বর্ণান্ধদের জীবন যেভাবে রঙিন করে তুলছেন সাইফ
গবেষণা বলে, বিশ্বের ৩০ কোটিরও বেশি মানুষ বর্ণান্ধ বা কালার ব্লাইন্ড। প্রতি ১২ জন পুরুষ আর ২০০ জন নারীর মধ্যে একজন করে বর্ণান্ধ হয়ে থাকেন।
বর্ণান্ধ মানুষ বলতে অনেকেই মনে করেন, তারা কোনো রঙই দেখতে পান না, সব ধূসর দেখেন। কিন্তু এটি ভুল ধারণা। প্রায় ৯৫ ভাগ বর্ণান্ধ মানুষের শুধু দুটি রঙ দেখতে সমস্যা হয়— লাল এবং সবুজ। বাকি ৫ ভাগের কিছু অংশ নীল ও হলুদ রঙ দেখতে পান না। আর খুবই কম সংখ্যক বর্ণান্ধ মানুষই কোনো রঙ দেখতে পায় না, সব ধূসর দেখেন। এর সংখ্যা ৩০ হাজারে একজন।
বাংলাদেশে বর্ণান্ধতা নিয়ে তেমন সচেতনতা নেই। অনেক মানুষ আছেন, যারা কখনো বুঝতেই পারে না যে তারা বর্ণান্ধ। কেউ আবার বিভিন্ন পরীক্ষার মেডিকেল অংশে গিয়ে বুঝতে পারেন যে, তারা বর্ণান্ধ। ঠিক যেমনটা বুঝেছিলেন সাইফ আহমেদ।
ছোটবেলা থেকেই তার ইচ্ছা ছিল পাইলট হবেন। সেই স্বপ্ন পূরণ করতে ২০১৯ সালে এইচএসসি পাশ করার পর গ্যালাক্সি ফ্লাইং একাডেমিতে ভর্তি হন তিনি। পাইলট হওয়ার সকল পরীক্ষায় সফলতার সাথে পাশ করার পর মেডিকেল টেস্টে গিয়ে বুঝতে পারলেন, তিনি বর্ণান্ধ। আজন্ম লালিত স্বপ্নভঙ্গের পর হতাশায় ডুবে যান সাইফ। তারপর ঠিক করেন বর্ণান্ধদের চোখে রঙিন আলো ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য নিজের জীবন তিনি উৎসর্গ করবেন।
শুরু হয় বর্ণান্ধদের নিয়ে তার গবেষণা। গবেষণায় আরও সুবিধা হওয়ার জন্য নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগে ভর্তি হন সাইফ। অনেক গবেষণার পর ২০২২ সালে বর্ণান্ধদের জন্য তৈরি করেন চশমা। এ চশমা চোখে দিলে বর্ণান্ধরা রঙ দেখতে পান। সাইফ তার চশমার নাম দিয়েছেন 'ভাইব্র্যান্ট'। শুধু চশমাই না, বর্ণান্ধদের জন্য চোখের লেন্স আর মোবাইলের স্ক্রিন প্রটেক্টরও বানিয়েছেন তিনি। সাইফ আহমেদের আবিষ্কার ও তার ভবিষ্যৎ চিন্তা-ভাবনা নিয়ে আজকের আয়োজন।
যেভাবে শুরু
বর্ণান্ধতা অনিরাময়যোগ্য একটি রোগ। চোখের রেটিনার কোণ কোষ দিয়ে আমরা রঙ দেখতে পাই। কিন্তু জেনেটিক বা অন্য কোনো কারণে কোণ কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হলে কিছু রঙ দেখতে পাই না আমরা।
২০১৯ সালে নিজেকে বর্ণান্ধ হিসেবে আবিষ্কার করার পর ভেঙ্গে পড়েন সাইফ। চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়েছিলেন, কিন্তু কোনো সমাধান পাননি। মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ার কারণে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছেও যেতে হয়েছিল বেশ কয়েকবার। তারপর নিজেকে সামলিয়ে উঠে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।
