ্রন্থিগুলোর সংখ্যাও কমে যায়।
যদিও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোকাল কর্ডের পরিবর্তন অবিশ্যম্ভাবী। তবে জীবনধারণের ধরনের কারণেও ভোকাল কর্ডের ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি বাড়তে পারে। এতে ব্যক্তির কণ্ঠস্বরও পরিবর্তন হতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, ধুমপান শ্লেষ্মা উৎপাদন বৃদ্ধি করে ঠিকই, তবে মিউকোসাল পৃষ্ঠগুলোকে শুকিয়েও দিতে পারে। মদ্যপানও অনুরুপ প্রভাব ফেলতে পারে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই কারণগুলো ভোকাল কর্ডের ক্ষতি করতে পারে এবং কণ্ঠস্বরে পরিবর্তন আনতে পারে।
চিকিৎসকের প্রেসক্রাইব করা কিছু ওষুধও কণ্ঠস্বর পরিবর্তন করাতে পারে। যেমন ল্যারিঞ্জাইটিসের জন্য ব্যবহৃত করা স্টেরয়েড ইনহেলার। 'ব্লাড থিনার'ও ভোকাল কর্ডের ক্ষতি করতে পারে। এতে কণ্ঠস্বর কর্কশ হতে পারে। আবার 'মাসল রিলেক্সেন্ট' পেটের অ্যাসিডকে স্বরযন্ত্রে ফিরিয়ে দেয়। এতেও ভোকাল কর্ডের ক্ষতি হতে পারে। তবে ব্যবহার করা ছেড়ে দিলে সাধারণত ওষুধ থেকে হওয়া ক্ষতিগুলো চলে যায়।
ভোকাল কর্ডের ক্ষতির আরও একটি কারণ হতে পারে অতিরিক্ত ব্যবহার। সাধারণত গায়ক কিংবা এমন অন্যান্য ব্যক্তিদের মধ্যে বেশি ক্ষতি দেখা যায় — যারা কাজের সময় তাদের কণ্ঠস্বর অনেক বেশি ব্যবহার করেন। এ তালিকায় আরও আছেন শিক্ষক কিংবা ফিটনেস প্রশিক্ষক।
এটি রেইনকে'স ঈডেমা নামক একটি অস্বাভাবিক অবস্থার দিকে ভোকাল কর্ডকে নিয়ে যেতে পারে, যা ধূমপানের কারণেও হতে পারে। অবস্থা গুরুতর হলে রেইনকে'স ঈডেমার জন্য অস্ত্রোপচার করাতে হয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিশ্রাম নিলে এবং ধুমপান ও মদ্যপান না করলে উপকার পাওয়া যায়। গলার স্বরের পরিবর্তন সারাতে অনেক সময় স্পিচ ও ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি নেওয়া যেতে পারে।
যদিও কিছু ক্ষেত্রে আমরা ভোকাল কর্ডের বয়স-সম্পর্কিত পরিবর্তন এড়াতে পারি না। তবে ক্রমাগত ব্যবহারের মাধ্যমে কণ্ঠের গুণমান ও ক্ষমতা বজায় রাখা যায়। যেমন মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার না করলে গায়ক/গায়িকাদের কণ্ঠস্বর অন্য সমবয়সীদের তুলনায় কম পরিবর্তন হয়।
প্রতিদিন উচ্চস্বরে গান গাওয়া বা পড়া ভোকাল কর্ডের ক্ষয়ের গতি কমাতে ব্যায়াম হিসেবে কাজ করতে পারে।
ভোকাল কর্ডের যত্ন নেওয়াও গুরুত্বপূর্ণ। পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করলে এবং ধুমপান ও মদ্যপান সীমিত করলে ভোকাল কর্ডের দ্রুত ক্ষয় প্রতিরোধ করা যেতে পারে।