‘ইওর অনলাইন ফার্মাসিস্ট’
'ঔষধ খাবার খাওয়ার আগে বা পরে যেকোনো সময় খাওয়া যেতে পারে', 'যেকোনো ঔষধ খাওয়ার আগেই গ্যাসের ঔষধ খেতে হয়' কিংবা 'দামি অ্যান্টিবায়োটিক মানেই ভালো অ্যান্টিবায়োটিক' — ঔষধ নিয়ে এমন অনেক ধারণা আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে। সঠিক জ্ঞানের অভাবে এসব ধারণাই একসময় 'ধ্রুব সত্য' হিসেবে পরিণত হয় সাধারণ মানুষের কাছে। ফলাফল? ভুল ঔষধ সেবন আমন্ত্রণ জানাতে পারে মৃত্যুকেও।
ঔষধ কিংবা স্বাস্থ্য নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে যেসব ভুল ধারণা রয়েছে, সেগুলো দূর করার জন্য কাজ করছে 'ক্লিয়ার কনসেপ্ট'। ঔষধকেন্দ্রিক বিভিন্ন ভ্রান্ত ভাবনা দূরীকরণে ২০২২ সাল থেকে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। নেপথ্যে নেতৃত্ব দিচ্ছেন মোহাম্মদ হীরোক শেখ। 'ডিসপেল ইওর মিনকনসেপশন, এনলার্জ ইওর নলেজ' অর্থাৎ 'ভ্রান্তধারণা দূর করুন, জ্ঞানের পরিধি বাড়ান' — প্রতিপাদ্যকে কেন্দ্র করে কাজ করে যাচ্ছে এ অনলাইনভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি।
'রিপোর্টটিতে কী কী সমস্যা আছে?' বা 'রিপোর্ট সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা দিলে উপকৃত হব' কিংবা 'প্রেসক্রিপশনে লেখা ঔষধগুলোর জেনেরিক নাম এবং কাজ সম্পর্কে জানতে চাই' — ঔষধ সংক্রান্ত প্রতিদিন এমন অজস্র প্রশ্ন আসে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্মেসিতে ব্যাচেলর সম্পন্ন করা হীরোকের কাছে। একদল ডাক্তার ও ফার্মাসিস্টদের সঙ্গে নিয়ে হীরোক প্রতিনিয়ত চেষ্টা করেন সেসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার। রোগীদের কাউন্সেলিং করার মাধ্যমে চেষ্টা করেন ঔষধ নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা আনার।
কেন বেছে নিলেন ঔষধ
ঔষধ নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু হয় হীরোকের নিজের পরিবার থেকেই। করোনা মহামারিতে নিজের মায়ের সঙ্গে ঘটা এক দুর্ঘটনার পর হীরোক ঠিক করেন ঔষধ নিয়ে কাজ করবেন।
তিনি বলেন, "কোভিডের সময় আমার আম্মু হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে যান। যথারীতি আম্মু ডাক্তারের কাছে যান এবং ডাক্তার তাকে ঔষধ দেন। আম্মু ঔষধ খাওয়ার পরপরই দেখা গেল তিনি অস্থির হয়ে যাচ্ছেন, মাথা ঘোরানোর জন্য বসে থাকতে পারছেন না। পরে আমি প্রেসক্রিপশন নিয়ে দেখি, সেখানে 'ড্র্যাগ ইন্টারঅ্যাকশন'-এর একটি ঘটনা ঘটেছে।"
'যখন আমরা দুই-তিনটি ঔষধ খাই, তখন একটি ঔষধ আরেকটি ঔষধের কাজ করার ক্ষমতা বাড়িয়ে-কমিয়ে দিতে পারে। আমার আম্মুর ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছিল,' বলেন তিনি।