সাইফ বলেন, "করোনার সময়ে নতুন নতুন টিকা ও ওষুধ আবিষ্কারে কিন্তু ফার্মাসিস্টদের অবদানই বেশি ছিল। যেকোনো রোগের নিরাময় আবিষ্কারে ফার্মেসির অবদান থাকে। যদিও এদের কাজের স্বীকৃতি সবচেয়ে কম, তাও আমি ভাবলাম বর্ণান্ধদের নিয়ে কাজ করার জন্য যদি ফার্মেসিতে যাই, আমার কাজে সাহায্য হবে।"
বর্ণান্ধদের জন্য চশমার যে ধারণা, এটি একেবারে নতুন না। ২০০০ সালে আমেরিকান বিজ্ঞানী ড. ডন ম্যাকফারসন লেজার সার্জারি অপারেশনে ডাক্তারদের চোখের নিরাপত্তার জন্য একটি বিশেষ ধরনের লেন্স দিয়ে চশমা তৈরি করেন। সেটি দিয়ে বর্ণান্ধরা কিছু কিছু রঙ দেখতে পান প্রথমবারের মতো। পরে আমেরিকান চশমার ব্র্যান্ড এনক্রোমা ২০১০ সালে বর্ণান্ধ মানুষদের ব্যবহারের জন্য আধুনিক ফিল্টার লেন্স দিয়ে চশমা তৈরি করে। প্রথম দিকে এটি তেমন জনপ্রিয়তা না পেলেও ২০১৫ সাল থেকে মিডিয়াতে অনেক প্রচারণা শুরু করে এনক্রোমা। ফলে দিনদিন এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়।
বর্তমানে বর্ণান্ধদের জন্য এনক্রোমা বেশ জনপ্রিয়। ইউরোপ ও আমেরিকায় এর বেশি ব্যবহারকারী দেখা যায়। বর্ণান্ধদের জন্য চশমাতো আগেই তৈরি হয়েছে। তাহলে সাইফ আহমেদের চশমার বিশেষত্ব কী?
প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, "আমার চশমা এনক্রোমার চশমা থেকে অবশ্যই ব্যতিক্রম। এর তিনটি কারণ আমি বলতে পারি। প্রথমত, এর রঙ। এনক্রোমার চশমা হয় সানগ্লাসের মতো। অর্থাৎ, এটি পরলে বাইরে থেকে আপনার চোখ দেখা যাবে না। কিন্তু আমার চশমা পরলে চোখ দেখা যায়। আমার তৈরি লেন্সের রঙ গাড় সানগ্লাসের মতো না।"
"দ্বিতীয়ত, এর পাওয়ার সেট করার ব্যবস্থা। এনক্রোমার চশমায় পাওয়ার সেট করা যায় না। কিন্তু আমি আপনার চোখের পাওয়ার অনুযায়ী চশমা বানিয়ে দিতে পারবো। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো দাম! এনক্রোমার একটা চশমার দাম ২৫০ থেকে ৫০০ ডলার পর্যন্ত হয়। অর্থাৎ, ৩০ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকা। এত দাম দিয়ে চশমা কেনার চেয়ে বর্ণান্ধতা বরণ করে নেওয়াই শ্রেয় বলে মনে হতে পারে অনেকের," যোগ করেন সাইফ।
বর্ণান্ধতা নিয়ে আমাদের দেশের মানুষের ধারণা একেবারেই কম। ভাইব্র্যান্ট চশমা নিয়ে কাজ শুরু করার পর, নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীদের মাঝে কেউ বর্ণান্ধ আছেন কি–না তা জানার জন্য মাত্র ৪০ মিনিট জরিপ চালিয়েছিলেন সাইফ। এরমধ্যে তিনি ৬ জন বর্ণান্ধ খুঁজে পান। যাদেরকে বর্ণান্ধ হিসেবে চিহ্নিত করেন, তারা নিজেরাই জানতেন না যে তারা বর্ণান্ধ।
"জাপানিজ চিকিৎসক শিনবৌ ইশিহারার তৈরি ইশিহারা টেস্ট দিয়ে বর্ণান্ধতা যাচাই করা যায়। আমাদের দেশে প্রাথমিক শিক্ষার শুরুতেই ইশিহারা টেস্ট দিয়ে বর্ণান্ধতা যাচাই করার ব্যবস্থা রাখা উচিত," বললেন সাইফ।
চশমা তৈরির জন্য তিন বছর ধরে এই কাজ নিয়ে গবেষণা করেছেন সাইফ আহমেদ। অনেক ব্যর্থ চেষ্টার পর অবশেষে ২০২২ এ সফলতা পান তিনি। তারপর থেমে থাকেনি তার কাজ। চশমার ফর্মুলা কাজে লাগিয়ে সফলভাবে লেন্স নিয়ে আসেন দুই বছর পর। একই ফর্মুলা দিয়ে তৈরি করেন মোবাইলের স্ক্রিন প্রটেক্টর।
ফর্মুলার মারপ্যাঁচ
কীভাবে তৈরি করেন বর্ণান্ধদের জন্য চশমা? জিজ্ঞেস করলে সাইফ আহমেদ বলেন, "একটা সাধারণ চশমার দোকানে যেসব যন্ত্রপাতি থাকে, আমার কাছে তা-ও নেই। সবই হাতে করি আমি। কিছু রঙ-তুলি, চশমার গ্লাস ফুটো করে ফ্রেম লাগানোর জন্য ড্রিল মেশিন আর কিছু ক্ল্যাম্প— এই আমার যন্ত্র। আধুনিক যন্ত্রের সুবিধা না থাকার কারণে অনেক সময় গ্লাস ভেঙ্গে যায়, তখন আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হয়।"
'ভাইব্র্যান্ট' চশমার মূল ফর্মুলা হলো এর রঙয়ের প্রলেপ। এটি তৈরি করার জন্য পুরান ঢাকা থেকে টিন্টিং রঙ কিনে আনা হয়। লাল, নীল, সবুজ— অর্থাৎ প্রাথমিক রঙগুলো কিনে এনে লেন্সের ওপর তুলি দিয়ে প্রলেপ দেন সাইফ।
আমাদের চোখের কোণ কোষের তিনটি অংশ আছে— লাল, নীল আর সবুজ রঙ এই তিন অংশ দিয়ে প্রবেশ করে। বর্ণান্ধ ব্যাক্তিদের মূলত এই তিনটি অংশের কোনোটি ক্ষতিগ্রস্ত থাকলে রঙ দেখতে সমস্যা হয়।
সাইফ টিন্টিং রঙ দিয়ে লেন্সের ওপর লাল, নীল, সবুজের প্রলেপ দিয়ে সেটিকে গরম পানিতে দেন। এতে রঙটি স্থায়ী হয়। তিন রঙ এর মিশ্রণে যেই ফর্মুলা তৈরি হয়, তাতেই মূলত বর্ণান্ধরা রঙ দেখতে পান। কোন রঙ কী পরিমাণে এবং কখন দেন, তা গোপন রাখতে চান তিনি। কারণ এই ফর্মুলা অনন্য এবং তার নিজের আবিষ্কার।
একই ফর্মুলা কাজে লাগিয়ে মোবাইলের স্ক্রিন প্রটেক্টর তৈরি করেছেন তিনি। চোখের লেন্সও চীন থেকে আনিয়েছেন এই ফর্মুলা অনুযায়ী অর্ডার দিয়ে।
ভাইব্র্যান্টের যে প্রাথমিক লেন্স, তা দিয়ে সাইফের ৮০ ভাগ বর্ণান্ধ ক্রেতা সুফল পেয়েছেন। আর ২০ ভাগের জন্য তাকে আলাদা করে তিন রঙয়ের মিশেলে, কম-বেশি রঙ দিয়ে লেন্স তৈরি করতে হয়েছে। যাদের চোখে পাওয়ার আছে, তাদের জন্য লেন্সের ওপরে ভাইব্র্যান্টের লেন্স বসিয়ে দিতে পারেন সাইফ। যার ফলে তার বেশিরভাগ চশমার লেন্স হয় রিমলেস।
ভাইব্র্যান্ট চশমার রঙ হালকা লালচে মনে হলেও, তা আসলে লাল না। যারা চোখে দেন, তাদের কাছে অতিরিক্ত রঙ অনুভূত হয় না।
ভাইব্র্যান্ট চশমার দাম মাত্র ৩,০০০ থেকে ৪,০০০ টাকার মধ্যে। স্ক্রিন প্রটেক্টরের দাম পড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। আর লেন্সের দাম পাওয়ার আর আমদানি খরচের ওপর নির্ভর করে।
রঙিন আলোয় চোখের পানি