'এক্ষেত্রে আম্মুরও কিছু ভুল ছিল। আম্মু একসঙ্গেই সব ঔষধ খেয়েছিল। ঔষধ খাওয়ার ক্ষেত্রে এমনটা করা উচিত নয়। কিছুটা সময় গ্যাপ রেখে খাওয়া উচিত। তখন চিন্তা করলাম, শুধু আমার আম্মু নয়, বাংলাদেশে অনেক মানুষের ঔষধ নিয়ে জানার ঘাটতি আছে,' বলছিলেন এ উদ্যোক্তা।
হীরোকের ক্লিয়ার কনসেপ্ট প্রথমদিকে কাজ শুরু করেছিল বিজ্ঞানবিষয়ক বিভিন্ন ভ্রান্তধারণা নিয়ে। কাজ করতে গিয়ে দেখলেন, বাংলাদেশে বিজ্ঞানের পাশাপাশি ঔষধ নিয়েও প্রচুর ভ্রান্তধারণা ছড়িয়ে আছে। হীরোকের নিজের পড়াশোনা যেহেতু ফার্মেসি নিয়ে, তাই ঔষধ নিয়ে কাজ করতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি।
হীরোক বলেন, 'আমরা আমাদের ভিডিওগুলো এমনভাবে তৈরি করি, যেখান থেকে অডিয়েন্স বা সাধারণ মানুষ যেকোনো বিষয় সহজভাবে বুঝে নিতে পারবে। ঔষধ কীভাবে কাজ করে, ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কেন হয়, কীভাবে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কমানো যায় বা ঔষধ খাওয়ার সঠিক নিয়ম কী — এ বিষয়গুলো নিয়ে স্বচ্ছ একটা ধারণা পেতে পারে আমাদের ভিডিও থেকে।'
ডাক্তার এবং রোগীর মাঝে 'সেতু'
'একজন ডাক্তার এবং রোগীর মাঝে যে সম্পর্ক তৈরি হয়, সেটা কিন্তু হয় একটি প্রেসক্রিপশনের মাধ্যমে। রোগীকে প্রেসক্রিপশন ঠিকমতো বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য কিন্তু কেউ নেই। ঔষধের দোকানদার কিন্তু ঔষধ বিষয়ে দক্ষ নন। তিনি ঠিকমতো সবসময় বোঝাতে পারেন না। আবার আমাদের দেশে ডাক্তারদেরও সে সময়টা সবসময় থাকে না। ডাক্তার এবং রোগীর মধ্যে যোগাযোগের যে ফাঁক থেকে যায়, সেটি নিয়ে কাজ করছে ক্লিয়ার কনসেপ্ট,' বলেন হীরোক।
২০১৯ সালে বিজ্ঞান নিয়ে কাজ শুরু করলেও ক্লিয়ার কনসেপ্ট পরিপূর্ণভাবে ঔষধের দিকে মনোযোগ দেয় ২০২২ সালে। সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিতি পায় 'ইওর অনলাইন ফার্মাসিস্ট' হিসেবে।
ক্লিয়ার কনসেপ্ট-এর যাত্রা শুরু হয় হীরোক শেখ এবং তার বন্ধু দুর্জয়ের হাত ধরে। প্রসার ঘটে করোনা মহামারিতে। প্রথমদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যুক্ত থাকলেও অচিরেই এটি ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমানে ২৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের ৩০০ জনেরও বেশি শিক্ষার্থী কার্যনির্বাহী সদস্য হিসেবে যুক্ত আছেন ক্লিয়ার কনসেপ্টের সঙ্গে।
বর্তমানে ক্লিয়ার কনসেপ্ট-এ হীরোকের সঙ্গে সহপ্রতিষ্ঠাতা হিসেবে যুক্ত আছেন ডাক্তার ফাহিম ফিরোজ সাকিব। হীরোকের মূল দলে আরও আছেন কয়েকজন ফার্মাসিস্ট এবং পাঁচজন ডাক্তার, যারা মানুষের ঔষধ বা প্রেসক্রিপশনজনিত বিভিন্ন সমস্যার সমাধান দিয়ে থাকেন।