"আমার বয়স কমই। এই ছোট বয়সে যখন এত মানুষ আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হয়, বড়দের চোখের পানি দেখি, এটা আমার জন্য অনেক কিছু! আমার এক ক্রেতা কাতার থেকে দেশে এসেছিলেন কয়েক মাসের জন্য। উনি কাতারে ড্রাইভিং করে দেশে সংসার চালাতেন। আবার কাতার ফিরে যাওয়ার সময় দেখলেন ড্রাইভারদেরকে কালার ব্লাইন্ডদের পরীক্ষা– ইশিহারা টেস্টে পাশ করতে হবে। উনি তারপর বিপদে পড়ে আমার কাছে আসেন। আমার থেকে ভাইব্র্যান্ট চশমা কিনে আবার কাতার যান। উনার মতো আরো অনেক মানুষ আমার ভাইব্র্যান্ট চশমা কিনে উপকৃত হয়েছেন", বলছিলেন সাইফ।
সবার জন্য চশমা তৈরি করেন না তিনি। বেশি প্রয়োজন যাদের, তার মতো বিভিন্ন পরীক্ষায় আটকে আছেন যারা- তাদেরকেই প্রাধান্য দেয়া হয়। ভাইব্র্যান্ট চশমাকে এখনো বড় আকারের লাভজনক ব্যবসা হিসেবে দেখছেন না তিনি। এই কাজকে সবসময়ই মানবসেবামূলক কার্যক্রম হিসেবে চালিয়ে নিয়ে যেতে চান সাইফ। সাইফের এই চশমার কেনার জন্য ভারত থেকেও ক্রেতা এসেছেন। তার চশমা পৌঁছে গিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশেও।
সাইফের ভাইব্র্যান্ট চশমা ব্যবহার করে অনেকেই বিভিন্ন পরীক্ষায় পাশ করছেন, মার্চেন্ডাইজ ও গার্মেন্টসে ভালো চাকরি পাচ্ছেন। মোট কথা যেসব জায়গায় বর্ণান্ধ হওয়ার জন্য বাদ পড়ে যান অনেকে, ভাইব্র্যান্টের চশমা বা লেন্স পরে তারা সেসব জায়গায় উতরে যাচ্ছেন। অনেক মানুষের জীবন বদলে দিয়েছে সাইফের ভাইব্র্যান্ট।
থেমে নেই আবিষ্কার
সাইফ নিজেকে একজন পুরোদস্তর বিজ্ঞানী হিসেবে গড়ে তুলতে চান। তার এই পর্যন্ত আসার জন্য কেউই তাকে সাহায্য করেনি। এমনকি, পরিবারের লোকজন থেকেও সহায়তা পাননি খুব একটা। এখন অবশ্য পরিবারের সমর্থন আছে। কিন্তু যখন সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল, তখন পরিবারের অসহযোগিতার স্মৃতি সাইফকে আজও কষ্ট দেয়।
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবে বিভিন্ন ওষুধ নিয়ে কাজ করছেন তিনি। ভাইব্র্যান্টের মডেল আপাতত পরিপূর্ণ বলে মনে করেন সাইফ। তাই নতুনভাবে ভাইব্র্যান্ট নিয়ে আর কাজ করছেন না। কেউ চাইলে বানিয়ে দেন চশমা বা স্ক্রিন প্রটেক্টর। সম্প্রতি নতুন একটি প্যারাসিটামল এফারভেসেন্ট ট্যাবলেট উদ্ভাবন করেছেন তিনি। পানিতে মিশিয়ে এই ট্যাবলেট পান করা যায়। জ্বর বা কোনো ব্যাথা থাকলেই মুহুর্তেই কাজ করে (র্যাপিড অ্যাকশন) এই ট্যাবলেট।
এছাড়াও ডেঙ্গুর প্রতিষেধক নিয়ে কাজ করছেন তিনি। এটির ভালো ফলাফল পাওয়া তিনি গণমাধ্যমে জানাবেন। এর আগে, এ নিয়ে বিস্তারিত কথা বলতে রাজি হননি সাইফ আহমেদ।
ভাইব্র্যান্ট নিয়ে আশাবাদী সাইফ। তিনি বিশ্বাস করেন, কর্তৃপক্ষ থেকে যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তার এই উদ্ভাবন বাংলাদেশের চিকিৎসা শিল্পকে বিশ্বমঞ্চে সম্মানের আসনে নিয়ে যাবে।