প্রশিক্ষণ পান পল্লী চিকিৎসকেরাও
সাধারণ মানুষের পাশাপাশি ক্লিয়ার কনসেপ্ট-এর ভিডিওর অন্যতম গ্রাহক পল্লী চিকিৎসক বা ঔষধের দোকানদারেরা। ঔষধ বিষয়ে জ্ঞানদানের উদ্দেশ্যে তাদের জন্যও ভিডিও তৈরি করা হয়।
হীরোক বলেন, 'আমাদের যারা পল্লী চিকিৎসক বা ঔষধের দোকানদার আছেন, তাদের মাধ্যমেও কিন্তু অনেক ভুলভ্রান্তি হতে পারে। তারা একদম পেশাগতভাবে কিন্তু ঔষধ নিয়ে জানেন না বা বোঝেন না। তাদের জন্য তাদের মতো করে বাংলাভাষায় সহজভাবে ঔষধ নিয়ে বোঝানোর কাজ করছি।'
ভিডিও তৈরি ছাড়াও ক্লিয়ার কনসেপ্ট বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিদের দ্বারা তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের বিভিন্ন ফার্মেসিতে ঔষধ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। 'বিভিন্ন ঔষধের দোকানে গিয়ে আমাদের প্রতিনিধিরা জানাচ্ছেন এবং বোঝাচ্ছেন অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্সের কথা। কেন অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্স ভয়াবহতার দিকে যাচ্ছে, সেটি সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয় জানানো হয় ঔষধের দোকানদারদের।'
রোগীদের কাউন্সেলিংও করেন তারা!
রোগীদের কাউন্সেলিং করার কাজও করে ক্লিয়ার কনসেপ্ট। সাধারণ মানুষ চাইলেই ডাক্তার এবং ফার্মাসিস্টের সঙ্গে কথা বলে বিভিন্ন সেবা নিতে পারবেন — এমন সুযোগ রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি।
হীরোক বলেন, "আমাদের 'কোন ওষুধ কেন খাব' নামে ফেসবুকে একটি গ্রুপ আছে। সেখানে বিভিন্ন প্রেসক্রিপশন রিভিউ করা হয়। কিন্তু সেখানে রোগীকে পুরোপুরি বোঝানো অনেক সময় সম্ভব হয় না। এজন্য আমরা পেশাদারিভাবে রোগীদের কাউন্সেলিংয়ের কাজ শুরু করেছি।'
'কমিউনিটি ফার্মাসিস্ট'-এর বিষয়টি অনলাইনে নিয়ে এসেছে ক্লিয়ার কনসেপ্ট। 'রোগী আমাদের কাছে প্রেসক্রিপশন জমা দেয়, আমরা ডাক্তার এবং ফার্মাসিস্টেরা রোগীর সঙ্গে সেশনের আয়োজন করি। সেখানে তার রোগ নিয়ে এবং ঔষধ নিয়ে আলোচনা করা হয়।'
"সরাসরি ভয়েস কলের মাধ্যমে এ সেবা দেওয়া হয়। যদি প্রশ্ন করা হয়, ক্লিয়ার কনসেপ্টের মূল বিষয় কোনটি, তাহলে আমরা বলব, 'পেশেন্ট কাউন্সেলিং' করা। আমাদের সামনের ইচ্ছে সরাসরি ডাক্তার এবং ফার্মাসিস্টদের নিয়ে রোগীদের সেবা দেওয়া।"
২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে তারা চালু করেছেন 'পেশেন্ট কাউন্সেলিং' সেবা। এখন পর্যন্ত ২০০ জনের বেশি রোগীকে তারা ভয়েস কলের মাধ্যমে কাউন্সেলিং করিয়েছেন। প্রতিদিন তিন থেকে চারজন রোগীকে এ সেবা প্রদান করা হয়। ৩০ থেকে ৪০ মিনিটের কাউন্সেলিং-এর পর রোগীকে রোগ, ঔষধ খাওয়ার নিয়ম এবং পরামর্শ বিষয়ক কাগজপত্র পিডিএফ আকারে দেওয়া হয়। ১৫০ টাকার বিনিময়ে যেকোনো রোগী এ সেবা নিতে পারেন।
পেয়েছেন মানুষের ভালোবাসাও
ঔধধ নিয়ে বিভিন্ন ভুলধারণার পাশাপাশি অনেকসময় ভয়ও কাজ করে মানুষের মধ্যে। প্রথম থেকেই হীরোক চেষ্টা করছেন মানুষের মধ্য থেকে এসব ভয় কাটানোর। হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছেন ভরসার জায়গা। তাই যেকোনো সমস্যার কথা অবলীলায় যাতে ক্লিয়ার কনসেপ্ট-এর মারফতে তার কাছে এসে পৌঁছায়, সে চেষ্টাও বজায় রেখেছেন।
এমনই এক ঘটনার কথা উল্লেখ করে হীরোক বলেন, 'একদিন এক আপু এসে বললেন, তিনি তার আব্বুকে ভুল করে এক ঔষধ দুইবার খাইয়ে ফেলেছেন। আপুটি খুব অপরাধবোধে ভুগছিলেন। প্রত্যেক ঔষধের কিছু থেরাপিটিক সূচক থাকে। একটা ঔষধ কোন ডোজে কতটুকু পর্যন্ত নিরাপদ, তার একটা ভ্যালু থাকে। আপুটি যে ঔষধটি দুইবার দিয়েছিলেন, সেটা সেফ ডোজ ছিল। সব শুনে তিনি ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। ওই সময়ের ভালোলাগার কথা আসলে বলে বোঝানো যাবে না।'
মানুষের ভালোবাসার স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২৩ সালে হীরোক শেখ-এর ক্লিয়ার কনসেপ্ট অর্জন করে 'জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড-২০২৩' পুরস্কার। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত নিজস্ব অর্থায়নেই চলছে ক্লিয়ার কনসেপ্ট। 'স্টুডেন্ট অবস্থায় যেহেতু শুরু করেছিলাম, তখন টাকা-পয়সা জোগাড় করে কাজ করতে হয়েছে। তখন কাজের গতি কম ছিল। আমরা যদি কোনো জায়গা থেকে অর্থায়ন পেতাম, তাহলে আরও অনেকদূর যেতে পারতাম,' বলেন এ তরুণ।
'বাংলাদেশে ফার্মাসিস্টদের স্বীকৃতি তেমন নেই'
হীরোকের মতে, ডাক্তারকে বাংলাদেশের মানুষ যতটা সম্মান কিংবা স্বীকৃতি দেয়, সেই তুলনায় একজন ফার্মাসিস্ট অতটা স্বীকৃতি পান না। ফার্মাসিস্টদের কাজ যে ঔষধ নিয়ে, সেটিই অনেকে স্মরণে রাখতে চান না।
'আমি যখন ঔষধ নিয়ে কথা বলি তখন কিছু মন্তব্য থাকে যে, আপনি কেন ঔষধ নিয়ে কথা বলেন? ঔষধ একটি ব্যক্তিগত জিনিস, যা নিয়ে কথা বলার দরকার নেই। ডাক্তার তো আছেই, আপনি কেন ঔষধ নিয়ে কথা বলবেন? এই যে সমস্যাটা; সামাজিক কারণে আমরা ফার্মাসিস্টরা সামাজিক স্বীকৃতি খুব একটা পাই না,' বলেন হীরোক।
আগামী পাঁচ বছরে দশ লক্ষ মানুষকে সেবা দেওয়ার স্বপ্ন দেখেন হীরোক। ক্লিয়ার কনসেপ্টকে তৈরি করতে চান পরিপূর্ণ 'হেলথ প্ল্যাটফর্ম' হিসেবে। এমন একটা প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করাতে চান, যেখানে ঔষধ এবং রোগের বিষয়ে সব রকমের সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে।